রেনেসাঁ পর্বে ইতিহাসচিন্তায় কী রূপান্তর ঘটে ব্যাখ্যা করো
রেনেসাঁ পর্বে ইতিহাসচিন্তায় রূপান্তর
রেনেসাঁ পর্বে ইতিহাসচিন্তায় এক বড়ো ধরনের রূপান্তর ঘটে। এইক্ষেত্রে মানবতাবাদের ভূমিকা ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
(1) রেনেসা পূর্ববর্তী ইতিহাসচিন্তা:
- ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ: মধ্যযুগে ইতিহাসচর্চা প্রধানত ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে পরিচালিত হত। চার্চ এবং ধর্মীয় গ্রন্থাবলি ছিল ইতিহাসের প্রধান সূত্র।
- যুগ বিভাজন: মধ্যযুগের পণ্ডিতেরা ইতিহাসকে দুটি পর্বে বিভক্ত করেছিলেন। এর মধ্যে প্রথম পর্বটি ছিল ভ্রান্তি বা অজ্ঞানতার পর্ব এবং দ্বিতীয় পর্বটি সত্য উপলব্ধি বা জ্ঞানালোকের পর্ব। এই দুই পর্বের বিভাজনরেখায় ছিলেন জিশু ও তাঁর ক্রুশ।
- প্রাচীন যুগের ধারণা: মধ্যযুগের তাত্ত্বিকরা মনে করতেন যে, প্রাচীন যুগ ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন। এই যুগের জীবনধারা ও ভাবনাচিন্তা ছিল ভুলভ্রান্তিতে আকীর্ণ। প্যাগানবাদ (Paganism) ছিল এই ভুলভ্রান্তির উৎস।
- নবযুগের আবির্ভাব : মহান জিশুর আবির্ভাব এবং খ্রিস্ট ধর্মের প্রচার সেই তমসাচ্ছন্ন যুগের অবসান ঘটায় এবং আলোকোজ্জ্বল নবযুগের আবির্ভাব হয়। বলাবাহুল্য, এই সকল পণ্ডিতদের দূরদর্শিতার অভাব ছিল। কারণ, তাঁরা খ্রিস্টের আবির্ভাব পূর্ববর্তী কোনও মহত্তর ঐতিহাসিক পর্বের কথা ভাবতে পারেননি। তাঁরা মনে করতেন যে, কালের পথ ধরে তাঁদের এই যুগই অন্তিম যুগ (The Final Period of World History) |
(2) রেনেসা পূর্বে পরিবর্তন: রেনেসাঁ পর্বে মানুষের চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গিতে যে পরিবর্তন আসে, তা ইতিহাসচিন্তায় রূপান্তর ঘটায়।
- ধর্মীয় প্রভাব মুস্ত্র: এই পর্বে ইতিহাসচর্চার উপর ধর্মীয় ভাবনার প্রভাব মুছে ধর্মনিরপেক্ষতার ভাবাদর্শ অনুসৃত হয়। ঐশ্বরিক ইচ্ছার ফলরূপে নয়, কার্যকারণের পরিণতি হিসেবে ঘটনার ব্যাখ্যা করা হতে থাকে।
- যুগ বিভাজন: মানবতাবাদীদের মতে, প্রাচীন যুগ ছিল ধ্রুপদি ও সুবর্ণময় যুগ। পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের পতনের সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার যুগের সূচনা হলেও, চতুর্দশ শতকে এর অবসান ঘটে এবং আধুনিক যুগের সূচনা হয়, যা ছিল ধর্মনিরপেক্ষ ও যুক্তিবাদী।
- মানুষাক গুরুত্ব প্রদান: রেনেসাঁ পর্বে মানব অভিজ্ঞতা ও বুদ্ধির উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপিত হয়। ফলে ইতিহাসচর্চা মানুষের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের উপর মনোযোগ দিতে শুরু করে।
- বিজ্ঞান ও যুক্তির উদ্ভব: এই সময় বৈজ্ঞানিক চিন্তার উদ্ভব ঘটলে ইতিহাসচর্চায় বিশ্লেষণ ও সমালোচনার নতুন ধারার উদ্ভব ঘটে। ইতিহাসবিদরা অতীতের ঘটনা ও ব্যক্তিত্বদের তাঁদের সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ করতে শুরু করেন, যা যুক্তিনিষ্ঠ ও বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাসচর্চার সূচনা করে। তাছাড়া এসময় অতীত ঘটনার তাৎপর্য নিরূপণ করে বর্তমানের ঘটনাবলির ব্যাখ্যার প্রয়াস দেখা দেয়। মধ্যযুগীয় পণ্ডিতদের মতের বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে রেনেসাঁ মানবতাবাদীগণ ঐতিহাসিক যুগচেতনার নতুন ব্যাখ্যা দেন। যেভাবে তাঁরা চিরাচরিত ইতিহাসচর্চাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন তার গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
- প্রাচীন গ্রিক ও রোমান চিন্তার পুনরুজ্জীবল: নবজাগরণের সময়ে প্রাচীন গ্রিকো-রোমান সাহিত্য, দর্শন এবং ইতিহাসের পুনরাবিষ্কার করা হয়। এই সময়ের ঐতিহাসিকরা প্রাচীন লেখকদের রচনা পাঠ করেন ও তাঁদের ইতিহাস লিখন পদ্ধতি অনুসরণ করতে শুরু করেন। এই ঘটনা অতীতের বিষয়গুলিকে বিশ্লেষণ করার সময় বস্তুনিষ্ঠতা ও যুক্তি ব্যবহার করতে উৎসাহিত করেছিল।
রাজনীতির প্রভাব: আলোচ্য পর্বে ইউরোপের রাজনৈতিক-সামাজিক কাঠামোতে যে পরিবর্তন সংঘটিত হয় তা প্রভাবিত করে ইতিহাসচর্চার বিষয়বস্তুকেও। রাজতন্ত্র, সামন্ততন্ত্র, ধর্মের বদলে জাতীয়তাবাদ ও আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার উত্থান ইতিহাসচর্চার এক নতুন ধারার সূচনা করে।
আরও পড়ুন – রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রশ্ন উত্তর