ভারতীয় নীতিবিদ্যায় পুরুষার্থরূপে ধর্মের বিষয়টি সংক্ষেপে উল্লেখ করো
ধর্ম
ভারতীয় নীতিবিদ্যায় চার প্রকার পুরুষার্থ স্বীকৃত হয়েছে। যথা- ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ। এই চতুর্বিধ পুরুষার্থের মধ্যে ধর্মই প্রধান। যেহেতু ভারতীয় নীতিবিদ্যা তথা বৈদিক সমাজ ও সেই সমাজের নিয়মাবলির মূল ভিত্তি হল ধর্মনীতি।
‘ধর্ম’ কথার অর্থ
ভারতীয় নীতিশাস্ত্রে ‘ধর্ম’ কথাটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। ‘ধর্ম’ মানে ‘Religion’ নয়। পাশ্চাত্য দর্শনে ‘Religion’ বলতে বিশেষ কিছু যেমন- ঈশ্বরে বিশ্বাস ও আচরণকে বোঝায়। অর্থাৎ একটা অতীন্দ্রিয় উচ্চতর শক্তির প্রতি বিশ্বাসকে বোঝায় (Belief in the existence of a supernatural ruling power.) I
কিন্তু ভারতীয় নীতিশাস্ত্রে ‘ধর্ম’ বলতে এমন কিছু সদাচারকে বোঝায়, যা ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে অবশ্য পালনীয়। সেখানে ঈশ্বরে বিশ্বাস থাকা আবশ্যিক নয়। যেমন-বৌদ্ধ ও জৈন দর্শন ঈশ্বরবিহীন ধর্ম, সাংখ্য এবং মীমাংসা দর্শন নিরীশ্বরবাদী হলেও এখানে সুনীতি ও সদাচার পালনের কথা বলা হয়েছে।
পুরাণে ধর্মের দুটি অর্থের উপর আলোকপাত করা হয়েছে- (ক) ‘ধর্ম’ বলতে তাকেই বোঝানো হয়েছে যার থেকে পার্থিব ও অপার্থিব সম্পদ উভয়ই পাওয়া যায়। (খ) ‘ধর্ম’ হল তাই, যা ধারণ করে অর্থাৎ স্থিতি যার উপর নির্ভরশীল।
‘ধৃ’ ধাতুর সঙ্গে ‘মন’ প্রত্যয় যোগ করে ‘ধর্ম’ শব্দটি নিষ্পন্ন হয়েছে। ‘ধৃ’ ধাতুর অর্থ ধারণ করা। “ধারণাৎ ধর্মম্ ইত্যাহুঃ।” যা বিশ্বের শৃঙ্খলাকে রক্ষা করে তাই ধর্ম। “ধর্ম বিশ্বজগতঃ প্রতিষ্ঠা।” হিন্দুধর্মে উক্ত আছে- “যেন আত্মনঃ তথা অন্যেষাং জীবনং বর্ধনাঞাপি ধৃয়তে স ধর্মঃ।” অর্থাৎ যার দ্বারা নিজের এবং অপরের জীবন ও সমৃদ্ধি বিধৃত হয়, তাই ধর্ম।
ধর্মের বৈশিষ্ট্য
বিভিন্ন শাস্ত্র ও দার্শনিকদের বক্তব্য থেকে ধর্মের যে বৈশিষ্ট্যগুলি পাই সেগুলি হল-
(ক) ঋগ্বেদে ঋতকে ধর্ম বলা হয়েছে। যে সমাজ ধর্মের প্রতি যত শ্রদ্ধাশীল, সে সমাজ তত সুরক্ষিত। যে সমাজে ধর্মকে শ্রদ্ধা করা হয় না, সে সমাজ তত ক্ষতিকারক। “ধর্ম এব হতো হন্তি, ধর্মো রক্ষতিরক্ষিতঃ।”
(খ) মনুস্মৃতিতে ধর্মের বৈশিষ্ট্য সবথেকে ভালো বলা হয়েছে-
"সত্যং বৃয়াৎ প্রিয়ং বৃয়াৎ ন বৃয়াৎ সত্যম্ অপ্রিয়ম্ প্রিয়ং চ নানৃতম ব্রুয়াৎ এষঃ ধর্মঃ সনাতনঃ।” (৪/১৩৮)
অর্থাৎ অপরকে আঘাত না করে যা সত্য ও প্রিয় তা বলা উচিত। যদিও অপ্রিয় সত্য বলা উচিত নয়। প্রিয় না হলেও মিথ্যা বলা উচিত নয়। সনাতন ধর্ম এই কথাই বলে।
(গ) মনুসংহিতায় আরও বলা হয়েছে- প্রাণীদের পীড়া না দিয়ে ক্রমে ক্রমে ধর্ম সঞ্চয় করা উচিত। অপরকে আঘাত না দিয়ে মধুর ও পরিশীলিত বাক্যের দ্বারা ধর্ম শিক্ষা দেওয়া উচিত।
(ঘ) মনুর ধর্মের ধারণাই আরও সুস্পষ্টভাবে মহাভারতে বলা হয়েছে- ধর্ম হল যা জগতে কল্যাণ ও অহিংসা আনয়ন করে।
(ঙ) মনুস্মৃতিতে আরও উক্ত আছে-
"বেদঃ স্মৃতিঃ সদাচারঃ স্বস্য চ প্রিয়মাত্মনঃ। এতচ্চতুর্বিধং প্রাহুঃ সাক্ষাৎ ধর্মস্য লক্ষণম্।।” (২/২১)
অর্থাৎ বেদ, স্মৃতি, ব্যক্তির শিষ্টাচারণ ও নিজের সুখ-এই চারটি হল ধর্মের বৈশিষ্ট্য। তবে এ কথা সত্য যে ‘ধর্ম’ শব্দের নানাবিধ প্রয়োগ থাকা সত্ত্বেও পুরুষার্থের পরিপ্রেক্ষিতে ‘ধর্ম’ শব্দের ব্যবহার হয়েছে। যা মানুষকে কর্তব্য সম্পর্কে শিক্ষা দেয়। মহাভারতেও বলা হয়েছে- সদাচারই ধর্মের উৎস এবং বেদ এই ধর্মের উপরেই প্রতিষ্ঠিত।
(চ) ধর্ম একটি নৈতিক বিধি যা মানুষের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে। ‘ধর্ম’ শব্দটি ভারতীয় নীতিশাস্ত্রে মানুষের কর্তব্যকে বোঝায়। এই কর্তব্য শুধু নৈতিক নয়, এর একটি সামাজিক দিক আছে। মানুষের সমাজে তার আশ্রম ও বর্ণ অনুযায়ী কর্তব্য নির্ধারিত হয়।
আরও পড়ুন – যুক্তিবিজ্ঞানের প্রকৃতি – অবরোহ এবং আরোহ