মঠজীবনবাদ বলতে কী বোঝো
মঠজীবনবাদ
ঐতিহ্যের পরিবর্তনের ধারায় মধ্যযুগীয় ইউরোপের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল মঠজীবনবাদের প্রসার। খ্রিস্ট ধর্মের বিকাশলাভের ক্ষেত্রে যেসকল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল, তার মধ্যে অন্যতম ছিল মঠ বা সংঘ। আর এই খ্রিস্টীয় মঠগুলিকে কেন্দ্র করে মধ্যযুগের সন্ন্যাসীদের যে বিশেষ জীবনযাপন ও কর্মপদ্ধতি গড়ে উঠেছিল, তা মঠজীবনবাদ (Monasticism) নামে পরিচিত।
(1) নামকরণ: মঠজীবনবাদ বা Monasticism শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে Monk শব্দটি থেকে। Monk শব্দটির উৎপত্তি গ্রিক শব্দ Monakos থেকে, যার অর্থ হল Solitary বা নিঃসঙ্গ। মূলত ধর্মীয় প্রেরণায় একটি প্রতিষ্ঠানের অংশ হয়ে যাঁরা নিভৃতভাবে কৃচ্ছসাধনের মধ্যে দিয়ে সন্ন্যাস জীবনযাপন করতেন, তাঁদের Monk বলা হত।
(2) উৎপত্তি ও বিকাশ: সাধারণভাবে মনে করা হয়, ইউরোপে খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকে মঠজীবনবাদের উদ্ভব হয়েছিল। খ্রিস্ট ধর্মে মঠজীবনের অন্যতম প্রবক্তারা ছিলেন সেন্ট অ্যান্টনি (Saint Anthony) ও সেন্ট প্যাকোমিয়াস (Saint Pachomius) | রোমান সাম্রাজ্যের পতন, জার্মান উপজাতি ও হুনদের ক্রমাগত আক্রমণ, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে নৈতিক অবক্ষয়, জিশুখ্রিস্টের বাণী ইত্যাদি নানান উপাদান মঠজীবনবাদের উৎপত্তি ও বিকাশে বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল।
(3) মঠজীবনবাদের বিভিন্ন পর্যায়: খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতক থেকেই খ্রিস্টান মুক্তিসাধকেরা দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত ছিলেন। যথা- অ্যাঙ্কোরাইটস (Anchorites) -এই ধরনের সন্ন্যাসীরা নিভৃতে নিঃসঙ্গতার মধ্যে অধ্যাত্মচর্চায় বিশ্বাসী ছিলেন এবং সিনোবাইটস (Cenobites)- যাঁরা সমাজ ত্যাগ করলেও যৌথভাবে ধর্মানুশীলনে বিশ্বাসী ছিলেন। উভয় সম্প্রদায়ই আবার আনুষ্ঠানিক ধর্মাচরণ বা যাজকদের মধ্যস্থতায় বিশ্বাসী ছিলেন না। পরবর্তীকালে অ্যাঙ্কোরাইট সম্প্রদায়ও যৌথভাবে সাধনার পথ ধরেন।
(4) মঠজীবনের নিয়মকানুন: মঠজীবনে শৃঙ্খলারক্ষার জন্য কিছু নিয়মকানুন প্রবর্তনের প্রয়োজন দেখা দেয়। পূর্ব ইউরোপীয় মঠবাসীদের সংঘবদ্ধ জীবনের উপযোগী কিছু নিয়মকানুন সর্বপ্রথম প্রচলন করেন সেন্ট বেসিল (Saint Basil) নামক একজন সন্ন্যাসী। আবার সেন্ট বেসিলের নিয়মকানুন অনুসরণ করে সেন্ট বেনেডিক্ট পশ্চিম ইউরোপীয় মঠবাসীদের জন্য বিখ্যাত বেনেডিক্টীয় বিধি চালু করেন।
(5) প্রভাব: সমকালীন ইউরোপীয় সমাজে মঠজীবনবাদের বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়, যেমন- খ্রিস্ট ধর্মের প্রসারে মঠগুলি বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল। মঠবাসীরা পোপের অবস্থানকে সুদৃঢ় করেছিলেন। মঠবাসী সন্ন্যাসীরা ধর্মচর্চা ও বিদ্যাচর্চাকে অভিন্ন দৃষ্টিতে দেখতেন, তাই তাঁরা প্রাচীন অনেক মূল্যবান দলিলপত্র ও গ্রন্থের অনুলিপি তৈরি করেন। কৃষিকাজ, খাদ্য উৎপাদন, খাদ্য সংরক্ষণ, খাদ্য পরিবহন ইত্যাদি বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়ে মঠবাসী সন্ন্যাসীরা মধ্যযুগের স্থবির অর্থনীতিকে গতিশীল করে তুলেছিলেন। অনাথকে আশ্রয়দান, অসুস্থ মানুষকে সেবা, বৃদ্ধ ও দুঃস্থকে সাহায্য করার মতো মানবতামূলক কাজের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন মঠবাসী সন্ন্যাসীরা।
মন্তব্য
তবে মঠবাসী সন্ন্যাসীদের কর্মকাণ্ড পুরোপুরি সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। তাঁরা অত্যন্ত গোঁড়া ও অসহিষু ছিলেন। এমনকি তাঁরা যে কল্যাণকর কাজগুলি করতেন, তা পুরোপুরি নিঃস্বার্থ ছিল না। সেই কারণেই মঠজীবনবাদের আদর্শকে আবার নতুন করে প্রতিষ্ঠার জন্য দশম শতকে শুরু হয় ক্লুনির সংস্কার আন্দোলন।
আরও পড়ুন –
১। সামন্ততন্ত্র বলতে কী বোঝায়?
২। ইউরোপের সামন্ততন্ত্রের বৈশিষ্ট্যগুলি কী ছিল?
৩। ‘ফিফ’ ও ‘শিভালরি বলতে কী বোঝো?
৪। সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার পতনের কারণ সম্পর্কে লেখো।
৫। ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের ইতিবাচক প্রভাবগুলি কী ছিল?
৬। ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের নেতিবাচক প্রভাবগুলি কী ছিল?
৭। পোপতন্ত্রের বিকাশের কারণগুলি লেখো।
৮। ইউরোপে মধ্যযুগকে ‘অন্ধকার যুগ (Dark Age) বলা কতটা যুক্তিসঙ্গত