ভারতীয় নীতিতত্ত্বে পুরুষার্থের ধারণাটি সংক্ষেপে আলোচনা করো
পুরুষার্থ
ভারতীয় দর্শনে মানব জীবনের একাধিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের কথা বলা হয়েছে, যাদের একত্রে বলা হয় পুরুষার্থ। পুরুষার্থ কতগুলি আদর্শ যা মূলত নৈতিক। ব্যুৎপত্তিগত ভাবে বলা যায় যে মানুষ যা প্রার্থনা করে, যে আদর্শকে কাম্য বা অভীষ্ট বলে মনে করে তাই পুরুষার্থ।
পুরুষার্থের প্রকার
প্রচলিত ধারণা অনুসারে পুরুষার্থ চার প্রকার- ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ। অনেকের মতে আদিতে ধর্ম, অর্থ ও কাম এই ত্রিবর্গকেই পুরুষার্থরূপে উল্লেখ করা হয়েছে। কেন-না ধর্ম, অর্থ ও কাম -এই তিনটি পুরুষার্থের আবেদন, সাধারণ মানুষের কাছে অনুভূত হয়, তাই ত্রিবর্গ মানুষের আদর্শ। কিন্তু মোক্ষ নামক পুরুষার্থ সম্পর্কে সাধারণ মানুষ যে একেবারেই অজ্ঞাত ছিল-তা নয়। পরবর্তীকালে চতুর্থ পুরুষার্থ হিসেবে মোক্ষ যুক্ত হয়েছে, এদের একত্রে চতুর্বর্গ বলা হয়।
চতুর্বর্গ
চতুর্বিধ পুরুষার্থ আমাদের প্রার্থিত। কেন-না দুঃখনিবৃত্তি ও সুখপ্রাপ্তি মানুষের মুখ্য প্রয়োজন। বিচার করলে দেখা যাবে যে প্রতিটি পুরুষার্থই দুঃখনিবৃত্তি ও সুখপ্রাপ্তির উপায়। এ কথা অনস্বীকার্য যে সাধারণ মানুষ পার্থিব সুখের কামনা করে। ‘কাম’ শব্দটি জৈবতৃয়ার নিবৃত্তিজনিত সুখকে বোঝায়। জৈব কামনা পরিতৃপ্ত হলে সুখ উৎপন্ন হয়। ‘অর্থ’ সাক্ষাৎভাবে সুখ উৎপাদন না করলেও তার দ্বারা কাম তৃপ্ত হয়।
অর্থ ও কাম মানুষের দুটি স্বাভাবিক প্রবৃত্তির নাম। অর্থ ও কাম যখন ধর্মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয় তখন যে সুখলাভ হয় তাই মানুষের কাম্য। যাই হোক অর্থ ও কাম যে পুরুষের অভীষ্ট এ কথা অস্বীকার করা যায় না।
প্রবৃত্তির ক্ষেত্রে সংযম ও নিয়ন্ত্রণ রক্ষা করাই ধর্মের কাজ। যে ব্যক্তি কাম এবং অর্থকে আকাঙ্ক্ষা করেন তিনি প্রকৃত সুখ লাভ করেন না।
ধর্ম, অর্থ ও কাম -এই ত্রিবর্গ পুরুষার্থ মানুষের বিভিন্ন কামনা- বাসনা তৃপ্ত করে। তাই এগুলি সুখের হেতুমাত্র, সাক্ষাৎ সুখ নয়। কিন্তু মোক্ষে কামনা-বাসনার পরিসমাপ্তি ঘটে। তাই মোক্ষই একমাত্র সাক্ষাৎ সুখ। সেই কারণে মোক্ষ হল ধর্ম, অর্থ ও কাম থেকে ভিন্ন। মোক্ষ হল জীবনের এমন এক পর্যায় যেখানে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয় আর নির্মোহ ও নিরাসক্ত জীবনের সূচনা হয়।
ত্রিবর্গ
ত্রিবর্গের অন্তর্গত ধর্ম, অর্থ ও কাম – এই তিনটি পুরুষার্থ একপ্রকার নয়। একমাত্র কামই মুখ্য, অর্থ ও ধর্ম গৌণ। কিন্তু চার্বাক ভিন্ন অন্যান্য দার্শনিকগণ মোক্ষকেই পরম পুরুষার্থ বলেছেন। ধর্মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত অর্থ ও কাম মানুষকে মোক্ষাভিমুখী করে।
ধর্ম, অর্থ ও কাম মানুষের কামনা সিদ্ধ করে এবং সুখ উৎপাদন করে। কিন্তু মোক্ষ কামনার অতীত অবস্থা। মোক্ষাবস্থায় কামনার সিদ্ধি ও তজ্জনিত সুখলাভের অবকাশ নেই। তাই মোক্ষ ত্রিবর্গকে পূর্ণতা দান করে এ কথা সত্য নয়। ত্রিবর্গ এবং মোক্ষের মধ্যে স্বরূপগত ব্যবধান আছে। কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে বলেছেন ধর্ম, অর্থ ও কাম এই ত্রিবর্গই সাধনা করা উচিত। কিন্তু অর্থ ও কাম যদি ধর্মের অনুশাসনের বিরোধী হয় তাহলে তাদের পরিত্যাগ করা উচিত। এর থেকে বোঝা যায় যে ধর্মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত কাম ও অর্থই প্রকৃত পুরুষার্থ।
পরিশেষে বলা যায়, পুরুষার্থের ধারণা একটি মানুষকে পরিপূর্ণ ও অর্থবহ জীবন কাঠামো প্রদান করে। এটি ব্যক্তিকে ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে পার্থিব সুখ অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে জীবন উপভোগ করতে উৎসাহিত করে। তবে এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, চারটি পুরুষার্থের মধ্যে মোক্ষকে পরম পুরুষার্থ বলা হলেও এটি অপর তিনটি পুরুষার্থের মতো সামাজিক আদর্শের পর্যায়ভুক্ত নয়।
আরও পড়ুন – যুক্তিবিজ্ঞানের প্রকৃতি – অবরোহ এবং আরোহ