রেনেসাঁ পর্বের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বিকাশে মেডিচি পরিবারের ভূমিকা লেখো
ফ্লোরেন্সকে ইতালীয় রেনেসাঁর আদিভূমি বলা হয়। ক্রুসেড পরবর্তীকালে প্রাচ্যের সঙ্গে সরাসরি ব্যাবসাবাণিজ্যকে কেন্দ্র করে বিপুল অর্থাগম হওয়ায় ফ্লোরেন্স এই সময় ইউরোপের সর্বাপেক্ষা বৃহৎ ব্যাংকিং কেন্দ্রে (Banking Centre) পরিণত হয়েছিল। এই ফ্লোরেন্স নগরের সর্বাপেক্ষা ধনী ব্যাংকিং পরিবার হল মেডিচি পরিবার (House of Medici)। বিপুল ধনসম্পদের অধিকারী এই মেডিচিরা ১৪২০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ পোপের ব্যাংকার (Official Papal Banker) হিসেবে কাজ করতে শুরু করে। পোপ দশম লিও (Pope Leo X), পোপ সপ্তম ক্লিমেন্ট (Pope Clement VII), পোপ চতুর্থ পায়াস (Pope Pius IV), পোপ একাদশ লিও (Pope Leo XI), ফ্রান্সের সম্রাজ্ঞী ক্যাথরিন (Catherine de Medici) এবং মেরি (Marie de Medici) এই পরিবারেরই সদস্য ছিলেন।
রেনেসাঁ পর্বের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বিকাশে মেডিচি পরিবারের ভূমিকা
রেনেসাঁ পর্বে ফ্লোরেন্সের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বিকাশে মেডিচি পরিবারের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কসিমো দ্য মেডিচি (Cosimo de Medici)-র সময় থেকেই ফ্লোরেন্সের কর্তৃত্ব ছিল মেডিচি পরিবারের হাতে। ফলে তাঁদের উদারতা ও সংস্কৃতিমনস্কতা ফ্লোরেন্সকে নবজাগরণের উৎসকেন্দ্রে উত্থিত করে।
(1) শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা: মেডিচি পরিবারের সদস্যরা আন্তরিকভাবে মানবতাবাদীদের শিল্পকর্মে পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। তাঁদের অর্থানুকূল্যেই মাইকেল এঞ্জেলো, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, রাফায়েল, দোনাতেল্লো, ম্যাসাচিও, বুনেলেস্কি প্রমুখ শিল্পী বিভিন্ন কালজয়ী চিত্র, ভাস্কর্য ও স্থাপত্য সৃষ্টি করেছিলেন। ১৪৬৪ খ্রিস্টাব্দের একটা হিসাব থেকে দেখা গেছে যে, কসিমো দ্য মেডিচি তাঁর সময়কালে আনুমানিক ৬ লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা (Gold Florins) শিল্পকর্মের পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যয় করেছিলেন। আবার লরেঞ্জো দ্য মেডিচি (Lorenzo de Medici)-র অর্থানুকূল্যে বত্তিসেল্লি বার্থ অফ ভেনাস (Birth of Venus) নামক জীবনমুখী চিত্র অঙ্কন করে চিত্রাঙ্কনের ইতিহাসে এক নবযুগের সূচনা করেন। সেন্ট পিটার ব্যাসিলিকা (Saint Peter’s Basilica), সেন্ট মেরি ক্যাথিড্রাল (Cathedral of Saint Mary)-এর ডোম-সহ বহু চার্চ নির্মাণেও মেডিচিদের সহায়তার কথা জানা যায়।
(2) বিজ্ঞানচেতনার প্রসারে ভূমিকা: শুধুমাত্র শিল্প-স্থাপত্য নয়, বিজ্ঞানচেতনার প্রসারেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করে মেডিচি পরিবার। এই পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতাতেই গ্যালিলিও গ্যালিলি তাঁর জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত গবেষণা করে বৃহস্পতির চারটি উপগ্রহ আবিষ্কার করেছিলেন। তাই মেডিচি পরিবারের সদস্যদের নামেই তিনি প্রাথমিকভাবে বৃহস্পতির চারটি উপগ্রহের নামকরণ করেন।
(3) প্লেটো অ্যাকাডেমি তৈরিতে সাহায্য: গ্রিসের এথেন্সের প্লেটোর অ্যাকাডেমির আদর্শে ফ্লোরেন্সে ১৪৪৫ খ্রিস্টাব্দে মার্সিলিও ফিচিনো (Marsilio Ficino) প্লেটো অ্যাকাডেমি (Platonic Academy) গড়ে তোলার সময় কসিমো দ্য মেডিচি তাঁকে সবরকম সাহায্য করেছিলেন।
(4) মেডিচি পোপদের পৃষ্ঠপোষকতা: রোমে মেডিচি পোপরাও পৃষ্ঠপোষকতা করতেন শিল্পীদের। পোপ দশম লিও রাফায়েলকে বিভিন্ন চিত্র আঁকার কাজে নিযুক্ত করেন। পোপ সপ্তম ক্লিমেন্ট মাইকেল এঞ্জেলোকে সিস্টিন চ্যাপেলের বিভিন্ন ফ্রেসকো আঁকার দায়িত্ব দিয়েছিলেন।
(5) শিল্প সংগ্রাহক: মেডিচি পরিবারের সদস্যরা শিল্প সংগ্রাহক হিসেবেও প্রসিদ্ধ ছিলেন। বর্তমানে তাঁদের সংগ্রহগুলি ফ্লোরেন্সে বিভিন্ন জাদুঘরে (যেমন- উফিজি জাদুঘর) সংরক্ষিত রয়েছে।
মূল্যায়ন
এইভাবেই মেডিচি পরিবারের সদস্যরা সর্বতোভাবে মানবতাবাদীদের সহায়তা করে ফ্লোরেন্সে নবজাগরণের পথকে মসৃণ করেছিলেন। তাই অনেকসময় তাঁদের Godfather of Renaissance বলেও অভিহিত করা হয়।
আরও পড়ুন – রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রশ্ন উত্তর