মনুর মতে ধর্মের শ্রেণিবিভাগ সংক্ষেপে আলোচনা করো
মনুর মতে ধর্ম
ভারতীয় নীতিশাস্ত্রে সর্বপ্রথম মনু ধর্মকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন। যথা- (ক) সাধারণ ধর্ম (খ) বর্ণাশ্রম ধর্ম। নিম্নে এই দুটি ধর্ম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হল—
সাধারণ ধর্ম বা সামান্য ধর্ম
সমাজে সাধারণ বা সার্বিকভাবে পালনীয় ধর্মকেই বলা হয় সাধারণ ধর্ম। এই ধর্ম সামাজিক অবস্থান, ব্যক্তিগত সামর্থ্য, সামাজিক মর্যাদা (ধনী ও দরিদ্র), বর্ণ (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র), লিঙ্গ (পুরুষ ও স্ত্রী) নির্বিশেষে সব মানুষের ক্ষেত্রে পালন করা বাধ্যতামূলক। সাধারণ ধর্ম কতগুলি সার্বিক নৈতিক নিয়মের কথা বলে যা সমাজকে কল্যাণ ও সমৃদ্ধির দিকে অগ্রসর হতে সহায়তা করে। সহজ কথায় মানুষ হিসেবে মানুষের যা কর্তব্য তাই হল সাধারণ বা সামান্য ধর্ম। এই সাধারণ ধর্মগুলিকে বলা হয়েছে ঈশ্বর নির্দেশিত বিধান।
মনুসংহিতায় সাধারণ ধর্ম
মনুসংহিতায় দশটি সাধারণ ধর্মের উল্লেখ পাওয়া যায়। এগুলি হল- ধৃতি (নিজের প্রতি অবিচল নিষ্ঠা), ক্ষমা (অপরাধ মার্জনা অর্থাৎ অপরাধীর অপরাধকে মার্জনা করলে অপরাধীর মধ্যে অনুশোচনা বোধ জন্মায়, যার ফলে তার বিবেক তাকে সংশোধন হওয়ার কথা বলে), দম (সহনশীলতা), (১) অন্তেয় (পরদ্রব্য অপহরণ না করা বা পরদ্রব্যে লোভ না করা), শৌচ (দৈহিক ও মানসিক শুচিতা), (দ) ইন্দ্রিয়নিগ্রহ (ইন্দ্রিয়সংযম বা ইন্দ্রিয়কে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখা), দধী (বিচারশক্তি), না বিদ্যা (জগৎ সম্পর্কে তথ্যমূলক জ্ঞান, আত্মজ্ঞান), সত্য (জগৎ প্রকাশক রূপ সত্য যা ঋতের ন্যায় অপরিণামী), অক্রোধ (ক্রোধহীনতা)। এইগুলিকে সামাজিক মানুষের পালনীয় কর্তব্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই কর্তব্যগুলি ব্যক্তিমানুষের উন্নতি ও আত্মশুদ্ধির জন্য পালনীয় বলে মনে করা হয়।
বর্ণাশ্রম ধর্ম
বর্ণাশ্রম ধর্ম হল মানুষের বিভিন্ন সামাজিক অবস্থানগত একটি ধর্মকেন্দ্রিক বর্ণ ব্যবস্থা। বর্ণধর্ম ও আশ্রমধর্মের মিলিত রূপই হল বর্ণাশ্রম ধর্ম। এখানে বর্ণ বলতে মানুষের মনস্তাত্ত্বিক প্রবণতাকে বোঝানো হয়েছে। এই প্রবণতা অনুযায়ী মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নির্ধারিত হয়। প্রতিটি মানুষের চরিত্রের মধ্যে সত্ত্ব, রজো এবং তমো গুণের সমন্বয় থাকে। কিন্তু গুণগুলি প্রত্যেকের মধ্যে সমভাবে থাকে না। এই গুণগুলির প্রাবল্যের তারতম্য অনুসারে সামাজিক মানুষের মধ্যে বিভিন্ন প্রকার বর্ণভেদ করা হয়েছে।
বর্ণধর্ম
বর্ণভেদের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাচীন সমাজে চতুর্বর্ণের সৃষ্টি হয়। সেগুলি হল-
ব্রাহ্মণ: ব্রাহ্মণদের মধ্যে সত্ত্বগুণের প্রাবল্য থাকায় তাদের পালনীয় ধর্ম হল ব্রাহ্মণ্য ধর্ম। এদের পালনীয় ধর্ম কর্তব্য হল- পঠন, যাজন, যজন, দান ও প্রতিগ্রহ (দান গ্রহণ করা)।
ক্ষত্রিয়: ক্ষত্রিয়দের মধ্যে সত্ত্ব গুণ মিশ্রিত রজোগুণের প্রাবল্য থাকায় তাদের পালনীয় ধর্ম হল ক্ষাত্রধর্ম। এদের পালনীয় কর্তব্য হল- আত্মিক দৌর্বল্য পরিত্যাগ করে রাজধর্ম রক্ষা করা, প্রজাপালন করা, অসাধু ও দুষ্কৃতি দমন করা, অসহায় ব্যক্তিকে রক্ষা করা, যুদ্ধ করা ইত্যাদি।
বৈশ্য: বৈশ্যদের পালনীয় স্বধর্মকে বৈশ্য ধর্ম বলা হয়। রজো প্রধানভাবে ও তমো অপ্রধানভাবে থাকলে সেই মানব প্রকৃতির নাম বৈশ্য প্রকৃতি। এদের পালনীয় কর্তব্য হল- কৃষি, গো- পালন এবং সামাজিক অর্থনীতিকে সচল রাখা ইত্যাদি।
শূদ্র: শূদ্রদের পালনীয় স্বধর্মকে শূদ্র ধর্ম বলা হয়। শূদ্রদের মধ্যে রজোগুণ মিশ্রিত তমোগুণের প্রাবল্য থাকে। এদের পালনীয় ধর্ম বা কর্তব্য হল- উপরের তিন সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষদের পরিচর্যা করা।
আশ্রমধর্ম
বৈদিক শাস্ত্রসমূহে মানুষের জীবনকে চারটি পর্ব বা পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছে। এর এক-একটি পর্যায়কে অভিহিত করা হয়েছে ‘আশ্রম’ নামে। জীবনের এই পর্যায়গুলির নাম হল ব্রহ্মচর্য্য, গার্হস্থ্য, বাণপ্রস্থ ও সন্ন্যাস। এগুলিকে একত্রে বলা হয় চতুরাশ্রম। জীবনের বিভিন্ন পর্ব বা বিভিন্ন আশ্রমে পালনীয় কর্তব্যসমূহকে বলা হয় আশ্রমধর্ম।
পরিশেষে বলা যায়, ধর্ম জীবনের সকল লক্ষ্যকে সঠিকভাবে পরিচালিত করে ব্যক্তি ও সমাজকে কল্যাণের পথে নিয়ে যায়। সুতরাং বলা যায় জীবনের প্রতিটি স্তরে ধর্মের গুরুত্ব ও প্রভাব অপরিসীম এবং মানবজীবনের সাফল্য ও শান্তির এক নির্ভরযোগ্য চাবিকাঠি হল ধর্ম।
আরও পড়ুন – যুক্তিবিজ্ঞানের প্রকৃতি – অবরোহ এবং আরোহ