রক্তদান জীবনদান – মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
ভূমিকা
"তুমি মাটির দিকে তাকাও সে প্রতীক্ষা করছে তুমি মানুষের হাত ধরো সে কিছু বলতে চায়"-
মানুষ আদিম যুগ অতিক্রান্ত হয়ে আধুনিক জীবনে পদার্পণ করেছে। সামাজিক বোধের কারণে পারস্পরিক সহযোগিতায় সুন্দর পরিবেশে আমরা সার্থকভাবে বেঁচে থাকতে পারি। ‘সকলের তরে সকলে আমরা’-এই শুভ বোধের জাগরণেই আমরা একে অপরের ওপর নির্ভর করি। সারা পৃথিবীর আর্ত মানুষ যেন তারই সমব্যথী মানুষের দিকে চেয়ে থাকে। ভালোবাসা, সহমর্মিতা, শুভচেতনার চিত্রধারায় সমাজ হয়ে ওঠে অনিন্দ্যসুন্দর। ক্ষুধার্তকে অন্নদান, তৃষ্ণার্তকে জলদান, বস্ত্রহীনকে বজ্রদান, আশ্রয়হীনকে আবাস দানের মতোই আজকের ব্যস্ততম দিনে রক্তদান আমাদের নৈতিক কর্তব্য ও দায়িত্ব।
শরীরে রক্তের গুরুত্ব
রক্ত আমাদের প্রাণের উৎস, রক্তই জীবন। মানুষ যে খাদ্য গ্রহণ করে তা বিপাক-পরিপাকের মাধ্যমে রক্তে পরিণত হয় আর সেই রক্ত আমাদের সমস্ত শরীরে সঞ্চালিত হয়ে জীবদেহকে চলমান রাখে। রক্তের মাধ্যমেই দূষিত পদার্থ, বিভিন্ন খনিজ লবণ, অতিরিক্ত অপ্রয়োজনীয় জল যেমন শরীর থেকে বেরিয়ে যায় তেমনি অন্যদিকে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, শরীরের জলসাম্য নিয়ন্ত্রণ, বাইরের জীবাণু প্রবেশে বাধা দান, অক্সিজেন সরবরাহে প্রয়োজনীয় ভূমিকা গ্রহণ করে। এককথায় রক্ত না-থাকলে জীবকুল বাঁচতে পারে না, রক্ত আমাদের সুস্থ, সবল ও কর্মক্ষম রাখে।
রক্তদানের প্রয়োজনীয়তা
রক্তদানের আরেক নাম জীবনদান। বিভিন্ন কারণে মানবশরীরে রক্ত দেওয়ার সমূহ প্রয়োজন হয়ে পড়ে-কখনও কঠিন অসুখের জন্য, কখনও অস্ত্রপ্রচারের জন্য, আবার কখনও বা কোনো দুর্ঘটনার কারণে রক্তপাত হলে রক্তদান আবশ্যিক হয়ে পড়ে। এই সমস্ত ক্ষেত্রে সঠিক সময়ে রক্ত দেওয়া গেলে জীবনসংশয়ের অবসান হয়। বিজ্ঞানীদের গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্ত থেকে জানা যায়, মানুষের শরীরে অন্য কোনো জীবের রক্ত দেওয়া সম্ভব নয়। তাই মানুষকেই তো মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে রক্তদানের মহৎ যজ্ঞে।
অনেকক্ষেত্রেই দেখা যায় প্রয়োজনীয় রক্তটুকুর অভাবে কত প্রাণ নিভে যায়-এ দুর্ভাগা দেশে রক্তের অভাবে কত বিপন্ন মানুষ পৃথিবী থেকে বিদায় নেয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। থ্যালাসেমিয়া, লিউকোমিয়ার মতো দুরারোগ্য ব্যধিতে কত শতসহস্র শিশুর অকালমৃত্যু ঘটে তাও হয়তো আমাদের জানা নেই। চিকিৎসাব্যবস্থা আধুনিক থেকে অতিআধুনিক পর্যায়ে উন্নত হলেও আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে এখনও পর্যন্ত পর্যাপ্ত রক্তভান্ডার (Blood Bank) নির্মিত হয়নি।
রক্তদান শিবিরের আয়োজন
রক্তদানের মহৎ কার্যে আজকের সমাজ ইতিবাচক ভূমিকা গ্রহণ করে। তাই আমরা দিকে দিকে রক্তদান শিবিরের আয়োজন দেখতে পাই। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে, গঞ্জে-শহরে বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠনের বা ক্লাবের উদ্যোগে এবং সরকারি প্রয়াসেও রক্তদান শিবিরের আয়োজন করা হয়। রক্তদানের গুরুত্ব সম্পর্কে আজ সকলেই অবহিত। একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে রক্তদানের প্রয়োজনীয়তা আমাদের পৌঁছে দিয়েছে এই মানবিক কর্মসাধনায়।
আমরা জানি, মানব শরীরের রক্তে চারটি শ্রেণি রয়েছে ‘A’, ‘B’, ‘AB’, ‘O’। ‘AB’ শ্রেণির রক্তকে সর্বজনীন গ্রহীতা এবং ‘০’ শ্রেণির রক্তকে সর্বজনীন দাতা বলা হয়। কিন্তু আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে মানবশরীরে রক্ত দেওয়ার সময় সরাসরি নির্দিষ্ট বিভাগের রক্তই দেওয়া হয়। এ কারণেই রক্তদান শিবিরের প্রয়োজনীয়তা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে।
উপসংহার
আমাদের দেশে প্রয়োজনের তুলনায় রক্ত সংগ্রহের পরিমাণ অনেকটাই কম। তাই রক্তদানের মহৎ সেবায় সমাজের সকলকেই এগিয়ে আসতে হবে। রক্তদানের ফলে শরীরের কোনো ক্ষতি হয় না-এই সারসত্যটি সকলকে বুঝতে হবে এবং সমাজে প্রচার করতে হবে। বৃহত্তর মানবসমাজের কল্যাণসাধনায় রক্তদানের মতো সুমহান কর্মযজ্ঞ আর নেই। দিক থেকে দিগন্তে ‘রক্ত দিন প্রাণ বাঁচান’ এই মর্মকথাটি যদি সঠিকভাবে ছড়িয়ে দেওয়া যায় তাহলে রক্তের অভাবে কোনো অকালমৃত্যু আমাদের হয়তো আর দেখতে হবে না। আমরা সেদিন প্রকৃত অর্থেই উচ্চারণ করতে পারব-
“পরের জন্য আত্মবিসর্জন ভিন্ন পৃথিবীতে স্থায়ী সুখের মূল্য নাই।”
আরও পড়ুন –
১। পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা
২। পরিবেশ রক্ষায় অরণ্য – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা
৩। পরিবেশ বনাম উন্নয়ন – মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
৪। বিশ্ব উষ্ণায়ন – মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
৫। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ – মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
৬। মানবজীবনে পরিবেশের প্রভাব – মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
৭। বিজ্ঞানচেতনার প্রসারের প্রয়োজনীয়তা – মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
৮। বিজ্ঞানচেতনা ও কুসংস্কার – মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
৯। কম্পিউটার ও আধুনিক জীবন – মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
১০। খেলাধুলার প্রয়োজনীয়তা – মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা