মৌলানা আজাদ-এর শিক্ষার বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করো

মৌলানা আজাদ-এর শিক্ষার বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করো

মৌলানা আজাদ-এর শিক্ষার বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করো
মৌলানা আজাদ-এর শিক্ষার বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করো

মৌলানা আজাদের শিক্ষার বৈশিষ্ট্যসমূহ

বিশিষ্ট পণ্ডিত ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী মৌলানা আজাদ স্বাধীন ভারতের শিক্ষাব্যবস্থাকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যে দৃষ্টিভঙ্গি এবং পদক্ষেপগুলি গ্রহণ করেছিলেন সেগুলি বিশ্লেষণ করে কতকগুলি বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করা যায়। এগুলি হল-

[1] সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা: আজাদ ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত সকল শিশুর বাধ্যতামূলক এবং বিনামূল্যে প্রাথমিক শিক্ষা প্রদানের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। এক্ষেত্রে তিনি মনে করতেন, আর্থ-সামাজিক অবস্থা, জাতি, ধর্ম বা লিঙ্গ নির্বিশেষে প্রতিটি শিশুর মানসম্মত শিক্ষালাভের সুযোগ থাকা আবশ্যক। প্রাথমিক শিক্ষাকে সর্বজনীন করে তোলার উদ্দেশ্যে গ্রামীণ ও সুবিধাবঞ্চিত এলাকাগুলিকে আরও প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের প্রয়োজনীয়তার কথা তিনি বলেন।

[2] ধর্মনিরপেক্ষ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা: আজাদ শিক্ষাক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে গ্রহণ করার পক্ষপাতী ছিলেন। তাঁর মতে, ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাব্যবস্থা অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষাব্যবস্থাকে উৎসাহিত করবে, যা সাম্প্রদায়িক উত্তেজনাকে হ্রাস করে জাতীয় ঐক্য ও সংহতির পথকে প্রশস্ত করবে। এ ছাড়াও তাঁর শিক্ষাব্যবস্থায় বর্ণ বা লিঙ্গ বৈষম্যের কোনো স্থান ছিল না। তাঁর কাছে শিক্ষা ছিল সামাজিক ঐক্য ও জাতি গঠনের হাতিয়ারস্বরূপ।

[3] বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি শিক্ষা: জাতীয় উন্নয়নের জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গুরুত্বকে আজাদ স্বীকার করে নিয়ে, তিনি শিক্ষায় বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন। যাতে কারিগরি ও প্রাযুক্তিক ক্ষেত্রে ভারতকে অন্য দেশের উপর নির্ভর করতে না হয়। এজন্যই তিনি ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (IITs) এবং ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স (IISC) স্থাপনের কথা বলেন।

[4] প্রাপ্তবয়স্কের শিক্ষা: স্বাধীনতাকালে ভারতের নিরক্ষরতার হার যেহেতু ব্যাপক ছিল, সেহেতু আজাদ বয়স্কশিক্ষার উপর জোর দিয়েছিলেন। এক্ষেত্রে বয়স্কদের সাক্ষর করার উদ্যোগ গৃহীত হয়েছিল। এ ছাড়া প্রাপ্তবয়স্কদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য রাত্রিবেলায় বিদ্যালয়ের আয়োজন করা হয়, যা Night School হিসেবে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।

[5] শিক্ষক প্রশিক্ষণ: আজাদ শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য গুণসম্পন্ন শিক্ষক প্রশিক্ষণ কর্মসূচির প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, কার্যকরী শিক্ষা প্রদানের জন্য প্রশিক্ষিত শিক্ষক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য তিনি শিক্ষক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান গঠনের কথা বলেন এবং নিরবচ্ছিন্নভাবে পেশাগত উন্নয়নের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন।

[6] বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসার: শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক দক্ষতা বৃদ্ধি করে তাদের ভবিষ্যতে উপার্জনের পথকে সুনিশ্চিত করতে বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসার ঘটানোর কথা আজাদ বলেছিলেন। সেই জন্য তাদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথাও তিনি বলেছিলেন।

[7] গ্রন্থাগার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন: আজাদের চিন্তায় গ্রন্থাগার এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান উন্নয়ন উল্লেখযোগ্য স্থান পেয়েছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, গ্রন্থাগারগুলি জ্ঞানের প্রবেশাধিকার প্রদানের জন্য এবং আজীবন শিক্ষাচর্চার জন্য অপরিহার্য। গবেষণারত ছাত্রদের জন্য উন্মুক্ত জ্ঞানচর্চার পরিবেশ হিসেবে তিনি গ্রন্থাগার গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।

[৪] উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় উৎসাহ প্রদান: আজাদ উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের উপর গুরুত্ব প্রদান করেন। তিনি দক্ষ পেশাদারিত্ব ও বৌদ্ধিকতা বিকাশের মাধ্যম হিসেবে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় উৎসাহিত করার জন্য বৃত্তি এবং ফেলোশিপ প্রদানের উদ্যোগ নেন।

[9] বহুত্ববাদ ও ঐক্যের উপর গুরুত্ব: আজাদের শিক্ষা দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল শিক্ষার মাধ্যমে বহুত্ববাদ ও ঐক্যের প্রচার। যা ভারতের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির সংরক্ষণ করবে এবং জাতীয় ঐক্য ও সংহতিবোধ জাগ্রত করবে। আজাদ বিশ্বাস করতেন, শিক্ষার মাধ্যমেই বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সহনশীলতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও বোঝাপড়া গড়ে তোলা সম্ভব।

[10] প্রথা ও ঐতিহ্যগত গুরুত্ব: আজাদ এমন এক শিক্ষাব্যবস্থার কথা বলেন, যেখানে ভারতের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের অধ্যয়ন করা হবে। তিনি পাঠক্রমে সংস্কৃত ও ফারসির মতো ধ্রুপদী ভাষাকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য উৎসাহিত ছিলেন। অন্যদিকে, ছাত্রদের মধ্যে গর্ব ও পরিচয়বোধ জাগ্রত করতে ভারতের গৌরবময় ইতিহাস অধ্যয়নের পক্ষে জোর দেন।

[11] শিক্ষামূলক পরিকল্পনা ও নীতি: মৌলানা কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা বোর্ডের (Central Advisory Board of Education) সভাপতিত্ব করেন এবং শিক্ষানীতি প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি প্রাথমিক শিক্ষা থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত সকল স্তরের কাঠামো পাঠক্রম কেমন হওয়া উচিত সেই সম্পর্কেও আলোচনা করেছিলেন। এর পশ্চাতে মূল উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জের জন্য প্রস্তুত করা। তিনি দেশের উন্নয়ন সম্পর্কিত পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মধ্যে শিক্ষার লক্ষ্যগুলি অন্তর্ভুক্তির আবেদন জানান।

[12] প্রথাগত ও আধুনিক শিক্ষার একত্রীকরণ: তিনি এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থার পক্ষে সমর্থন করেছিলেন, যা আধুনিক বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত শিক্ষার সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় শিক্ষাকে মিশ্রিত করে। আজাদ মনে করতেন এই পন্থাগুলি একত্রিত করলে একটি সুশিক্ষিত সমাজ ও সচেতন নাগরিক গড়ে তোলা সম্ভব হবে।

পরিশেষে বলা যায় যে, মৌলানা আজাদের শিক্ষাগত দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অগ্রগামীমূলক। উক্ত বৈশিষ্ট্যগুলি বিশ্লেষণ করে বলা যায়, তিনি ভারতের সকল জনগণের চাহিদার কথা মাথায় রেখেই তার শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছিলেন।

আরও পড়ুন – রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রশ্ন উত্তর

একাদশ শ্রেণির কলা বিভাগের যে কোনো প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন। কোনো উত্তর না পেলে আমাদের কমেন্ট বক্সে জানান।

Leave a Comment