লালন শাহ্‌ ফকিরের গান কবিতার বিষয়সংক্ষেপ, কবিতার প্রেক্ষাপট, কবিতার সরলার্থ ও নামকরণের তাৎপর্য

লালন শাহ্‌ ফকিরের গান কবিতার বিষয়সংক্ষেপ, কবিতার প্রেক্ষাপট, কবিতার সরলার্থ ও নামকরণের তাৎপর্য

লালন শাহ্‌ ফকিরের গান কবিতার বিষয়সংক্ষেপ, কবিতার প্রেক্ষাপট, কবিতার সরলার্থ ও নামকরণের তাৎপর্য
লালন শাহ্‌ ফকিরের গান কবিতার বিষয়সংক্ষেপ, কবিতার প্রেক্ষাপট, কবিতার সরলার্থ ও নামকরণের তাৎপর্য

লালন শাহ্‌ ফকিরের গান কবিতার কবি পরিচিতি

জন্মপরিচয় ও শিক্ষা: ফিকির লালন সাঁই বাউল সাধক, গীতিকার ও দার্শনিক হিসেবে সুবিদিত। তাঁর পরিচয় লোককথা, মিথ এবং কিংবদন্তির দ্বারা রহস্যাবৃত। বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার ভাঁড়ারা গ্রামে আনুমানিক ১৭৭৪ (অন্য মতে ১৭৭৫) খ্রিস্টাব্দে তাঁর জন্ম। তবে লালনের ব্যক্তিজীবনের মতোই এ বিষয়েও গবেষকদের মধ্যে মতভেদ আছে। আব্দুল ওয়ালির মতে লালনের জন্ম যশোরের ঝিনাইদহের হরিশপুর গ্রামে। বসন্তকুমার পালের মতে কুষ্টিয়ার কুমারখালি থানার ভাঁড়ারা গ্রামে। কাঙাল হরিনাথের কথায় কুষ্টিয়ার ঘোড়াই গ্রামে। আবার যশোহর জেলার ফুলবাড়ি নামক গ্রামে লালনের জন্ম বলে মত দিয়েছেন এ কে এস নূর-এর মতো বিশিষ্টজন।

সম্ভবত শৈশব থেকেই লালন গান এবং ধর্মসাধনার প্রতি আকর্ষণ বোধ করতেন। জনশ্রুতি থেকে জানা যায় নিরক্ষর লালনের ভাবাবেশ ঘটলে তিনি গান গেয়ে উঠতেন, তখন উপস্থিত শিষ্যরা পদগুলি লিখে রাখতেন। পরে সেগুলি ক্রমে মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল।

বাউল ধর্মে দীক্ষা: আশ্চর্য এই মানুষটির জীবন সম্পর্কে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে যেটুকু জানা যায়, তা হল-ছোটোবেলায় তিনি বাবাকে হারান। ফলে সংসারের সকল দায়িত্ব এসে পড়ে তাঁর ওপর। এ সময় প্রতিবেশীদের সঙ্গে তীর্থভ্রমণে বেরিয়ে বসন্তরোগে আক্রান্ত হন। কিন্তু তারা তাঁকে ফেলে রেখে চলে যায়। তখন এক মুসলমান রমণী তাঁকে সেবা করে সুস্থ করে তোলেন। সুস্থ হওয়ার পর হিন্দুধর্ম তাঁকে আর গ্রহণ করেনি। এসময় সিরাজ সাঁই-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় এবং তাঁর কণ্ঠে বাউল গান শুনে লালন অভিভূত হন। এঁরই কাছে লালন বাউল ধর্মে দীক্ষা নেন। লালনের বহু গানে তাই সিরাজ সাঁইয়ের নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। এরপর ছেউরিয়াতে তিনি একটি আশ্রম গড়ে তোলেন এবং বহু হিন্দু ও মুসলমান তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে। এ প্রসঙ্গে লালনের জীবদ্দশায় ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ পত্রিকায় হরিনাথ মজুমদার লিখেছিলেন, “লালন শা নামে এক কায়স্থ আর-এক ধর্ম আবিষ্কার করিয়াছে। হিন্দু-মুসলমান সকলেই এই সম্প্রদায়ভুক্ত। তিন-চার বৎসরের মধ্যেই এই সম্প্রদায় অতিশয় প্রবল হইয়াছে। ইহারা যে জাতিভেদ স্বীকার করেন না, সে-কথা বলা বাহুল্য।”

বাউল গানে জনপ্রিয়তা ও জীবনবোধ: শিলাইদহ-কুষ্ঠিয়ার তৎকালীন জমিদার ঠাকুরবাড়ির লোকেদের কাছেও লালন ফকির বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত ছিলেন তাঁর গুণমুগ্ধ। জনশ্রুতি আছে যে, লালনের একমাত্র ছবিটি এঁকেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে সম্ভবত তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। তিনিই প্রথম ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় লালনের গান প্রকাশ করেছিলেন। তাই রবীন্দ্রসংগীতে বাউলের সুরের প্রভাব সর্বজনবিদিত। কথিত আছে বাউলের সাধনা আর আদর্শ ছড়িয়ে দিতে লালন গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াতেন। এই ‘বাউল’ শব্দের উৎপত্তি নিয়েও মতভেদ আছে। অনেকে মনে করেন ‘বাতুল’ থেকেই ‘বাউল’ শব্দের সৃষ্টি। তবে উৎস যাই হোক না কেন ‘বাউল’ সম্পর্কে ক্ষিতিমোহন সেন-এর বক্তব্যটি যথার্থ, “বহু শতাব্দী ধরিয়া জাতি-পঙ্ক্তির বহির্ভূত নিরক্ষর একদল সাধক শাস্ত্রভার মুক্ত মানবধর্মই সাধন করিয়া আসিয়াছেন। তাঁহারা মুক্ত পুরুষ, তাই সমাজের কোনো বাঁধন মানেন নাই। তবে সমাজ তাঁহাদের ছাড়িবে কেন? তখন তাঁহারা বলিয়াছেন, আমরা পাগল, আমাদের কথা ছাড়িয়া দাও, পাগলের তো কোনো দায়িত্ব নাই। বাউল অর্থ বায়ুগ্রস্ত, অর্থাৎ পাগল।” আসলে বাউল হল জীবনচর্চার এক বিশেষ পদ্ধতি। যে-কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষ সমাজের বাঁধাধরা রীতি-প্রথার বাইরে গিয়ে হৃদয়াবেগের ব্যাকুলতায় ‘মনের মানুষ’-এর সন্ধানে ব্যাপৃত হলে ‘বাউল’ আখ্যা পায়। এভাবেই লালন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের প্রচলিত বৃত্তকে ভেঙে এক নতুন পথের সন্ধান দিয়েছিলেন। তাঁর সাধনায় প্রাপ্ত ভাবাদর্শের প্রকাশ ঘটেছে গানে। জাত-ধর্ম-শ্রেণির ভেদাভেদকে ছুঁড়ে ফেলে এই মানবপ্রেমিক উদার মানবতার সাধনা করার কথা বলেছিলেন।

প্রয়াণ: সম্ভবত ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দের ১৭ অক্টোবর ছেউড়িয়ার আশ্রমে ১১৬ বছর (মতান্তরে ১১৭ বছর) বয়সে তাঁর জীবনাবসান ঘটে।

লালন শাহ্‌ ফকিরের গান কবিতার উৎস

লালনের গান দুই বাংলায় সমানভাবে জনপ্রিয়। তাঁর গান মূলত আত্মভোলা মানুষের মুখে মুখে ঘুরত। বাংলাদেশের বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও লালন-বিশেষজ্ঞ ড. আবুল আহসান চৌধুরী লালনের অসংখ্য গান নিয়ে ‘লালন সমগ্র’ নামক নির্ভরযোগ্য ও প্রামাণ্য একটি গ্রন্থ সম্পাদনা করেন। ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’ গানটি আহসান চৌধুরীর ‘লালন সমগ্র’ গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। এ ছাড়া ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত ড. মতিলাল দাশ ও পীযূষকান্তি মহাপাত্র সম্পাদিত ‘লালন-গীতিকা’ গ্রন্থের ৩৯১ সংখ্যক গান হিসেবে এটি গৃহীত হয়েছে। উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ উক্ত গানটিকে ‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’ নামে পাঠ্য কবিতা হিসেবে সংকলিত করেছে।

লালন শাহ্‌ ফকিরের গান কবিতার বিষয়সংক্ষেপ

বাউল সাধক ও মরমি কবি ফকির লালন শাহের গান মূলত আত্মতত্ত্ব, মনস্তত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, জাতিভেদ বিষয়ক যুক্তি, ব্যাখ্যা এবং সূক্ষ্ম অথচ তির্যক উপমায় উপস্থাপিত। লালনের প্রধান পরিচয় মূলত গানে। এই গানগুলি তাঁকে দুই শতাব্দী ধরে কালজয়ী করে রেখেছে। মধ্যযুগের ধর্মীয় সীমাবদ্ধতার বাইরে লালন মুক্তির পথ খোঁজার চেষ্টা করেছেন। তাঁর কণ্ঠে সুরারোপিত হয়ে তৈরি হয়েছে মানবধর্মের শ্রেষ্ঠ জয়গান। তিনি ছিলেন মানবপ্রেমের মূর্ত প্রতীক।

লালন বিশ্বাস করতেন, সৃষ্টির মাঝেই স্রষ্টা বিরাজমান। স্রষ্টা ছাড়া মানুষও পরিপূর্ণ নয়। তাই সৃষ্টি আর স্রষ্টা একে অপরের প্রতিরূপ। লালন মনে করেন, এই মানবদেহ স্রষ্টার বাসস্থান। দেহস্থিত পরমাত্মা বা আত্মাকে লালন-সংগীতে ‘মনের মানুষ’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। আত্মদর্শনকারী লালন পরমসত্তার চিরজাগ্রত রূপকে মানবগুরুর ভিতরেই খুঁজতে বলেছেন। কারণ স্রষ্টা চিরজাগ্রত মানবগুরুর ভিতরেই বাস করে জগৎজুড়ে লীলা-রহস্যের খেলায় মত্ত হয়ে আছেন। আর সেই মানুষ লালনের ভাষায় ‘সহজ মানুষ’, ‘মনের মানুষ’, ‘আলেকের মানুষ’, ‘অচিনপাখি’। লালন তাকেই ভজতে বলেছেন। তিনি মানুষের ভিতরে লুকিয়ে থাকা সেই পরমাত্মারূপে বিরাজমান মনের মানুষকেই সতত সন্ধান করেছেন এবং সাধন ভজনের জন্য গুরুতত্ত্বে একমাত্র মানুষের মুক্তির কথা বলেছেন। মানুষ হয়ে মানুষের কাছে প্রেম নিবেদন, ভালোবাসা চাওয়া ও মানুষকে ভজাটাই আসল সাধন-ভজন; আর এর মধ্য দিয়েই পরমাত্মার সন্ধান পাওয়া যাবে।

বহুকাল আগে চন্ডীদাস বলেছিলেন, “সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।” গ্রিক চিন্তাবিদ প্রোটাগোরাসের মতে, মানুষই সব কিছুর পরিমাপক। মানুষই সব কিছু নির্ধারণ করে। লালন বললেন, মানুষ ভজার মধ্য দিয়েই প্রকৃত সিদ্ধিলাভ ও আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলন হয়। তবে সত্যের পথে তাঁকে সাধন-ভজন করতে হবে, নইলে মূল হারিয়ে অমূলের আঁধারে নিমজ্জিত হতে হবে। অকূলে আর পথ পাওয়া যাবে না। লালনের সেই ‘সোনার মানুষ’ উজ্জ্বল হয়ে লুকিয়ে রয়েছে দুই পাপড়ির পদ্মে। মানুষ-গুরুর কৃপা হলে সেই মনের মানুষের স্বরূপ উপলব্ধি করা যাবে। ফকির লালন গুরুবাদী ধর্মে সাধন-ভজনের মধ্য দিয়ে মানুষের মধ্যে থাকা পরম মনুষ্যত্ববোধকে জাগ্রত করতে চেয়েছেন। মনুষ্যত্ববোধই মানবতা সৃষ্টির আধার, মানবিকতাবোধ জাগরণের উন্মুক্ত সহায়ক। তাই লালন যখন বলেন, “এই মানুষে মানুষ গাথা” তখন মনুষ্যত্ববোধের সমুজ্জ্বল ছবি স্পষ্ট হয়। তাঁর মতে, মানবতাই মানুষের মুক্তির পথ, মানুষের সাধনার চাবিকাঠি। পরজীবী উদ্ভিদ আলেকলতার মতো মানুষকে অবলম্বন করেই মানুষের স্বরূপ উপলব্ধি করতে হবে। প্রথাগত কুসংস্কার ও জাতপাত-ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে লালন প্রতিবাদ জানিয়েছেন তাঁর গানে।

মানুষ ভজনার মধ্যেই রয়েছে ফকির সাধনার মূলবস্তু। ফকির লালন তাই সামাজিক বৈষম্য ভুলে প্রেম, ভালোবাসা, সাম্যের এক আকাশের নীচে মানুষকে রাখতে চেয়েছেন। এই মানুষের বিহনে মন শূন্যতার বোধ উপলব্ধি করে। এই তিক্ত শূন্যতা মানুষের সহ্যের অতীত। লালন তাই বলেন, “মানুষ ছাড়া মন আমার / পড়বি রে তুই শূন্যকার”।

লালনের গানের মধ্যে এমন এক ধরনের অমিয় জাদু আছে যা রূপ-রস-ছন্দ নিয়ে আমাদের হৃদয় হরণ করে, আমাদের প্রচলিত মানবসমাজে শিক্ষিত, অশিক্ষিত, ভাবুক, চিন্তাশীল, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে একটা মানবিক চিন্তা-চেতনা ও মানুষ ভজার জগতে নিয়ে যায়। তাঁর গানে সাম্য, শান্তি ও মানবমুক্তির সন্ধান মেলে। লালনের কথায় “মানুষ আকার, / ভজলে তরবি।।”

লালন শাহ্‌ ফকিরের গান কবিতার গদ্যরূপ

মানুষ ভজন করলে সোনার মানুষ হওয়া যায়। মানুষকে না-ভালোবাসলে, মানুষের থেকে দূরে থাকলে স্রষ্টা থেকে বিচ্যুত হতে হয়। মানবসত্তার অন্তরালে দুই পাপড়ির পদ্মে ‘সোনার মানুষ’ উজ্জ্বলভাবে বিরাজমান। গুরুর কৃপা হলে সেই আত্মসত্তার যথার্থ উপলব্ধি সম্ভব। পরজীবী আলেক লতার মতো মানুষও মানুষের সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্কে আবদ্ধ। মস্তক মুণ্ডন করার প্রচলিত প্রথায় ‘অচিনপাখি’-কে জানার মাধ্যমে জাতে উঠে আধ্যাত্মিক স্তরে পৌঁছোনো যায়। মানুষকে ভালোবাসতে না-পারলে ‘মনের মানুষ’-কে জানার অবকাশ থাকে না। প্রতি মুহূর্তে মানুষ যে শূন্যতার বোধ উপলব্ধি করে তা ‘মনের মানুষ’-এর অভাব থেকেই। তাই লালন ফকির বলেন, মানুষকে ভালোবেসে মানবিকবোধসম্পন্ন প্রকৃত মনুষ্যত্বের অধিকারী হলে দেহের ভিতর আত্মার স্বরূপকে উপলব্ধি করা যাবে।

লালন শাহ্‌ ফকিরের গান কবিতার প্রেক্ষাপট

বাংলা বাউল সংগীতের সার্থক ও নির্ভীক স্রষ্টা লালন ফকির একবিংশ শতাব্দীতেও মানুষের মনে চির উজ্জ্বল হয়ে আছেন তাঁর অমর সৃষ্টির জন্য।

১৭৭৪ খিস্টাব্দের ১৭ অক্টোবর কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালি উপজেলার ভাঁড়ারা গ্রামে এক হিন্দু কায়স্থ পরিবারে লালন জন্মগ্রহণ করেন (যদিও লালনের জন্মস্থান ও জন্মকাল নিয়ে মতান্তর আছে)। ‘হিতকরী’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘সংবাদ’ নিবন্ধে বলা হয়েছে, যৌবনে তিনি একবার তীর্থযাত্রাকালে পথিমধ্যে গুটিবসন্ত রোগে আক্রান্ত হলে সহযাত্রীরা তাঁকে মৃত ভেবে কলার মান্দাসে জলে ভাসিয়ে দেন। কালিগঙ্গা নদীতে মুমূর্ষু লালনকে ভাসতে দেখে মলম শাহ্ ও তাঁর স্ত্রী মতিজান লালনকে উদ্ধার করেন এবং পরমযত্নে সেবা শুশ্রুষায় সুস্থ করে তোলেন। এরপর লালন তাঁর কাছে দীক্ষিত হন এবং কুষ্টিয়ার ছেউরিয়াতে স্ত্রী ও শিষ্য সহ বসবাস শুরু করেন। সেইসময় লালন বসন্তরোগে একটি চোখ হারান। ছেউরিয়াতে তিনি দার্শনিক গায়ক সিরাজ সাঁইয়ের সাক্ষাতে আসেন এবং তাঁর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বাউল সাধনায় মনোনিবেশ করেন।

লালন নিজেকে কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের গণ্ডিতে বেঁধে রাখেননি। তিনি হিন্দু না মুসলমান এ কথা জানতে চাইলে লালন বলতেন, “সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে / লালন বলে জাতের কী রূপ দেখলাম না এ নজরে।” কোনো জাত-ধর্ম-সম্প্রদায়ে লালনকে বাঁধা যায়নি। তিনি জাতিত্বের সংকীর্ণতায় আবদ্ধ থাকেননি। লালন বিশ্বাস করতেন, জাতির এবং জাতের সীমাবদ্ধতা মানুষকে অকর্মণ্য ও কুপমন্ডুক করে রাখে। তিনি বলেন, “জাত না গেলে পাইনে হরি/কি ছার জাতের গৌরব করি।” হিন্দু মুসলিম বিরোধ তাঁকে অসম্ভব যাতনা দিয়েছিল।

তাঁর মুখ্য ধর্ম মানবধর্ম। তিনি মানবতার পূজারি, অসাম্প্রদায়িক চেতনার মহাপুরুষ। তিনি দেখেছিলেন সামাজিক বৈষম্য, হিন্দু মসুলমানের ভেদাভেদ। জাতপাতে জর্জরিত সমাজব্যবস্থার মূলে তাই কুঠারাঘাত করেছেন লালন, “লালন কয় জাত হাতে পেলে / পুড়াতাম আগুন দিয়ে।” জাতের বিপক্ষে এরকম তীব্র বাণী তিনি উচ্চারণ করেছিলেন গানের মধ্য দিয়ে। নদীর জলের তো আলাদা কোনো জাত নেই, ব্রাহ্মণ, চণ্ডাল, চামার, মুচি সকলেই তো এক জলেতেই শুচি হয়। জল তো কাউকে ভেদাভেদ করে না।

মানুষকে ভালোবেসে সত্যের পথে তিনি সৃষ্টিকে খুঁজতে চেয়েছেন। তাই তো তাঁর প্রশ্ন, “খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়!” লালন-দর্শনে মানুষই মুখ্য। তাই তিনি বলেছেন, “মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।” মানুষকে ভজলেই তো পাওয়া যাবে অমূল্য নিধি, “পাবি রে অমূল্য নিধি / – পাবি বর্তমানে।” নানাবিধ ধর্মমত, প্রেম, প্রার্থনা এবং বিশ্বাস বৈচিত্র্যের সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে তাঁর গান নেমে এসেছে মানবতার ধারায়, যে ধারাতে স্নাত হয়ে শুচি-পবিত্র হয়ে উঠেছে আমাদের সমাজব্যবস্থা। দ্বন্দু-সংঘাতময় বিশ্বে এবং অবক্ষয়ে ক্ষয়িষু সমাজের মনুষ্যত্ব ও মানবিকতার অভাবই যে বড়ো সংকট, লালনের সংগীত সেই বার্তা দিচ্ছে। তাই “মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি” বাণী এখনও প্রাসঙ্গিক।

লালন শাহ্‌ ফকিরের গান কবিতার সরলার্থ

(১) “মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।”

হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ধর্মীয় উন্মাদনা, রক্তপাত, জাতিগত বিদ্বেষ, হিংসা প্রভৃতি উপমহাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে যখন চরমভাবে গ্রাস করেছিল, ঠিক সেসময়ে লালন ফকির শুধু আধ্যাত্মিক চিন্তা-চেতনা বা কিছু পদ রচনা করে ক্ষান্ত হলেন না, সমাজে ঘটে চলা নানা সমস্যা ও তার সমাধানের পথ খোঁজার চেষ্টা করছিলেন। তিনি মানবিকতার জয়গানে উদ্বুদ্ধ হয়ে নানা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন। ফকির লালন শাহ্ ব্যক্তিগত জীবনে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ বা জাতপাতের বৈষম্য মানতেন না এবং বিশ্বাসও করতেন না। মনুষ্যসৃষ্ট এইসকল বিষয়ের প্রতি লালন সর্বদা ঘৃণা প্রকাশ করেছেন। লালন মনে করতেন মানুষ বড়ো, মানুষ শ্রেষ্ঠ, মানুষই সব। মানুষের মনুষ্যত্ববোধ সমাজ-জাতপাত-বর্ণের থেকে অনেক ঊর্ধ্বে। সাম্য ও শান্তির চালিকাশক্তি হিসেবে এই মানুষকে সোনার মানুষে পরিণত করে। তাই মানুষকে ভজলে সোনার মানুষ হওয়া যায় বলে লালন সাঁই মনে করতেন।

(২) “এই মানুষে মানুষ গাথা / দেখনা যেমন আলেক লতা”

লালন ফকির রচিত ‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’ কবিতা থেকে উদ্ধৃতাংশটি গৃহীত। মানুষের সঙ্গে মানুষের আত্মিক ও আধ্যাত্মিক সম্পর্ক প্রসঙ্গে আলোচ্য উক্তিটি ব্যবহার করেছেন।

লালনের সমকালে সামাজিক নিপীড়ন, প্রতিবাদহীনতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি-কুসংস্কার, লোভ, আত্মকেন্দ্রিকতা সেদিনের সমাজ ও সমাজ বিকাশের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তিনি দেখেছিলেন, মানুষে মানুষে নানান বিভেদ, বৈষম্য। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি মানুষে মানুষে এই ভেদাভেদ, জাতপাত, বৈষম্য কিছুই মানতেন না এবং বিশ্বাসও করতেন না।

লালন বুঝেছিলেন, মানুষের সঙ্গে মানুষের আত্মিক সম্পর্কই একমাত্র এই বিভেদবৈষম্য ঘোচাতে পারে। তাই তিনি মানুষকে ভালোবাসতে শেখালেন, প্রেমের মধ্য দিয়ে মানবতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলেন। মানুষকে প্রেম করলে, ভালোবাসলে, একাত্ম হয়ে থাকলে অধরাকে অর্থাৎ পরমাত্মা মনের মানুষকে পাওয়া যায়। পরজীবী আলেক লতা যেমন অন্য বৃক্ষকে আশ্রয় করে বেড়ে ওঠে, সামাজিক মানুষও তেমনি একে অপরের প্রতি সাম্য মৈত্রী ভালোবাসার সূত্রে আবদ্ধ হয়ে থাকলে মানুষের সঙ্গে মানুষের সংযোগ গভীর হবে।

(৩) “মানুষ ছাড়া মন আমার / পড়বি রে তুই শূন্যকার”

বাউল সাধক লালন ফকির রচিত ‘লালনশাহ ফকিরের গান’ কবিতা থেকে উদ্ধৃতাংশটি গৃহীত। মানুষ বিহনে মানুষ যে শূন্যতার বোধ উপলব্ধি করে সে প্রসঙ্গ বোঝাতে কবি আলোচ্য পঙ্ক্তিটির অবতারণা করেছেন।

লালনের গানে মানুষ ও তার সমাজই ছিল মুখ্য। সব কিছুর ঊর্ধ্বে তিনি মানবতাবাদকে স্থান দিয়েছেন। লালন বিশ্বাস করতেন সকল মানুষের মাঝে বাস করে এক মনের মানুষ, যাকে ধরা যায় না, ছোঁয়াও যায় না। অন্তরে বসে সেই মানুষ সর্বদা গোপনে লীলা করছে। গুরুকে আশ্রয় করে আধ্যাত্মিক ভাবনায় তাকে উপলব্ধি করতে হয়।

মনের মানুষের কোনো জাত, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, কূল নেই। মানুষের দৃশ্যমান শরীর ও অদৃশ্য মনের মানুষ পরস্পর বিচ্ছিন্ন। লালনের এই দর্শন কোনো ধর্মীয় আদর্শের দ্বারা দীক্ষিত নয়। তিনি মনে করতেন, প্রতি মুহূর্তে মানুষ নিজের ভিতরে যে শূন্যতার বোধ উপলব্ধি করে তা আসলে মনের মানুষের বিহনে। মনের মানুষ ছাড়া সবই যেন শূন্য মনে হয়, তিক্ততায় ভরে ওঠে সব কিছু। এই তিক্ত-শূন্যতা মানুষের সহ্যের অতীত। তাই সেই শূন্যতা ভরিয়ে তুলতে মানুষ সাধন-ভজনের আশ্রয় নেয়। মানুষকে ভজলে তবেই এর থেকে মুক্তি, অলীক চিত্তসুখ লাভ। সেই চিত্তসুখ লাভ করেই রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “সীমার মাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর / আমার মাঝে তোমার প্রকাশ তাই এত মধুর।”

লালন ফকিরের প্রাপ্ত সমস্ত গানই সংখ্যাচিহ্নিত, কোনো গানের নামকরণ তিনি করেননি। পাঠ্য গানটি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত ‘লালন-গীতিকা’ গ্রন্থে ৩৯১ সংখ্যক পদ। উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ পাঠ্য গানটিকে ‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’ শিরোনামে পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এখন গানটির মূলভাবের নিরিখে প্রদত্ত নামকরণটি সংগতিপূর্ণ হয়েছে কিনা তা বিচার্য বিষয়।

বাউলের ধর্মসাধনার মূলতত্ত্বই হল মানবতাবাদ। মানবতাবাদ মূলত মনুষ্যত্ববোধের জাগরণে আত্তীকরণ হয়। মানবসত্তায় ঈশ্বরের অবস্থান। তাই মানুষকে ভজলে সোনার মানুষ হওয়া যায়। মানুষকে ভালোবাসলে ‘মনের মানুষ’-এর সন্ধান মেলে। বাউল সাধনায় এই ‘মনের মানুষ’ হল পরমাত্মা বা ঈশ্বর, দুই দলের পদ্মে মনের অন্তঃস্থল আলোকিত করে যিনি আত্মারূপে বসে আছেন। দেহের ভিতরে বাস করা ‘অচিনপাখি’-রূপী সাঁই সর্বক্ষণ সেখানে লীলা করছেন। তাঁকে জানার মাধ্যমেই আধ্যাত্মিক স্তরে উন্নীত হওয়া যায়। তাই নিজেকে চিনতে হবে। যে মানুষ নিজেকে চিনেছে সে ঈশ্বরকেও জেনেছে। তবে মানুষ-গুরুর কৃপা হলে ঈশ্বরকে জানা যায়। পরজীবী আলেক লতার মতো এই সমাজে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পৃক্ততার কথা বলেছেন লালন। সত্যের পথে সাধন-ভজনের মাধ্যমে মানবতাবাদের জাগরণ ঘটিয়ে ঈশ্বরলাভের পন্থা দেখিয়েছেন লালন তাঁর গানে।

অন্তরের মানুষের অভাবে প্রতি মুহূর্তে মানুষ শূন্যতার বোধ উপলব্ধি করে। ভিতরের মানুষের উপলব্ধির অভাবের জন্য সবই শূন্য মনে হয়। তবে সেই সহায়হীন শূন্যতা ভরিয়ে তুলতে মানুষ ভজনে ব্রতী হয়। এভাবে গভীর চিত্তসুখ লাভ করা যায়।

লালন তাঁর গানের মাধ্যমে মানবতাবাদের জয়গান গেয়েছেন। উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ কর্তৃপক্ষ সেই বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে যে শিরোনাম দিয়েছে তা যথোপযুক্ত বলেই মনে হয়।

লালন শাহ্‌ ফকিরের গান কবিতার শব্দ পরিচিতি

‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ … / মানুষ-আকার ভজলে তরবি।।’

• ভজলে: আরাধনা/স্তুতি করলে।

• সোনা: অলংকার তৈরির ধাতুবিশেষ।

• সোনার মানুষ: মানবিকবোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে ‘সোনার মানুষ’ কথাটি প্রযোজ্য হয়েছে।

• হবি: হওয়া যাবে (লালন তত্ত্বে মানুষ অতি আপন, সেই হিসেবে ‘হবি’ কথার ব্যবহার)।

• ক্ষ্যাপা: ঘরছাড়া বাউল সাধাক।

• মূল: উৎস।

• হারাবি: হারিয়ে ফেলবি।

• দ্বি-দল: দুই পাপড়ি।

• মৃণাল : পদ্ম।

• উজ্জ্বল: আলোকিত (সোনার মানুষ দুই দল পদ্ম আলোকিত করে অন্তরে আসীন)।

• গুরু: অন্ধকার থেকে আলোর পথ দেখান যিনি তিনিই গুরু।

• মানুষ-গুরু কৃপা হ’লে: লালনের মতে মানুষরূপী গুরুর কৃপা হলে ‘মনের মানুষ’-এর সন্ধান পাওয়া যায়।

আরও পড়ুন – ছুটি গল্পের প্রশ্ন ও উত্তর

একাদশ শ্রেণির কলা বিভাগের যে কোনো প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন। কোনো উত্তর না পেলে আমাদের কমেন্ট বক্সে জানান।

Leave a Comment