দ্বিশত জন্মবর্ষে রাধানাথ শিকদার প্রবন্ধ রচনা – আজকের পর্বে দ্বিশত জন্মবর্ষে রাধানাথ শিকদার প্রবন্ধ রচনা আলোচনা করা হল।
দ্বিশত জন্মবর্ষে রাধানাথ শিকদার প্রবন্ধ রচনা
ভূমিকা
বিদেশী শাসকের কষাঘাতে যখন ভারতীয় শিক্ষা – সংস্কৃতি জ্ঞান – বিজ্ঞান গভীর অমিস্রায় নিমগ্ন তখন সংস্কারের বাধা এড়িয়ে নব্য শিক্ষিত কিছু তরুন পাশ্চাত্য চাকচিক্যে আকর্ষিত হয়ে চেষ্টা শুরু করলেন অজানাকে জানতে ও নতুন নতুন তথ্য উদ্ভাবন করতে। বিজ্ঞানের বিভিন্ন দিকের যেমন দ্বার উদ্ঘাটন করলেন বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু, মেঘনাথ সাহা, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, সত্যেন বসু আরও অনেকে তেমনি অঙ্কশাস্ত্রে ত্রিকোণমিতির নতুন নতুন সূত্র উদ্ভাবন করে নিজ প্রতিভার পরিচয় দিলেন রাধানাথ শিকদার।
জন্ম ও শিক্ষাজীবন
রাধানাথ শিকদারের জন্ম কলকাতার জোড়াসাঁকো অঞ্চ লে এক দরিদ্র পরিবারে। তাঁর বিদ্যারম্ভ হয় ‘ফিরিসি’ কমল বসুর পাঠশালায়, তাঁর জন্ম ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে। মাত্র এগারো বছর বয়সে ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু কলেজে (প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) শিক্ষালাভ করেন। তিনি ছিলেন খুব মেধাবী ছাত্র। ছাত্রবৃত্তির টাকায় তাঁর পড়াশোনা সম্ভব হয়। তিনি শিক্ষক লুই ভিভিন ডিরোজিও এবং ডঃ জন টাইটলারের সান্নিধ্য লাভ করেন এবং মেধার গুনে তাঁদের স্নেহের পাত্রে পরিণত হন এবং পাশ্চাত্য যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞান-চেতনায় আকৃষ্ট হন। আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে বাধ্য হন ছাত্র-জীবনের সমাপ্তি করতে।
কর্মজীবন
প্রায় ঊনিশ বছর বয়সে ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে মাসিক ত্রিশ টাকা বেতনে ভারতের ‘গ্রেট ত্রিকোণোমিতিক সারভিস’ (Great Trigonometic Ser- vice) বিভাগে জরিপ সহকারীর চাকুরিতে যোগ দেন। তাঁর কাজের দক্ষতা দৃষ্টি আকর্ষণ করল নিয়োগকর্তা জর্জ এভারেষ্টের। তিনি ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই অক্টোবর তাঁকে উচ্চতর পদ ‘কম্পিউটার’-এ নিযুক্ত করে দেরাদুনের পাহাড়ি অঞ্চ লের জরিপের কাজের জন্য পাঠালেন। রাধানাথ জরিপের কাজের সুবিধার জন্য ত্রিকোনোমিতির নতুন নতুন তথ্য উদ্ভাবন করতে থাকলেন।
এছাড়া জ্যোতির্বিজ্ঞানের বেশ কিছু প্রয়োগ সূত্রও তিনি আবিষ্কার করলেন। তাঁর কাজের দক্ষতা দেখে তাঁকে নেটিভ ম্যাজিস্ট্রেটের পদ দেওয়া হয়। এই সময় সার্ভে বিভাগের দাায়িত্ব গ্রহণ করেন কর্নেল ওয়াধ। রাধানাথের কর্মদক্ষতায় ওয়াধ তাঁকে না ছেড়ে অধিক বেতনে সার্ভে বিভাগে রেখে দিলেন এবং ১৮৫১-৫২ খ্রিস্টাব্দের দিকে তিনি কলকাতায় বদলি হয়ে এলেন হেড অফিসে ছয় শত টাকা মাসিক বেতনে। এখান থেকে তাঁকে পাঠান হয় উত্তর ভারতে গিরিশৃঙ্গগুলির অবস্থান ও উচ্চতা পরিমাপের জন্য। তিনি ১৫নং গিরিশৃঙ্গ’কে পৃথিবীর সর্বোচ্চ গিরিশৃঙ্গ যে তা ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে আবিষ্কার করলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল যে এই গিরি শৃঙ্গের নাম তাঁর নামে না করে জর্জ এভারেষ্টের নামে ‘এভারেষ্ট’ এই বলে চিহ্নিত হল। এভারেষ্টের উচ্চতা পরিমাপের কৃতিত্ব রাধানাথেরই। তিনি বদলি হয়ে কলকাতায় হলেন আবহাওয়া অফিসের সর্বময় অধিকর্তা হিসাবে।
সমাজ সেবামূলক কাজ
তিনি তাঁর পেশাগত কাজের বাইরে দেশের শিক্ষা বিস্তারের জন্য ‘ফ্রি স্কুল’ আন্দোলনে যোগ দিলেন। ডিরোজিওর শিক্ষাদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে নারী শিক্ষার জন্য সক্রিয় হলেন। তিনি সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়ে ‘মাসিক পত্রিকা’ (১৮৫৪-৫৬খ্রিঃ) প্রকাশ করলেন। গরিবদের সাহায্য করার জন্য ‘The District Charitable Society of Calcutta’ নামে সংস্থার সদস্য হলেন সূচনা কাল থেকে। যুক্ত হলেন বাল্য বিবাহ বিরোধী আন্দোলনে।
প্রয়ান
রাধানাথ চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর প্রয়ান ঘটে ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দের ১৭ই মে মাত্র সাতান্ন বছর বয়সে হুগলির ফরাসি অধিকৃত চন্দননগরে নিজ বাসভবনে।
উপসংহার
রাধানাথ শিকদার ছিলেন একজন বিরল প্রতিভার অধিকারী। তাঁর আদর্শ, দেশপ্রেম প্রভৃতি বর্তমান প্রজন্মের নিকট তুলে ধরা খুবই প্রয়োজন। তাঁর জন্মের পরে প্রায় দু’শত বছর অতিবাহিত হল। কর্ম দ্বারা তিনি আজও অমর হয়ে আছেন মানুষের মনে।