ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রচিন্তা অনুসারে রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য এবং শ্রেণিবিভাগ সম্পর্কে আলোচনা করো
ইউরোপে নবজাগরণের সময়কালের একজন বিখ্যাত কূটনীতিজ্ঞ, দার্শনিক তথা রাষ্ট্রচিন্তাবিদ ছিলেন নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি। তিনি রাষ্ট্র সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে, ধর্ম ও নীতিবোধের ঊর্ধ্বে উঠে নিজ রাষ্ট্রতত্ত্বের উপস্থাপনা করেন। তাঁর তত্ত্বে রাষ্ট্রের নানান বৈশিষ্ট্যগুলি যেমন আলোচিত হয়েছে, তেমনই রাষ্ট্রের বিভিন্ন শ্রেণিবিভাগ সম্পর্কেও বর্ণনা করা হয়েছে।
রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য
রাজনৈতিক সাহিত্যে রাষ্ট্র বা State পরিভাষাটির সংযোজনকে অনেকে ম্যাকিয়াভেলির সবচেয়ে বড়ো অবদান বলে মনে করেন। তাঁর মতে, রাষ্ট্র কোনও বিমূর্ত ধারণা নয়, বরং উদীয়মান সমাজের রাজনৈতিক-সাংগঠনিক প্রয়োজন রাষ্ট্রের মধ্য দিয়ে মূর্ত হয়েছে। ম্যাকিয়াভেলির রাজনৈতিক তত্ত্বের মধ্যে থেকে রাষ্ট্রের যে যে বৈশিষ্ট্যগুলি সম্পর্কে জানা যায়, তা হল-
রাষ্ট্রক্ষমতা: রাষ্ট্রক্ষমতা হল ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রদর্শনের মূল বিষয়। দ্য প্রিন্স গ্রন্থে তিনি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল, সংরক্ষণ ও প্রয়োগের উপর সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছেন।
জীবন ও ব্যক্তিগত সম্পত্তি সংরক্ষণ: ম্যাকিয়াভেলি মনে করেন যে, মানুষের জীবন ও ব্যক্তিগত সম্পত্তি সংরক্ষণ হল রাষ্ট্র ও সরকারের উৎপত্তির মূল কারণ।
ধর্মনিরপেক্ষতা: তাঁর মতে, রাষ্ট্রকে চার্চ ও ঈশ্বরের সঙ্গে সম্পর্কহীন এবং সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ হতে হবে।
ক্ষমতাবৃদ্ধির প্রচেষ্টা: রাষ্ট্র সবসময়ই নিজ ক্ষমতাবৃদ্ধির প্রচেষ্টায় নিয়োজিত থাকে এবং এখানে নীতিবোধের কোনও স্থান থাকে না।
সরকারের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি: সরকারের লক্ষ্য হওয়া উচিত জনগণের জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা প্রদানের মধ্য দিয়ে নিজ জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করা।
প্রশাসনে জনসাধারণের অংশগ্রহণ: রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল জনসাধারণ। জনসাধারণ যে রাষ্ট্রে প্রশাসনিক কাজে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়, ম্যাকিয়াভেলির মতে, সেই রাষ্ট্রই হল শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্র।
ভালো আইন ও সেনাবাহিনী: রাষ্ট্রের ভিত্তি সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য ভালো আইন ও কার্যকরী সৈন্যবাহিনী গঠন করা উচিত।
মানুষের ভূমিকা: মানুষ মূলত নিজের স্বার্থসিদ্ধি ও নিরাপত্তা রক্ষার প্রয়োজনেই রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে স্বাগত জানায়।
রাষ্ট্রের শ্রেণিবিভাগ
অ্যারিস্টটলের অনুসরণে ম্যাকিয়াভেলি যে তিন ভাগে রাষ্ট্র ও সরকারকে ভাগ করেছেন, সেগুলি হল- রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র ও নিয়মতান্ত্রিক গণতন্ত্র বা প্রজাতন্ত্র।
রাজতন্ত্র
ম্যাকিয়াভেলি তাঁর দ্য প্রিন্স গ্রন্থে কীভাবে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়, কীভাবে শাসককে সফল ও সুপ্রতিষ্ঠিত করা যায় সে সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।
- বংশানুক্রমিক শাসন: ম্যাকিয়াভেলির মতে, বংশানুক্রমিক শাসনে অনায়াসে রাজার আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। কারণ- রাজপরিবারের প্রতি জনগণের আনুগত্য অভ্যাসে পরিণত হয়।
- রাজপদে অধিষ্ঠিত হওয়ার উপায়: একজন সাধারণ ব্যক্তি তিনটি উপায়ে রাজপদে অধিষ্ঠিত হতে পারেন। যথা- বল প্রয়োগ করে বা যুদ্ধ করে, ছল-চাতুরির মাধ্যমে বা দুর্বৃত্ততার সাহায্যে এবং সহ-নাগরিকদের সমর্থন ও সহযোগিতায়।
- রাজাকে সুরক্ষা প্রদান: ম্যাকিয়াভেলি রাজতন্ত্রকে সাহসী, দৃঢ় ও শৌর্যবীর্যসম্পন্ন রূপে দেখতে চেয়েছেন। তিনি বলেছেন, রাজার প্রধান দায়িত্ব হল রাজ্যকে সুরক্ষিত রাখা। এক্ষেত্রে তিনি যে পন্থাগুলির উল্লেখ করেছেন, তা হল- বল প্রয়োগ করা: যে-কোনো উপায়ে রাজপদে বসার পর রাজার কাজ হবে বল প্রয়োগের মাধ্যমে রাজ্যশাসনের ভিত্তিকে সুদৃঢ় করা। ছলচাতুরীর আশ্রয় নেওয়া: ম্যাকিয়াভেলির মতে, রাজা প্রয়োজনে ছলচাতুরী ও শঠতার আশ্রয় নেবে।
- রাজার গুণাবলি: ম্যাকিয়াভেলি মনে করেন, জনগণের কাছে নিজ ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বেশকিছু গুণাবলি শাসককে অর্জন করতে হয়। যেমন- রাজার সবচেয়ে বড়ো গুণ হল যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শিতা, সামরিক সংগঠন ও শৃঙ্খলা সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করা। রাজাকে নিজের কাজের মধ্যে সাহস, দৃঢ়তা ও বীরত্ব দেখাতে হবে। রাজা নিরপেক্ষ হবেন না, পরিস্থিতি অনুযায়ী শত্রুতা বা মিত্রতার পথ তিনি বেছে নেবেন। রাজা বিনা কারণে সহৃদয় বা দয়ালু হবেন না। জনগণকে ভীত ও সন্ত্রস্ত রাখাই শাসকের আনুগত্যলাভের একমাত্র পথ। শাসক তাঁর প্রভুত্ব বজায় রাখার জন্য আইনের বিধান মেনে যেমন শাসন করবেন, তেমনই বলপ্রয়োগের মতো (বিশেষত অসৎ মানুষের ক্ষেত্রে) পাশবিক পন্থাও অবলম্বন করবেন।
অভিজাততন্ত্র
ম্যাকিয়াভেলির দৃষ্টিতে, অভিজাততন্ত্র সমাজের একটি ঐতিহ্যগত শাসনব্যবস্থা যেখানে ক্ষমতা কিছু প্রভাবশালী পরিবার বা ব্যক্তিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। তিনি মনে করতেন, অভিজাতরা প্রায়শই নিজেদের স্বার্থকে সাধারণ মানুষের স্বার্থের উপরে স্থান দেয়, যা সমাজে অসাম্য ও অন্যায়ের জন্ম দেয়। তাই, তিনি এই ধরনের শাসনব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন এবং বলেছেন যে, ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখা রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতার জন্য জরুরি।
প্রজাতন্ত্র
ম্যাকিয়াভেলি তাঁর দ্য ডিসকোর্সেস গ্রন্থে প্রজাতন্ত্র সম্পর্কে নিজ ভাবনা ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন যে, রাজতন্ত্র অপেক্ষা প্রজাতন্ত্রেই মানুষের স্বার্থ ও ব্যক্তিস্বাধীনতা বেশি সুরক্ষিত থাকে।
(a) প্রজাতান্ত্রিক ব্যবস্থার শ্রেণিবিভাগ ম্যাকিয়াভেলি দুধরনের প্রজাতন্ত্রের কথা বলেছেন। যেমন- (i) অভিজাততান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র ও (ii) জনগণের প্রজাতন্ত্র। তবে ম্যাকিয়াভেলির প্রজাতন্ত্রের ধারণার সঙ্গে আধুনিক প্রজাতন্ত্রের ধারণা মেলে না। তাঁর মতে, রাজাই হলেন প্রজাতন্ত্রের সৃষ্টিকর্তা।
- (i) অভিজাততান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র: রাজা যখন অভিজাতদের উপর নির্ভর করে শাসন পরিচালনা করেন, তখন তা হল অভিজাততান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র।
- (ii) জনগণের প্রজাতন্ত্র: রাজা যখন শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতা ও দায়িত্ব সাধারণ জনগণের উপর অর্পণ করেন, তখন তা হল জনগণের প্রজাতন্ত্র। এই ব্যবস্থার উদাহরণ হিসেবে তিনি প্রজাতান্ত্রিক রোমের কথা উল্লেখ করেছেন।
(b) প্রজাতান্ত্রিক ব্যবস্থার শ্রেষ্ঠত্ব: ম্যাকিয়াভেলি জনগণের প্রজাতন্ত্রকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। তিনি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে মুক্ত রাষ্ট্র বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর মতে, প্রজাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা হল সব ধরনের শাসনব্যবস্থার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। এক্ষেত্রে জনগণের কণ্ঠই হল ঈশ্বরের কণ্ঠ।
সরকারের শ্রেণিবিভাগ করলেও ম্যাকিয়াভেলি মনে করেন, রাজতান্ত্রিক বা প্রজাতান্ত্রিক সরকার কোনও ক্ষেত্রেই সামাজিক অগ্রগতি অব্যাহত থাকে না। তাই তাঁর মতে, রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র ও প্রজাতন্ত্র -এই তিনটি শাসনের মিশ্র শাসনব্যবস্থা সবচেয়ে কার্যকরী।
আরও পড়ুন – রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রশ্ন উত্তর