মৌলানা আবুল কালাম আজাদ-এর শিক্ষাব্যবস্থার মূল্যায়ন করো
শিক্ষাব্যবস্থার সমালোচনাসমূহ
একজন পণ্ডিত, শিক্ষাবিদ এবং ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে মৌলানা আজাদ স্বাধীন ভারতের শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও রূপায়ণে আজাদ ব্যাপক অবদান রাখলেও তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি এবং নীতি সামলোচনার শিকার হয়েছে। সমালোচনাগুলি হল-
[1] উচ্চশিক্ষার উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ: সমালোচকরা যুক্তি দেন যে, নিরক্ষর ভারতে আজাদ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা অপেক্ষা উচ্চশিক্ষার উপর অধিক মনোযোগ দিয়েছিলেন। ফলে দেশের নিরক্ষরতার হার হ্রাস করতে আজাদের নীতি বা পরিকল্পনা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারেনি।
[2] শিক্ষার কেন্দ্রীকরণ: ভারতে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা স্বীকৃত হলেও আজাদ দেশব্যাপী শিক্ষার উন্নয়নের জন্য কেন্দ্রীভূত শিক্ষাব্যবস্থার পক্ষে মতপ্রকাশ করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে সমালোচকদের বক্তব্য ছিল, ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো অনুসরণ করে শিক্ষাব্যবস্থাও যুক্তরাষ্ট্রীয় হওয়াই বাঞ্ছনীয় বা কাম্য। কিন্তু, শিক্ষানীতি ও প্রতিষ্ঠানের কেন্দ্রীকরণ হওয়ার ফলে এটি সম্পূর্ণরূপে যুক্তরাষ্ট্রীয় নীতিবিরোধী। সমালোচকরা যুক্তি দেন, এই পদ্ধতি অনুসরণের ফলে ভারতের বিভিন্ন রাজ্য ও অঞ্চলের শিক্ষাগত চাহিদা ও প্রেক্ষাপট উপেক্ষিত হয়েছে।
[3] কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার অবহেলা: অনেকে আবার অভিযোগ করেছেন আজাদের শিক্ষানীতিগুলি বৃত্তিমূলক বা কারিগরি শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ অপেক্ষা ঐতিহ্যগত শিক্ষার প্রতি অধিক গুরুত্ব দিয়েছিল। ফলে সমালোচকদের অভিমত হল, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার অবহেলার ফলে দেশের জন্য উপযুক্ত মানব সম্পদ গড়ে তোলা সম্ভব হবে না, যা দেশের শিল্প, অর্থনীতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে।
[4] শিক্ষা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যর্থতা: শিক্ষা সম্পর্কে মৌলানা আজাদের দূরদর্শী চিন্তাধারা থাকা সত্ত্বেও অপর্যাপ্ত আর্থিক সম্পদ, প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাব এবং পরিকাঠামোগত ঘাটতি ইত্যাদি সমস্যাগুলি তাঁর পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হওয়ার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল।
[5] সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পক্ষপাতদুষ্ট: কিছু সমালোচক দাবি করেন, আজাদ উর্দু এবং ইসলামিক অধ্যয়নের উপর অধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন, যা তাঁর পক্ষপাতদুষ্ট মনোভাবকেই তুলে ধরে।
[6] শিক্ষার পাশ্চাত্যকরণ: কিছু সমালোচক বলেন, মৌলানার শিক্ষা সংক্রান্ত নীতিগুলি অতিমাত্রায় পাশ্চাত্য মডেল দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল, যা ভারতীয় প্রেক্ষাপটের জন্য উপযুক্ত ছিল না। বরং ভারতে শিক্ষার উন্নতি ও মানোন্নয়নের জন্য দেশীয় পদ্ধতি প্রয়োজন ছিল, যে পদ্ধতিগুলি স্থানীয় ঐতিহ্য এবং ভাষাকে অন্তর্ভুক্ত করবে।
[7] মানের পরিবর্তে পরিমাণের উপর গুরুত্ব: আজাদের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে দ্রুত শিক্ষা সম্প্রসারণ করার উদ্দেশ্যে বহু ক্ষেত্রে শিক্ষার মানের সঙ্গে আপোস করেছে। সমালোচকরা যুক্তি দেন যে, আজাদের শিক্ষানীতি শিক্ষার মান নিশ্চিত করার পরিবর্তে প্রতিষ্ঠান বৃদ্ধির উপর অধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন।
গুরুত্ব
মৌলানার শিক্ষা নীতি, পরিকল্পনা এবং ধ্যানধারণা নানাবিধ সমালোচনার শিকার হলেও আজাদের শিক্ষা সংক্রান্ত ধারণা ছিল উদার ও দূরদর্শী প্রকৃতির। তিনি শিক্ষার মাধ্যমে একদিকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যেকার বিভেদের বিলোপ ঘটাতে চেয়েছিলেন। অন্যদিকে বস্তুবাদ এবং আধাত্ম্যবাদের মধ্যে সমন্বয়সাধন করতে চেয়েছিলেন। এজন্য স্বাধীনতার ৭৭ বছর পরেও, বর্তমানে তার প্রাসঙ্গিকতা সমভাবে বিদ্যমান থেকে গেছে। যেমন সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার অধিকার, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সাম্যবাদী শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, শিক্ষার মাধ্যমে দেশের অতীত গৌরব ঐতিহ্য, ভাষা, সংস্কৃতির সংরক্ষণ, পাঠক্রমের দ্বারা বিষয়গত শিক্ষা প্রদানের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের বিকাশ ঘটানো, শিক্ষার মাধ্যমে নারী ও পশ্চাত্পদ শ্রেণির ক্ষমতায়ন করা ইত্যাদি। এ কারণেই একুশ শতকেও তাঁর চিন্তাভাবনা শিক্ষাবিদ, নীতিনির্ধারক এবং পন্ডিতদের অনুপ্রাণিত করে। শিক্ষা বিষয়ে আজাদের এই অবদানকে সম্মান জানাতে ১১ নভেম্বর অর্থাৎ, তাঁর জন্মদিবসটিকে জাতীয় শিক্ষা দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
আরও পড়ুন – রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রশ্ন উত্তর