মৌলিক অধিকারের অর্থ ও প্রকৃতি, নির্দেশমূলক নীতি ও কর্তব্যসমূহ প্রশ্ন উত্তর Class 11 Second Semester WBCHSE

সূচিপত্র

মৌলিক অধিকারের অর্থ ও প্রকৃতি, নির্দেশমূলক নীতি ও কর্তব্যসমূহ প্রশ্ন উত্তর Class 11 Second Semester WBCHSE

মৌলিক অধিকারের অর্থ ও প্রকৃতি, নির্দেশমূলক নীতি ও কর্তব্যসমূহ প্রশ্ন উত্তর
মৌলিক অধিকারের অর্থ ও প্রকৃতি, নির্দেশমূলক নীতি ও কর্তব্যসমূহ প্রশ্ন উত্তর

১। অধিকারের সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করো

অধিকারের সংজ্ঞা: মানুষ সাধারণত সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে বাস করতে চায়, আর সেইসঙ্গে চায় তার ব্যক্তিত্বের পূর্ণতম বিকাশ সাধন করতে। কিন্তু সুখী জীবনযাপন করার জন্য বা ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য এমন কিছু সুযোগসুবিধা মানুষের থাকা দরকার যেগুলি তার পক্ষে একান্তভাবেই অপরিহার্য। কারণ, সেগুলি ছাড়া তার ব্যক্তিত্ব বিকাশ সম্পূর্ণ হয় না। ব্যক্তিত্ব বিকাশের উপযোগী বাহ্যিক এই সুযোগসুবিধাগুলিই হল অধিকার।

অধিকারের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বিভিন্ন রাষ্ট্রচিন্তাবিদ তাঁদের বক্তব্য রেখেছেন-

  • অ্যারিস্টট্ট্ল: অ্যারিস্টটলের মতে, মানুষ হল প্রকৃতিগতভাবে সমাজবদ্ধ জীব। সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে মানুষ যে-সমস্ত সুযোগসুবিধা ভোগ করে সেগুলিকে অধিকার বলে। অধিকার কোনো নেতিবাচক ধারণা নয়।
  • হ্যারল্ড ল্যাস্কি : হ্যারল্ড ল্যাস্কির মতে, অধিকার হল সামাজিক জীবনের সেইসমস্ত শর্তাবলি, যা ছাড়া কোনো ব্যক্তির পক্ষে সর্বোচ্চ আত্মোপলব্ধি সম্ভব নয়।
  • গিলক্রিস্ট: গিলক্রিস্ট মনে করেন, অধিকার হল রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত এবং সংরক্ষিত সেইসমস্ত সুযোগসুবিধা, যার সাহায্যে ব্যক্তির বিকাশ ও সমাজের কল্যাণ সাধিত হয়।
  • টমাস হিল গ্রিন: টমাস হিল গ্রিন বলেছেন, সাধারণের কল্যাণের প্রয়োজনে যে ক্ষমতা দাবি করা হয় এবং অনুমোদিত হয়, তাকে অধিকাররূপে অভিহিত করা হয়।
  • আর্নেস্ট বার্কার: আর্নেস্ট বার্কার মনে করেন, রাষ্ট্র ও তার আইন কর্তৃক স্বীকৃত দাবিই হল অধিকার। অবশ্য রাষ্ট্র বা আইন অধিকারের প্রাথমিক উৎস নয়। অধিকারের প্রধান কথা হল ব্যক্তির অন্তর্নিহিত নৈতিক ব্যক্তিত্বের বিকাশ।
  • হবহাউস: হবহাউসের মতে, আমরা একে অপরের থেকে যা প্রত্যাশা করি, সেটাই অধিকার। অধিকারের পিছনে সামাজিক অনুমোদন থাকে।

উপরোক্ত রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের সংজ্ঞার পরিপ্রেক্ষিতে অধিকারের সংজ্ঞা সম্পর্কে একটি মূল্যবান ধারণা পাওয়া যায়।

২। অধিকারের প্রকৃতি আলোচনা করো এবং অধিকার সম্পর্কে মাকর্সীয় ধারণা কী?

অধিকারের প্রকৃতি

প্রকৃতিগত বিচারে অধিকার প্রসঙ্গে নিম্নলিখিত বিষয়গুলির অবতারণা করা যায়-

  • সামাজিক ধারণা: অধিকার বলতে কিছু দাবি বা স্বত্বকে বোঝায় যেগুলি সমাজের মধ্যেই স্বীকৃত ও সংরক্ষিত হয়। তাই অধিকারকে একটি সামাজিক ধারণা বলা হয়। যেমন- মানুষ সামাজিক জীব হিসেবে সমাজের মধ্যে থেকেই সকল অধিকার ভোগ করতে পারে। কিন্তু মানুষ এমন কোনো অধিকার ভোগ করতে পারে না, যাতে সমাজের ক্ষতি হয় বা অন্যরা অসুবিধায় পড়ে।
  • আইনগত ধারণা: মানুষের অধিকার যত শাশ্বত ও চিরন্তনই হোক-না-কেন, রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত না হওয়া পর্যন্ত তার আইনগত কোনো মূল্য নেই। তাই অধিকারের প্রতি রাষ্ট্রের স্বীকৃতি প্রকাশ পায় আইনের মধ্য দিয়ে, আর এই আইনের মধ্য দিয়েই রাষ্ট্র মানুষের অধিকারকে রক্ষা করে।
  • ন্যায্য ধারণা: আইন এবং রাষ্ট্র উভয়ই ন্যায় ব্যবস্থার উপর প্রতিষ্ঠিত এবং এই ব্যবস্থারই ফল হল অধিকার। তাই অধিকারকে একটি ন্যায্য ধারণারূপেও অভিহিত করা যায়।
  • স্থিতিশীল নয়: কোনো কোনো অধিকার সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে পরিবর্তিত হতে পারে, আবার সমাজের চাহিদা বা দাবির সঙ্গে কোনো অধিকার হ্রাসও পেতে পারে। যেমন-ভারতের সংবিধানে প্রথমে সম্পত্তির অধিকার মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও পরবর্তীকালে সম্পত্তির অধিকারকে মৌলিক অধিকার থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।

অধিকার সম্পর্কে মার্কসীয় ধারণা

মার্কসবাদ অধিকারকে কোনো বিমূর্ত বা কাল্পনিক ধারণা বলে মনে করে না। মার্কসবাদীদের ধারণা হল, সমাজের শ্রেণিকাঠামো এবং সামাজিক অবস্থানের সঙ্গে অধিকারের ধারণা জড়িত রয়েছে। তবে মার্কসবাদীরা মনে করেন বুর্জোয়া শাসনব্যবস্থায় অধিকার সাধারণ মানুষের ব্যক্তিত্ব বিকাশে সাহায্য করে না। তাই শ্রেণিশাসিত ও শোষণমূলক সমাজে অধিকারের ধারণাটি বৈষম্যমূলক। উৎপাদনের উপাদান যেখানে সংখ্যালঘুর হাতে কেন্দ্রীভূত, অর্থনৈতিক অসাম্য যে ব্যবস্থায় প্রতিষ্ঠিত, সেখানে শোষকের স্বার্থেই অধিকারের ধারণাটি গড়ে ওঠে। তাই একমাত্র বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাতেই জনগণের প্রকৃত অধিকার স্বীকৃত ও সংরক্ষিত হতে পারে।

৩। অধিকারের রূপগুলি বা প্রকারভেদ আলোচনা করো।

অধিকারের বিভিন্ন রূপ বা প্রকারভেদ

অধিকারকে মূলত দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়, যথা- (1) নৈতিক অধিকার (Moral Rights) এবং (2) আইনগত অধিকার (Legal Rights)। আবার এই আইনগত অধিকারগুলিকে প্রকৃতি অনুযায়ী চার ভাগে ভাগ করা যায়, যথা- পৌর অধিকার (Civil Rights), সামাজিক অধিকার (Social Rights), রাজনৈতিক অধিকার (Political Rights) ও অর্থনৈতিক অধিকার (Economic Rights)|

(1) নৈতিক অধিকার: মানুষের নৈতিক সত্তার বিবেকসম্মত দাবিই হল নৈতিক অধিকার। এ অধিকার রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত নয় বা অধিকার ভঙ্গ করলে রাষ্ট্র কোনো শাস্তি দিতে পারে না। এখানে একজনের নৈতিক অধিকার অপর একজনের নৈতিক কর্তব্যপালনের উপর নির্ভরশীল।

(2) আইনগত অধিকার: রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে সরকার দ্বারা স্বীকৃত ও সংরক্ষিত যেসকল সুযোগসুবিধা নাগরিকগণ ভোগ করে, তাকে আইনগত অধিকার বলে। রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত এই অধিকারকে ভঙ্গ করার অর্থ রাষ্ট্রের আইন ভঙ্গ করা।

আইনগত অধিকারের আরও চারটি রূপ হল-

(I) পৌর অধিকার: পৌর বা নগরজীবনে বসবাসের জন্য মানুষ যেসকল অধিকার ভোগ করে থাকে তাকে পৌর অধিকার বলা হয়। মানুষের বাঁচার জন্য যে ন্যূনতম সুযোগসুবিধাগুলি থাকা প্রয়োজন তা পৌর অধিকারের অন্তর্ভুক্ত।

(ii) সামাজিক অধিকার: ব্যক্তিজীবনের পূর্ণতার পাশাপাশি সমাজের সামগ্রিক কল্যাণ যদি অধিকারের উদ্দেশ্য হয়, তবে যে অধিকারগুলি ছাড়া ব্যক্তিজীবন পূর্ণ হতে পারে না, তাই হল সামাজিক অধিকার। 

(iii) রাজনৈতিক অধিকার: রাষ্ট্র হল মানুষের রাজনৈতিক জীবনের অভিব্যক্তি। তাই রাষ্ট্রের গঠন ও কার্যকলাপ সম্পর্কে জড়িত হওয়ায় প্রত্যেকটি অধিকারই নাগরিকরা ভোগ করে থাকে। এই অধিকারগুলিই নাগরিকদের রাজনৈতিক অধিকাররূপে পরিচিত।

(iv) অর্থনৈতিক অধিকার: অর্থনৈতিক অধিকার ছাড়া পৌর, রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকারগুলি নিতান্তই অর্থহীন হয়ে পড়ে। তাই অর্থনৈতিক অধিকারকে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়। অর্থনৈতিক অধিকার বলতে আমরা সেই সকল অধিকারকে বুঝি, যেগুলি মানুষকে দারিদ্র্য এবং অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি দিয়ে দৈনন্দিন জীবনকে স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ ও নিরাপদ করে গড়ে তোলে।

উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকার অধিকারগুলি সম্বন্ধে জানা গেলেও মনে রাখতে হবে যে, অধিকারের শ্রেণিবিভাগগুলি কোনো ক্ষেত্রেই চূড়ান্ত নয়। একটি অধিকার অপর একটি অধিকারের সঙ্গে এমন ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত যে অনেকসময় তাদের মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য নির্ণয় করা কঠিন হয়ে পড়ে।

৪। অধিকারের বৈশিষ্টসমূহ আলোচনা করো

অধিকারের বৈশিষ্ট্যসমূহ

অধ্যাপক ল্যাস্কি এবং অন্যান্য তাত্ত্বিকগণকে অনুসরণ করে অধিকারের বৈশিষ্ট্যকে এইভাবে নির্দেশ করা যায়, যথা-

  • ব্যক্তিত্ব বিকাশের উপযোগী : অধিকার হল মানুষের জীবন এবং ব্যক্তিত্বের পূর্ণতম বিকাশের উপযোগী কতকগুলি বাহ্যিক সুযোগসুবিধা বা অবস্থাবিশেষ।
  • আদালত কর্তৃক সুরক্ষিত: অধিকার একটি আইনগত ধারণা। রাষ্ট্রের আইন অধিকারকে স্বীকৃতি দেয় ও আদালত তাকে সুরক্ষিত করে। তাই মানুষের বাহ্যিক সুযোগসুবিধাগুলি মানুষের ব্যক্তিত্ব বিকাশে যত অপরিহার্যই হোক- না-কেন, রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত না হলে সেগুলির কোনো আইনগত মূল্য নেই।
  • সমাজনিরপেক্ষ বিষয় নয়: রাষ্ট্রের স্বীকৃতি ও সুরক্ষাই শেষ কথা নয়, অধিকারের একটি নৈতিক ভিত্তি আছে এবং অধিকার সমাজনিরপেক্ষ নয়। কারণ মানুষ সামাজিক জীব হিসেবে সমাজের মধ্যে বসবাস করেই সমস্তরকম অধিকার ভোগ করতে পারে।
  • নিরঙ্কুশ নয়: সমাজের একজন সদস্য হিসেবে মানুষ অধিকার ভোগ করে বলে অধিকার নিরঙ্কুশ হতে পারে না। কারণ প্রত্যেকের অধিকার প্রত্যেকের অধিকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং সীমাবদ্ধ। তাই প্রত্যেকটি মানুষ অধিকার ভোগ করতে গিয়ে এই সীমা মেনে চলে, যা প্রত্যেকেরই কর্তব্য।
  • সমাজকল্যাণে সহায়ক: অধিকারের সঙ্গে সমাজকল্যাণের এক অবিচ্ছেদ্য যোগসূত্র রয়েছে। যেসমস্ত অধিকারের ক্ষেত্রে ব্যক্তিকল্যাণের সঙ্গে সমাজকল্যাণের সমন্বয় ঘটে, একমাত্র সেইসমস্ত অধিকারকেই রাষ্ট্র মেনে নেয়। তাই জনস্বার্থবিরোধী বিষয়কে অধিকারের অন্তর্ভুক্ত করা যায় না।*

পরিশেষে বলা যায়, ব্যক্তিত্বের দাবিকে ক্রমাগত অগ্রাহ্য করে সামাজিক বিন্যাস গড়ে ওঠে। তাই অধিকারের দাবিকে মেনে না নিলে আনুগত্যের দাবিকেও বিসর্জন দেওয়া হয়।

৫। পৌর অধিকার কাকে বলে? পৌর অধিকারের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন অধিকারগুলি সংক্ষেপে আলোচনা করো।

পৌর অধিকার

যেসকল সুযোগসুবিধা ব্যতীত মানুষের পক্ষে সভ্য সামাজিক জীবনযাপন করা সম্ভব নয়, তাকে পৌর অধিকার (Civil Rights) বলে। ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য পৌর অধিকার একান্তভাবে অপরিহার্য। নিম্নলিখিত পৌর অধিকারসমূহ সভ্য সমাজে উল্লেখযোগ্য।

বিভিন্ন পৌর অধিকারসমূহ

  • বাঁচার অধিকার: মানুষের বাঁচার অধিকার (Right to Life) হল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি মৌলিক অধিকার। বাঁচার অধিকার না থাকলে অন্য কোনো ধরনের অধিকার ভোগ সম্ভব নয়। প্রসঙ্গত বলা যায়, বাঁচার অধিকার বলতে আত্মরক্ষার অধিকার এবং আত্মরক্ষার প্রয়োজনে বলপ্রয়োগের অধিকারকেও বোঝায়।
  • স্বাধীনভার অধিকার: আধুনিক রাষ্ট্রে নাগরিক জীবনের অন্যতম প্রধান অধিকার হল স্বাধীনতার অধিকার (Right to Freedom)। ব্যক্তিসত্তার সর্বাঙ্গীণ বিকাশের জন্য স্বাধীনতার অধিকার অত্যন্ত জরুরি। ব্যক্তিস্বাধীনতার সঙ্গে জড়িত যেসকল অধিকারকে স্বাধীনতার অধিকারের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তার মধ্যে রয়েছে চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার, স্বাধীনভাবে চলাফেরার অধিকার, স্বাধীনভাবে সংঘ বা সমিতি গঠন করার অধিকার, স্বাধীন পেশা বা বৃত্তির অধিকার, স্বাধীনভাবে বসবাসের অধিকার, সভা-সমাবেশে স্বাধীনভাবে যোগদান করার অধিকার এবং বিনা বিচারে গ্রেপ্তার বা আটক না হওয়ার অধিকার প্রভৃতি।
  • সম্পত্তির অধিকার: সম্পত্তির অধিকার (Right to Property) একটি অন্যতম পৌর অধিকার। সম্পত্তির অধিকার বলতে ব্যক্তির সম্পত্তি অর্জন, ভোগদখল এবং সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয়ের অধিকারকে বোঝায়। সম্পত্তি দান ও সম্পত্তি হস্তান্তর এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। প্রসঙ্গত বলা যায়, ভারতে সম্পত্তির অধিকার বর্তমানে মৌলিক অধিকাররূপে স্বীকৃত নয়, এটি একটি সাংবিধানিক অধিকারমাত্র।
  • পরিবার গঠনের অধিকার: পরিবার গঠনের অধিকার (Right to Family) মানুষের একটি প্রাচীন পৌর অধিকার। অ্যারিস্টট্ল-এর মতে, পরিবার গঠন হল সমাজজীবনের মূল ভিত্তি। এই কারণে বিবাহের মাধ্যমে নাগরিকদের সুখী ও সমৃদ্ধ পরিবার গঠনের অধিকার প্রতিটি রাষ্ট্রেই স্বীকৃত রয়েছে।
  • ধর্মের অধিকার: ধর্মের অধিকার (Right to Religion) আধুনিক রাষ্ট্রে একটি স্বীকৃত পৌর অধিকার। এই অধিকারের মাধ্যমে মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস, ধর্মীয় আচার-আচরণ ও ধর্মপ্রচারের স্বাধীনতায় ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র কোনোরকম হস্তক্ষেপ করে না। ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ বহুকাল থেকে স্বীকৃত রয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে সব ধর্মের অধিকার সমান, রাষ্ট্র কোনো ধর্মের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করে না।

৬। রাজনৈতিক অধিকার কাকে বলে? রাজনৈতিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন অধিকারগুলি সংক্ষেপে আলোচনা করো।

রাজনৈতিক অধিকার

রাষ্ট্র হল মানুষের রাজনৈতিক জীবনের অভিব্যক্তি। তাই রাষ্ট্রের গঠন ও কার্যকলাপ সম্পর্কে জড়িত হওয়ার প্রত্যেকটি অধিকার নাগরিকের রয়েছে। এই অধিকারগুলিই নাগরিকদের রাজনৈতিক অধিকাররূপে পরিচিত। বার্কার বলেছেন, নাগরিক হিসেবে ব্যক্তির প্রাপ্ত বা অর্জিত অধিকারই হল রাজনৈতিক অধিকার।

রাজনৈতিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন অধিকার

রাজনৈতিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত অধিকারগুলি নিম্নরূপ-

  • ভোট দানের অধিকার: ভোটদানের অধিকার ছাড়া রাষ্ট্র ও সরকারের সঙ্গে জনগণের যোগসূত্র স্থাপিত হতে পারে না। কারণ, একমাত্র স্বাধীন এবং অবাধ নির্বাচনের মধ্য দিয়েই জনগণ তাদের পছন্দমতো প্রতিনিধি নির্বাচন করে রাষ্ট্রের পরিচালন ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করতে পারে। সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভোটদান করার অধিকার গণতন্ত্রের মৌল ভিত্তি রচনা করে।
  • নির্বাচিত হওয়ার অধিকার: নির্বাচিত হওয়ার অধিকার ছাড়া নির্বাচনের অধিকার পূর্ণ হতে পারে না। জনগণ পরোক্ষ প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে প্রত্যক্ষভাবে শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করতে পারে না বলেই ভোটদানের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচন করে। তাই এটি ভোটাধিকারের পরিপূরক এবং গণতান্ত্রিক সরকারের একটি আবশ্যকীয় শর্ত।
  • সরকারি চাকুরিতে অংশগ্রহণের অধিকার: রাজনৈতিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত আর একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকার হল-সরকারি চাকুরিতে অংশগ্রহণের অধিকার। এর মাধ্যমে নাগরিকরা যোগ্যতা অনুযায়ী বিভিন্ন সরকারি চাকুরিতে নিয়োজিত হওয়ার সুযোগ লাভ করে।
  • আবেদনের অধিকার: সরকারের সঙ্গে জনগণের যোগাযোগ রাখার ব্যবস্থা থাকা দরকার। কারণ এর মধ্য দিয়ে জনগণ তাদের অভাব-অভিযোগ সম্পর্কে, সরকারের কোনো বিভাগের কোনো দুর্নীতি সম্পর্কে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে এবং প্রতিকারের দাবি জানাতে পারে। এইজন্য প্রয়োজন নাগরিকদের আবেদন করার অধিকার।
  • সরকারের কাজকর্মের সমালোচলা করার অধিকার: গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকারের কাজকর্মের সমালোচনা করার অধিকারের মূল্য অপরিসীম। কারণ সরকার এই সমালোচনার আলোকে নিজের কাজকর্মের ত্রুটি শুধরে নিয়ে সেগুলিকে প্রকৃত জনমুখী করতে পারে। তবে তার জন্য সমালোচনা হওয়া চাই নিরপেক্ষ এবং গঠনমূলক।
  • বিদেশে অবস্থানকালীন নিরাপত্তার অধিকার: বিদেশে বসবাসকালীন নাগরিকদের নিরাপত্তার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের সরকারের হাতে ন্যস্ত থাকে। কারণ প্রবাসী জীবনে নিরাপত্তার অধিকার হল নাগরিকদের একটি রাজনৈতিক অধিকার।
  • রাষ্ট্রের বিরোধিতা করার অধিকার: প্রত্যেক নাগরিকের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবনের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণসাধনের দায়িত্ব রাষ্ট্রের হাতে ন্যস্ত থাকে। অবশ্য অনেকেই জনবিরোধী কার্যকলাপের জন্য রাষ্ট্রের বিরোধিতা করার দাবিকে একটি যুক্তিসংগত রাজনৈতিক অধিকার বলে মনে করেন। কারণ রাষ্ট্রের সরকার যদি তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয় তাহলে নাগরিকগণ সরকারের বিরোধিতা করতে পারে। তাই রাষ্ট্র এই অত্যন্ত প্রয়োজনীয় অধিকারকে স্বীকৃতি না দিলে সরকার স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে পারে।
  • সভাসমিতি গঠনের অধিকার: সভাসমিতি বা সংঘ গঠনের অধিকারকে রাজনৈতিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মার্কসবাদীরা রাষ্ট্রীয় শোষণের বিরুদ্ধে শোষিত, নিপীড়িত মানুষের বিপ্লবের অধিকারকে অন্যতম রাজনৈতিক অধিকাররূপে চিহ্নিত করেছেন।

উপরোক্ত আলোচনাগুলির মাধ্যমে এই কথা বলাই যায় যে, রাজনৈতিক অধিকার এবং রাজনৈতিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত অধিকারগুলির গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

৭। অর্থনৈতিক অধিকার সম্পর্কে আলোচনা করো।

অর্থনৈতিক অধিকার

অর্থনৈতিক অধিকার বলতে আমরা সেই সকল অধিকারকে বুঝি, যেগুলি মানুষকে দারিদ্র্য এবং অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি দিয়ে দৈনন্দিন জীবনকে স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ ও নিরাপদ করে গড়ে তোলে। অধ্যাপক ল্যাস্কি-র মতে, প্রাত্যহিক অন্নসংস্থানের ক্ষেত্রে মানুষের ন্যায়সংগত মজুরি পাওয়ার নিরাপত্তা ও সুযোগকে অর্থনৈতিক অধিকার বলা যায়। যাই হোক, অর্থনৈতিক অধিকারসমূহের মধ্যে নিম্নলিখিতগুলি উল্লেখযোগ্য-

অর্থনৈতিক অধিকারের বিভিন্ন রূপ

  • কর্মের অধিকার : অর্থনৈতিক অধিকারের মধ্যে প্রথমেই কর্মের অধিকারের (Right to work) উল্লেখ করা যায়। যোগ্যতা অনুযায়ী প্রত্যেকটি নাগরিকের কর্মের সুযোগ থাকা দরকার। শিক্ষাগত যোগ্যতা, প্রশিক্ষণ, দক্ষতা এবং প্রবণতা অনুযায়ী কর্ম নির্বাচন করার সুযোগসুবিধাও এইরূপ অধিকারেরই অঙ্গ।
  • কর্মের উপযোগী বেতন লাভের অধিকার: কর্মে নিযুক্ত প্রতিটি ব্যক্তির বেতন বা বেতনক্রম এমনভাবে নির্ধারিত হওয়া প্রয়োজন, যাতে তার ন্যূনতম জীবনযাত্রার মানকে সুনিশ্চিত করা যায়। যদি তা না হয় তাহলে মানুষ তার উপরি উপার্জনকে বেছে নিতে পারে। এতে রাষ্ট্রের এবং পক্ষান্তরে সমগ্র জনগণেরই ক্ষতি হাতে পারে।
  • বিশ্রামের অধিকার: কাজের অধিকারের পাশাপাশি বিশ্রামের অধিকারও (Right to Leisure) অত্যন্ত জরুরি। নিরবচ্ছিন্ন কাজের পরে অবসর যাপনের অবকাশ না থাকলে মানুষের পক্ষে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন সম্ভব নয়। বস্তুত অবকাশের সুযোগ না থাকলে কর্মরত মানুষের জীবন যান্ত্রিক হয়ে পড়ে। ফলে মানুষের পক্ষে নতুন কিছু চিন্তাভাবনা করা বা উদ্ভাবন করাও সম্ভব নয়।
  • ভরণ-পোষণের অধিকার: বার্ধক্যে এবং কর্মাবসানে ভরণ-পোষণের অধিকার অর্থনৈতিক অধিকারের একটি অঙ্গ। অবসরপ্রাপ্ত বয়স্ক নাগরিকদের ভরণ-পোষণের দায়দায়িত্ব রাষ্ট্রকেই গ্রহণ করতে হয়।
  • শ্রমিক সংঘ গঠনের অধিকার: শ্রমিক স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য শ্রমিক সংঘ গঠন করা প্রয়োজন। পৃথিবীর সকল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে শ্রমিক স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যে শ্রমিক সংঘে যোগদান করার অধিকার অর্থনৈতিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত।
  • শ্রমিক আন্দোলনে সামিল হওয়ার অধিকার: মালিকশ্রেণি কর্মচারীদের অর্থনৈতিক অধিকারের থেকে নিজেদের লাভ-লোকসানের প্রশ্নটিকে বড়ো করে দেখে, এর ফলে শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষার জন্য মালিকশ্রেণির সঙ্গে বেতন, ভাতা, কাজের শর্তাবলি, অবসরকালীন সুযোগসুবিধা ইত্যাদি বিষয়ে শ্রমিকদের দরকষাকষি লক্ষ করা যায়। তখনই দরকার হয় শ্রমিক আন্দোলনে সামিল হওয়ার অধিকারের, যা অর্থনৈতিক অধিকারের একটি অন্যতম রূপ বলে বিবেচিত।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে বলা যায়, অধিকারের অন্যতম রূপ হিসেবে অর্থনৈতিক অধিকারগুলির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

৮। সামাজিক ও কৃষ্টিগত অধিকার সম্পর্কে আলোচনা করো।

সামাজিক অধিকার

ব্যক্তিজীবনের পূর্ণতার পাশাপাশি সমাজের সামগ্রিক কল্যাণ যদি অধিকারের উদ্দেশ্য হয়- তবে যে অধিকারগুলি ছাড়া তা হতে পারে না, তাই হল সামাজিক অধিকার। এই অধিকারের | অন্তর্ভুক্ত অধিকারগুলি হল –

  • শিক্ষার অধিকার: সামাজিক অধিকারগুলি হল সমষ্টিগত অধিকার। এই অধিকারের মধ্যে প্রথমেই শিক্ষার অধিকার স্থান পেয়েছে। ল্যাস্কি বলেন, শিক্ষার অধিকার নাগরিকদের জ্ঞানপ্রসূত বিচারবুদ্ধির প্রয়োগে সাহায্য করে। নিজের জীবনকে পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করার জন্য শিক্ষার অধিকার মানুষের কাছে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
  • সাংস্কৃতিক অধিকার: কোনো মানুষের, দেশ বা জাতির সাংস্কৃতিক বিকাশ একমাত্র শিক্ষার উন্নতির উপরই নির্ভরশীল। তা ছাড়া খেলাধুলা, নাটক, সংগীত প্রভৃতিতে নাগরিকদের স্বাধীন অংশগ্রহণের প্রশ্নটিও সাংস্কৃতিক অধিকাররূপে পরিচিত।
  • স্বাস্থ্য সংরক্ষণের অধিকার : সুস্থ ও সবল দেহের অধিকারী হতে না পারলে নাগরিকতার প্রকৃত বিকাশ ঘটতে পারে না। এই কারণেই দরকার অপুষ্টি দূরীকরণের ব্যবস্থা, সমাজের সকলের জন্য স্বাস্থ্য সংরক্ষণের সুযোগসুবিধা প্রভৃতি। এরজন্য ওষুধ, চিকিৎসা, প্রতিষেধক ব্যবস্থা, হাসপাতাল প্রভৃতির সুযোগসুবিধা গ্রাম-শহরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে দিতে হবে।
  • সুখ পরিবেশে বাস করার অধিকার: সুস্থ ও সুন্দর সামাজিক পরিবেশে বসবাস করার অধিকার (Right to Reside in a Healthy Environment) একটি তাৎপর্যপূর্ণ সামাজিক অধিকার। তাই জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রের পক্ষে সুস্থ ও সামাজিক পরিবেশ গড়ে তোলা একটি অপরিহার্য কর্তব্য। সুস্থ সামাজিক পরিবেশে সুস্থ সংস্কৃতি গড়ে ওঠে, যা নাগরিকদের জীবনের অন্তর্নিহিত সত্তার বিকাশে একান্ত উপযোগী।
  • মর্যাদাপূর্ণভাবে বসবাসের অধিকার: সুস্থ সামাজিক পরিবেশে মর্যাদাপূর্ণভাবে বসবাসের অধিকার প্রত্যেক নাগরিকেরই রয়েছে। সুস্থ সামাজিক পরিবেশেই মানুষ তার শরীর ও মনের সর্বোত্তম বিকাশসাধনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের সুযোগ্য নাগরিক হয়ে উঠতে পারে।
  • সামাজিক সাম্যের অধিকার: সামাজিক সাম্যের অধিকার (Right to Social Equality) একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকার। ধর্ম, বর্ণ, জাতি, স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সমস্ত নাগরিকের সামাজিক দিক থেকে সাম্যের অধিকার থাকা বাঞ্ছনীয়। অস্পৃশ্যতা বা জাতিভেদের মতো মানবিক অভিশাপ সমাজ থেকে দূর করা দরকার। মানুষের মধ্যে কোনোপ্রকার ভেদাভেদ করা উচিত নয়। বস্তুতপক্ষে, সামাজিক বৈষম্য বিদ্যমান থাকলে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও উন্নয়ন সঠিকভাবে রূপায়িত হতে পারে না।
  • সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার: সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার হল অপর একটি সামাজিক অধিকার। যারা বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত তাদের বার্ধক্যে এবং অবসরকালীন অবস্থায় রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব রাষ্ট্রের হাতেই ন্যস্ত থাকে। তাছাড়া যারা কর্মক্ষম অথচ কর্মের কোনো সংস্থান নেই তাদের সহযোগিতা করা রাষ্ট্রেরই অন্যতম কর্তব্য। তবে বর্তমানে সব রাষ্ট্রেই সামাজিক নিরাপত্তা বিধানের জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা গৃহীত হয়, যেমন-বিমা প্রকল্প, সরকারি অনুদান, অবসরকালীন ভাতা প্রভৃতি।
  • শোষণ ও নিপীড়ন থেকে মুক্তির অধিকার: শোষণ ও নিপীড়ন থেকে মুক্তির অধিকার একটি সামাজিক অধিকাররূপে পরিচিত। তাছাড়া কলকারখানায়, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে অল্প মাইনের বিনিময়ে নারী ও শিশুদের শ্রম নিয়ে অপব্যবহার করা হয়। তাই কঠোর আইন প্রণয়ন করে নারী ও শিশুদের কাজের শর্তাবলি সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অন্যতম কর্তব্য।
  • কৃষ্টিগত অধিকার: প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর নিজেদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের অধিকারকেই কৃষ্টিগত অধিকার বলে। সুস্থ সংস্কৃতি বজায় রাখার জন্য জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে দেশের সকল প্রকার ঐতিহ্য, ভাষা- সংস্কৃতি, কৃষ্টিগত বৈশিষ্ট্য এবং বৈচিত্র্য রক্ষণাবেক্ষণের উপযুক্ত ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। এরই পাশাপাশি প্রত্যেক নাগরিক বা গোষ্ঠীর ভাষা-সংস্কৃতি ও অতীত ঐতিহ্য রক্ষার ব্যাপারে রাষ্ট্রকেই বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করতে হয়, যাতে দেশের কৃষ্টি-সংস্কৃতি আগামী প্রজন্মকে প্রভাবিত করতে পারে।

৯। কর্তব্য বলতে কী বোঝ? নাগরিকদের যেকোন চারটি কর্তব্য সম্বন্ধে আলোচনা করো।

অথবা, কর্তব্য বা নাগরিক কর্তব্য বলতে কী বোঝো? ভারতের সংবিধানে উল্লেখিত নাগরিকদের কর্তব্যগুলি উল্লেখ করো।

কর্তব্যের সংজ্ঞা

কর্তব্য বলতে কোনো কিছুর প্রতি কিছু দায়িত্ব পালন করাকে বোঝায়। যেমন- দেশের অভ্যন্তরে আইন মেনে চলা একটি কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। অধিকার তখনই ভোগ করা যায়, যখন তার পূর্বে কোনো কর্তব্য পালন করা হয়। একইভাবে জনগণের কাছ থেকে রাষ্ট্র কিছু কর্তব্য আশা করে থাকে। একজন ব্যক্তির চেতনা (Civic Sense) জাগ্রত হওয়ার উপরে অন্য ব্যক্তিদের অধিকারভোগ ও কর্তব্যপালনের বিষয়টি নির্ভর করে চলে। বিভিন্ন দেশ, যেমন-ভারত, চিন ও জাপানের সংবিধানে নাগরিকদের কর্তব্য উল্লেখ করা হয়েছে।

নাগরিকদের কর্তব্যকে ব্যাপক ও সংকীর্ণ অর্থে আলোচনা করা যেতে পারে।

  • ব্যাপক অর্থে কর্তব্য: ব্যাপক অর্থে বা ইতিবাচক অর্থে কর্তব্যকে দুভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। একটি হল নৈতিক কর্তব্য, যা মূলত ব্যক্তির বিবেকবোধ ও ন্যায়-অন্যায়বোধ থেকে তৈরি হয়। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র কোনো বলপূর্বক আইন প্রয়োগ করে না। অপরটি হল আইনগত কর্তব্য, অর্থাৎ রাষ্ট্র ও সরকারের মহৎ কোনো লক্ষ্যপূরণে বা দেশরক্ষার কার্যে নাগরিকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা এবং সুষ্ঠুভাবে ভোটদান ইত্যাদিকে বোঝায়।
  • সংকীর্ণ অর্থে কর্তব্য: কোনো ব্যক্তি যদি অপরের জীবনহানি করে থাকে, নিষিদ্ধ মাদকদ্রব্য সেবন বা পাচার-সহ জাতীয় সম্পদের ক্ষতিসাধন করে থাকে, তবে সেগুলি নেতিবাচক বা সংকীর্ণ কর্তব্যের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়। আইন প্রয়োগের মাধ্যমে রাষ্ট্র এহেন ক্রিয়াকলাপ থেকে নাগরিকদের বিরত থাকার নির্দেশ দেয়। প্রয়োজনে তা গুরুতর অপরাধ বলেও গণ্য হয় ও বিচারে ব্যক্তির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পর্যন্ত হয়।

ভারতের সংবিধানে উল্লিখিত নাগরিকদের কর্তব্যসমূহ

ভারতের সংবিধানে উল্লিখিত নাগরিকদের কর্তব্যগুলিকে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়, যথা-

[1] নিজের প্রতি কর্ত্তব্য: সমাজ এবং সমষ্টির বিকাশের গুণগত মান ব্যক্তির জীবন বিকাশের গুণগত মানের উপর নির্ভরশীল। তাই নাগরিকদের প্রথম কর্তব্য হল- নিজের শারীরিক, মানসিক এবং নৈতিক বিকাশসাধন করে সমাজ এবং সমষ্টির যোগ্যতম অংশরূপে নিজেকে গড়ে তোলা।

[2] পরিবারের প্রতি কর্তব্য: গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনের একক হল পরিবার। পরিবারই সমাজের প্রতি শিক্ষা জাগ্রত করে, সমাজের সঙ্গে শিশুর পরিচয় ঘটায়। তাই নাগরিকের পরিবারের প্রতি কর্তব্য দেশের প্রতি তার বৃহত্তম কর্তব্যেরই একটি অংশ।

[3] সমাজের প্রতি কর্তব্য: মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। সমাজ ব্যতীত মানুষ তার অধিকার ভোগ করতে পারে না এবং তার জীবনের পূর্ণতম বিকাশসাধন করতে পারে না। এই কারণেই সমাজের প্রতি নাগরিকের কর্তব্য হল তার অধিকার ভোগের আর একটি দিক।

[4] রাষ্ট্রের প্রতি কর্তব্য: মানুষের কোনো অধিকারই রাষ্ট্রের স্বীকৃতি ব্যতীত আইনগত মূল্য অর্জন করতে পারে না। তাই রাষ্ট্রের সভ্য হিসেবে নাগরিকেরও কতকগুলি কর্তব্য রয়েছে, সেগুলি পালন না করলে রাষ্ট্রের পক্ষে কাজ করা শক্ত হয়ে পড়ে।

১০। রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকদের কর্তব্যসমূহ আলোচনা করো।

রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকদের কর্তব্যসমূহ

রাষ্ট্রের প্রতি ব্যক্তির কিছু কর্তব্য রয়েছে, সেগুলি পালন না করলে রাষ্ট্রের পক্ষে কাজ করা কঠিন হয়ে পড়ে। রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকদের কর্তব্যগুলি হল-

[1] আনুগত্য মেনে চলা: রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকদের কর্তব্য সম্বন্ধে দুটি ধারণা প্রচলিত আছে। যেমন- অনেকে মনে করেন শক্তির ভয়েই নাগরিক রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে, আবার কেউ কেউ মনে করেন, মানুষ নীতিগতভাবেই রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত। রাষ্ট্রের আদর্শের প্রতি অনুগত থাকা, রাষ্ট্রের মর্যাদা, ঐক্য এবং অখণ্ডতাকে উচ্চমূল্য দেওয়া, রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য সহযোগিতা করা, গুপ্তচরবৃত্তি করে দেশের সর্বনাশ না করা- এই সমস্তই হল রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকের আনুগত্যের বিভিন্ন প্রকাশ।

[2] আইন মান্য করা: রাষ্ট্রের নির্দেশ আইনের মধ্য দিয়েই প্রকাশিত হয়ে থাকে। তাই আইন মেনে চলা প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য, আইন না মানার অর্থ হল- অনাচার, বিশৃঙ্খলা এবং নৈরাজ্য। সুতরাং কেউ আইন মানতে অস্বীকার করলে রাষ্ট্র তাকে আইন মানতে বাধ্য করতে পারে।

[3] নিয়মিত কর প্রদান করা: রাষ্ট্রের কাজকর্ম পরিচালনার জন্য অর্থের প্রয়োজন। রাষ্ট্র বিভিন্ন করের মাধ্যমে জনগণের কাছ থেকে এই অর্থের একটা বিপুল পরিমাণ অংশ সংগ্রহ করে থাকে। কাজেই জনগণ যদি নিয়মিত কর প্রদান না করে তবে রাষ্ট্রের পক্ষে কাজ করা শক্ত হয়ে ওঠে।

[4] সৎভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করা: পরোক্ষ প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে জনগণের প্রতিনিধিগণই সরকার পরিচালনা করে থাকে। তাই জনগণের উচিত সতর্কভাবে এবং সঠিকভাবে তাদের পরম মূল্যবান ভোটাধিকারকে প্রয়োগ করে যোগ্য প্রতিনিধি নির্বাচন করা। এটি নাগরিকদের পরম পবিত্র কর্তব্য।

[5] সেনাবাহিনীতে যোগদান: রাষ্ট্রের নিরাপত্তা রক্ষার্থে প্রতিটি রাষ্ট্রেই সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়। সেনাবাহিনীতে স্বেচ্ছায় অংশগ্রহণ এবং সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ প্রত্যেকটি দেশপ্রেমিক নাগরিকেরই কর্তব্য।

পরিশেষে বলা যায় কোনো নাগরিক যদি সরকারি কাজে শিথিলতা দেখায়, ঘুষ নেয়, ভোট কেনাবেচা করে, আইনভঙ্গকারীকে প্রশ্রয় দেয় তাহলে সে নাগরিক কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়বে। তাই প্রত্যেক নাগরিকেরই উচিত রাষ্ট্রের প্রতি কর্তব্যগুলি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করা।

আরও পড়ুন – সমকালীন ভারতীয় রাষ্ট্রচিন্তা : অগ্রণী চিন্তাবিদ প্রশ্ন উত্তর

একাদশ শ্রেণির কলা বিভাগের যে কোনো প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন। কোনো উত্তর না পেলে আমাদের কমেন্ট বক্সে জানান।

Leave a Comment