ভাব সম্মিলন – বিদ্যাপতি | কবি পরিচিতি, উৎস, প্রেক্ষাপট, বিষয়সংক্ষেপ, নামকরণ, বিশ্লেষণ, শব্দার্থ, টীকাটিপ্পনী
ভাব সম্মিলন – বিদ্যাপতি কবি পরিচিতি
জন্ম: আনুমানিক খ্রিস্টীয় চতুর্দশ শতকে (১৩৭০ সালের কাছাকাছি সময়ে) বিদ্যাপতি জন্মগ্রহণ করেন। বিহারের দ্বারভাঙা জেলার মধুবনী মহকুমার অন্তর্গত বিসফি গ্রামে এক ব্রাহ্মণ পণ্ডিত বংশে তাঁর জন্ম।
কাব্যপ্রতিভা: বংশগত সূত্রে কিশোর বয়সেই বিদ্যাপতি মিথিলার কামেশ্বর বংশের রাজসভার সংস্পর্শে আসেন। ১৩৩৯ খ্রিস্টাব্দে রাজা শিবসিংহ তাঁকে বিসফি গ্রাম দান করেন। দেবসিংহের পৃষ্ঠপোষকতায় বিদ্যাপতি ‘ভূপরিক্রমা’ (১৪০০ খ্রি.) রচনা করেন। এটিই তাঁর প্রথম রচনা। কীর্তিসিংহের পৃষ্ঠপোষকতায় রচনা করেন ‘কীর্তিলতা’। রাজা শিবসিংহের পৃষ্ঠপোষকতায় রচনা করেন ‘কীর্তিপতাকা’ ও ‘পুরুষ পরীক্ষা’। পরবর্তী সময়ে তিনি রচনা করেন ‘শৈবসর্বস্বসার’, ‘গঙ্গাবাক্যাবলি’, দানবাক্যাবলি’, ‘বিভাগসার’, ‘লিখনাবলি’। ভৈরব সিংহের পৃষ্ঠপোষকতায় বিদ্যাপতির শেষ রচনাবলি ‘দুর্গাভক্তি-তরঙ্গিনী’ রচিত হয়। বিদ্যাপতির পদের শ্রেণিবিভাগ: বিদ্যাপতি রচিত মোট পদের সংখ্যা আনুমানিক ৯০০ টি। তাঁর পদগুলিকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা যায়
- ‘রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক পদাবলি’
- ‘হরগৌরী ও কালী বিষয়ক পদাবলি’
- ‘গঙ্গা বিষয়ক পদাবলি’
- ‘প্রহেলিকা বিষয়ক পদাবলি’
- ‘দেবতা সম্পকহীন বিভিন্ন বিষয়ক পদাবলি’।
বিদ্যাপতির পদের ভাষা: বিদ্যাপতি মিথিলার কবি ছিলেন। তাই তাঁর বহু পদ মৈথিলি ভাষায় রচিত। গবেষকদের অনুমান পরবর্তী সময়ে মিথিলায়, বাইরে থেকে শিক্ষাগ্রহণ করতে আসা বাঙালি, অসমিয়া ও ওড়িয়া ছাত্রছাত্রীদের মুখে মুখে এই পদ রূপান্তরিত হয়। এভাবেই মৈথিলি ভাষার সঙ্গে ওড়িয়া, অসমিয়া কখনও বাংলা ভাষার সংমিশ্রণে ব্রজবুলি ভাষা গড়ে ওঠে। পণ্ডিতদের অনুমান বিদ্যাপতিই এই ভাষার প্রচলন করেন।
জনপ্রিয়তা: স্বয়ং চৈতন্যদেব বিদ্যাপতির পদ আস্বাদন করতেন। ফলে পরবর্তী সময়ে বৈষ্ণব সমাজে বা তার বাইরেও ভক্তির গান হিসেবে বিদ্যাপতির রচিত পদ সমাদৃত হয়।
প্রাক্চৈতন্য যুগের অন্যতম কবি বিদ্যাপতি বাংলা সাহিত্যে চিরকাল বিরাজ করবেন। পদ রচনার জন্য তিনি ‘অভিনব জয়দেব’, ‘মৈথিল কোকিল’ প্রভৃতি অভিধায় ভূষিত হন।
ভাব সম্মিলন কবিতার উৎস
বিভিন্ন বৈষ্ণব পদসংকলনে ভাবোল্লাস পর্যায়ে এই পদ সংকলিত হয়েছে। আমরা পদটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক সংকলিত ‘বৈল্পব পদাবলী’ (চয়ন) থেকে গ্রহণ করেছি।
ভাব সম্মিলন কবিতার প্রেক্ষাপট
পাঠ্য ‘ভাব সম্মিলন’ কবিতাটি বৈয়ব পদাবলি সাহিত্যের একটি বৈষ্ণব পদ। বৈষ্ণব পদাবলি হল মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের একটি অন্যতম ধারা। রাধাকৃষ্ণের লীলা বিষয়ক ছোটো ছোটো কবিতা বা গানকে বৈষ্ণব পদ বলা হয়।
রাধাকৃষ্ণের লীলার বিভিন্ন পর্যায় আছে। যেমন- পূর্বরাগ, অভিসার, মাথুর, ভাবোল্লাস ও মিলন। এই বিভিন্ন রসপর্যায় নিয়ে নানা কবি বা পদকর্তা নানা সময়ে বহু পদ রচনা করেছেন। চৈতন্যপূর্ব যুগের কবি বিদ্যাপতি ‘ভাবোল্লাস ও মিলন’ পর্যায়ে যেসব পদ রচনা করেছেন সেগুলির মধ্যে পাঠ্য ‘ভাব সম্মিলন’ কবিতাটি অন্যতম।
কংসবধের জন্য কৃষ্ণ বৃন্দাবন ছেড়ে মথুরায় চলে যান। তখন প্রিয়তমের জন্য বিচ্ছেদ বেদনায় কাতর হয়ে পড়েন রাধা। শ্রীকৃষ্ণ আর বৃন্দাবনে ফিরে আসেননি, কিন্তু শ্রীকৃষ্ণকে পাওয়ার জন্য ভাবের জগতে হারিয়ে গিয়েছিলেন শ্রীরাধিকা। তাই মনোজগতে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন তিনি। প্রবল বিরহ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে অন্তরের মধ্যেই নিত্যদিন মিলনের আশায় থাকতেন রাধা। এই মিলনে শ্রীকৃষ্ণকে হারিয়ে ফেলার কোনো ভয় নেই।
দীর্ঘদিন কৃষ্ণকে কাছে না পেয়ে বিরহে কাতর রাধা, কৃষ্ণকে নিজের অন্তরের মধ্যে ফিরে পাওয়ার পর, তাঁর মনে মিলনের যে উল্লাস জেগে উঠেছে, সেই আনন্দ প্রকাশ করতেই বিদ্যাপতির এই পদ রচনা। রাধা তাঁর সেই আনন্দ উপলব্ধি প্রকাশ করেছেন তাঁর সখীদের কাছে এবং বিদ্যাপতির লেখনী তা পৌঁছে দিয়েছে আমাদের কাছে।
ভাব সম্মিলন কবিতার বিষয়সংক্ষেপ
পাঠ্য ‘ভাব সম্মিলন’ পদটিতে বিদ্যাপতি দেখিয়েছেন, মানসলোকে কাঙ্ক্ষিত প্রিয় কৃষ্ণকে লাভ করে রাধার মনে অপরিসীম সুখানুভূতির প্রকাশ ঘটেছে। কৃষ্ণ, জগৎ রক্ষার জন্য বৃন্দাবন ছেড়ে চিরতরে চলে গিয়েছেন মথুরায়। তাই রাধার হৃদয়বেদনা তীব্র হয়ে উঠেছে। যন্ত্রণাদগ্ধ রাধা, কৃষ্ণের ধ্যানে তন্ময় হয়ে মানসলোকে পেয়েছেন প্রিয়ের সান্নিধ্য। তাই সখীদের সম্বোধন করে রাধা বলছেন যে, তাঁর আনন্দের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। কারণ তাঁর প্রিয়তম কৃষ্ণ বহুদিন পরে মথুরা থেকে ফিরে এসেছেন তাঁর কাছে।
বহু চান্দ্রমাস ধরে প্রেমময় চাঁদের আলো শ্রীরাধিকাকে তাঁর প্রিয়ের কথা মনে করিয়ে কষ্ট দিয়েছে। কিন্তু এখন তিনি নিজের ভাবজগতে সবসময় প্রিয়ের মুখ দর্শন করে সব দুঃখ ভুলে সমপরিমাণ সুখ পাচ্ছেন। তাই রাধা আঁচল ভরে মহা-ধনরত্ন পেলেও প্রিয় কৃষ্ণকে আর দূর-দেশে যেতে দেবেন না।
কৃষ্ণপ্রেম তাঁর অস্তিত্ব রক্ষার জন্য অপরিহার্য বলে মনে করেছেন শ্রীরাধিকা। তাই কৃষ্ণকে কখনও শীতের আচ্ছাদন, কখনও গ্রীষ্মের দিনের সুশীতল বাতাস, বর্ষার প্রয়োজনীয় ছাতা, কখনও বা অকূল সমুদ্রের সহায় নৌকার সঙ্গে তুলনা করে, তাঁর জীবনে কৃষ্ণের অপরিহার্যতাকে বোঝাতে চেয়েছেন।
তাই কবি বিদ্যাপতি কৃষ্ণপ্রেমের গভীরতা উপলব্ধি করে বলছেন, ভালোমানুষের দুঃখ দু-চার দিনের বেশি থাকে না। তাই স্বল্প সময়ের এই { দুঃখকে অতিক্রম করতে পারলেই শ্রীরাধিকা সুখের সন্ধান পাবেন।
ভাব সম্মিলন কবিতার নামকরণ
ভূমিকা: কোনো কবিতার ভাববস্তু বা ব্যঞ্জনা থেকে বোঝা যায় সেই কবিতার শিরোনাম যথাযথ কি না। চৈতন্যপূর্ব যুগের কবি বিদ্যাপতি মূলত বৈল্পব পদকর্তা রূপেই বিখ্যাত ছিলেন। বিভিন্ন রসপর্যায়ের প্রচুর পদ রচনা করলেও বিদ্যাপতি কোনো পদেরই নামকরণ করেননি। পরবর্তীকালে বৈয়বদর্শন অনুযায়ী ভাব ও রস বিচার করে পদগুলিকে বিভিন্ন লীলা পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছে।
সারবস্তু: পাঠ্য ‘ভাব সম্মিলন’ কবিতাটি ‘ভাবোল্লাস ও মিলন’ পর্যায়ের অন্তর্গত। এই পর্যায়েই ঘটে রাধাকৃষ্ণের ভাবসম্মিলন। বৃন্দাবনে একসময় রাধাকৃষ্ণের নিত্য সাক্ষাৎ, অভিসার, মিলন ঘটত। তারপর একসময় বিচ্ছেদ ঘটে তাঁদের। কর্তব্য পালনের জন্য মথুরায় চলে যান কৃষ্ণ। কৃষ্ণবিচ্ছেদে বিরহে কাতর হন রাধা। কৃষ্ণের বিরহে শ্রীরাধিকার রূপলাবণ্য মলিন হতে থাকে ক্রমশ। মৃতবৎ জীবন যাপন করতে থাকেন তিনি। এই সময় শ্রীরাধিকা উপলব্ধি করেন কৃষ্ণ আসলে তাঁর মনের মধ্যেই বিরাজ করছেন। এই বিরহযন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র উপায় হল মনের মধ্যেই তাঁদের নিত্যমিলন। তাই শ্রীরাধিকার ভাবলোকে শ্রীকৃষ্ণের ফিরে আসায় রাধার মনে জাগে ভাবোল্লাস। বিচ্ছেদের হাহাকার পেরিয়ে তাঁদের ভাবসম্মিলন ঘটেছে। সার্থকতা বিচার: বৈয়ব কবিরা জানেন যে, রাধাকৃষ্ণ হলেন প্রেমের যুগলমূর্তি। ভক্তের কল্পনায় তাঁরা কখনোই বিচ্ছিন্ন নন। অভিন্ন সত্তা। তাই সাময়িক বিচ্ছেদের পর পুনরায় যে রাধাকৃষ্ণের মিলন ঘটবে, তারই নাম ভাবসম্মিলন। অতএব, উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের দেওয়া ‘ভাবসম্মিলন’ নামটি আলোচ্য কবিতাটির ক্ষেত্রে যথাযথ ও ব্যঞ্জনাধর্মী।
ভাব সম্মিলন কবিতার তাৎপর্যমূলক বিশ্লেষণ
নায়ক-নায়িকার মিলিত বা সংযুক্ত হওয়াকে মিলন বলা হয়। ভাবসম্মিলন রাধাকৃষ্ণের প্রত্যক্ষ দর্শনজাত মিলন নয়। বৈষ্ণব পদাবলিতে দেখা যায়, রাধা তাঁর ভাবজগতে কৃষ্ণের সঙ্গে মিলনের অপরিসীম আনন্দ উপভোগ করেছেন। বৈষ্ণব পদাবলিতে রাধাকৃষ্ণ প্রেমের এই পর্যায়টিকে তাই বৈয়ব আলংকারিকগণ ‘ভাবসম্মিলন’ বা ‘ভাবোল্লাস’ বলে চিহ্নিত করেছেন।
ভাবসম্মিলন মিলনের একটি বিশেষ স্তর। যদিও ‘উজ্জ্বলনীলমণি’ গ্রন্থে শ্রীরূপ গোস্বামী এই রসপর্যায় নিয়ে কোনো কথা বলেন নি, তবু বৈষ্ণবপদসাহিত্যে ভাবসম্মিলনের বিশেষ গুরুত্ব আছে। দীনবন্ধু দাস লিখেছেন
"মথুরা হইতে ব্রজে নাহি আগমন। স্বপ্ন সন্দর্শনে মাত্র জানিহ সঙ্গম।।"
অর্থাৎ বিরহিনী রাধার ‘কৃয়তন্ময় অবস্থার এক অপূর্ব কল্পনা’ হল ‘ভাবসম্মিলন’। চৈতন্য পূর্বযুগের বৈষ্ণবপদকর্তা বিদ্যাপতি এই পর্যায়ের পদ রচনায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
পাঠ্য ‘ভাব সম্মিলন’ পদটিতে বিদ্যাপতি দেখিয়েছেন ভাবলোকে রাধা প্রিয় কৃষ্ণকে পেয়ে অপরিসীম আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠেছেন। সখীর কাছে তিনি তাঁর সীমাহীন সুখানুভূতি প্রকাশ করেছেন। কৃষ্ণ বৃন্দাবন ছেড়ে চিরকালের জন্য চলে গিয়েছিলেন মথুরায়। তারপর রাধা দীর্ঘ বিরহযন্ত্রণা ভোগ করে কৃষুধ্যানে মগ্ন হয়ে অন্তরে উপলব্ধি করেছেন প্রিয়ের অন্তহীন সান্নিধ্য। দুঃখকে অতিক্রম করে তাই কাঙ্ক্ষিত সুখের নাগাল রাধা পেয়েছেন মানস বৃন্দাবনে। তাই আর কৃষ্ণকে হারানোর ভয় নেই তাঁর। সখীকে সেই আনন্দ উপলব্ধির কথাই জানিয়েছেন রাধা।
রাধার বিরহজনিত দুঃখবেদনা সত্য, কিন্তু তা একমাত্র সত্য বলে মেনে নিতে পারেননি বিদ্যাপতি। তাই বিদ্যাপতি ভক্ত হৃদয়ের ভাবলোকে তাঁদের মিলন সম্পন্ন করিয়েছেন। এই অরূপ ভাবের জগতে রাধা ও কৃষ্ণের একই সত্তায় মিশে যাওয়াই ভাবসম্মিলন।
কাহিনির ক্ষেত্রে অভিনবত্বের পাশাপাশি বিদ্যাপতি কবিতার আঙ্গিকেও দক্ষতার পরিচয় রেখেছেন।
আমরা জানি, কবি বিদ্যাপতির সৃষ্ট ব্রজবুলি ভাষা অনন্য। ব্রজবুলি হল বাংলা মৈথিলি ও অবহট্ট ভাষার মিশ্রণে গড়ে ওঠা এক কৃত্রিম কাব্য ভাষা। বিদ্যাপতির আলোচ্য কবিতাটি ব্রজবুলি ভাষায় রচিত।
এ ছাড়াও কবিতার প্রতিটি পঙক্তিতে আমরা দেখি অন্ত্যমিলযুক্ত চমৎকার ধ্বনি ঝংকারের ব্যবহার, যা কবিতাটিকে শ্রুতিমধুর করেছে। যেমন- ‘আনন্দ ওর’, ‘মন্দিরে মোর’, ‘যত দুখ দেল’, ‘তত সুখ ভেল’, ‘গীরিষির বা’, ‘দরিয়ার না’ ইত্যাদি।
শ্রীকৃষ্ণ হলেন শ্রীরাধিকার জীবনের একমাত্র সম্বল, মহামূল্যবান সম্পদ। একথা বোঝানোর জন্য বিদ্যাপতি ‘শীতের ওঢ়নী’, ‘বরিষার ছত্র’, ‘দরিয়ার না’ ইত্যাদি নানা বস্তুগত উপমা ও নিরঙ্গ রূপক অলংকারের যথাযথ প্রয়োগে কবিতার ব্যঞ্জনধর্মীতাকে স্পষ্ট করে তুলেছেন।
এ ছাড়া অপূর্ব দক্ষতায় বিদ্যাপতি প্রত্নমাত্রাবৃত্ত বা প্রত্নকলাবৃত্ত ছন্দে, কবিতাটির কাব্যসৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলেছেন। আধ্যাত্মিকতা বাদ দিয়েও প্রেমকাব্যরূপে এই কবিতাটি সাহিত্যগুণে সমৃদ্ধ।
ভাব সম্মিলন কবিতার শব্দার্থ
কহব: বলব/ বর্ণনা করব। রে: ওরে, সম্বোধনবাচক অব্যয় বিশেষ। সখি: সহচরী/সঙ্গিনী। আনন্দ: সুখ, হর্ষ, আহ্লাদ, স্ফূর্তি। ওর: সীমা/শেষ/অবধি/কিনারা। চিরদিনে: দীর্ঘকাল পর/বহুদিন পরে। মাধব: শ্রীকৃষ্ণ। মন্দিরে : গৃহে/ঘরে। ভাদ/চন্দ্র অর্থে। দেল: দিল। পিয়া- মুখ: প্রিয়ের মুখ। দরশনে: দর্শনে/দেখে। মোর: আমার। ডেল: হইল/হল (এটি ব্রজবুলি ভাষায় সুধাকর: কবিতায় ক্রিয়াপদ বিশেষ)। ভরিয়া: ভরে, ভর্তি করে। মহানিধি: মহৈশ্বর্য/মহামূল্যবান রত্ন। তব: তাহলে। হাম: আমি। ছত্র: ছাতা। পিয়া: প্রিয় (শ্রীকৃয়)। আঁচর: আঁচল। ওঢনী: ওড়না/গাত্রাবরণ/উত্তরীয়/চাদর। গীরিষির: গ্রীষ্মের গরমকালের। বা: বায়ু/বাতাস। বরিষার: বর্ষার। দরিয়ার: নদীর। না: (নাও অর্থে) নৌকা/তরী। ভণয়ে: বলে/বর্ণনা করে। সুন: শোনো। বরনারি: শ্রেষ্ঠ রমণী/সুন্দরী। দুজনের (এর বিভক্তি যুক্ত হয়েছে)। দুখ দুঃখ। দিবস: দিন। দুই-চারি: দুইচার দিন, স্বল্প সময়।
ভাব সম্মিলন কবিতার টীকাটিপ্পনী
ব্রজবুলি: ব্রজবুলি হল এক ধরনের শ্রুতিমধুর কোমল কৃত্রিম মিশ্রভাষা। মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে মৈথিলি, ওড়িয়া, অসমিয়া ও বাংলার মিশ্রণের ফলে ব্রজবুলি ভাষার সৃষ্টি হয়। পণ্ডিতদের মতে বিদ্যাপতিই এই ভাষার স্রষ্টা। ‘ব্রজের বুলি’ অর্থাৎ মথুরা-বৃন্দাবনের ভাষা, পশ্চিমা অপভ্রংশের কথ্য ভাষা ইত্যাদি। এই ভাষা নিয়ে নানাবিধ মতান্তর গবেষকদের মধ্যে আছে। চৈতন্য-পরবর্তী সময়ের কবিরা এই ভাষায় পদ রচনা করেন। গোবিন্দদাস কবিরাজ, বলরামদাস, রায়শেখর এবং পরবর্তীকালে রাধামোহন ঠাকুর ব্রজবুলি ভাষায় পদ রচনা করে কৃতিত্ব দেখান।
ভাবসম্মিলন: ভাবসম্মিলন বা ভাবোল্লাস বলতে বোঝায় শ্রীরাধিকার মানসলোকে রাধা ও কৃষ্ণের সম্মিলন। কৃষ্ণ মথুরায় চলে গেলে রাধা অত্যন্ত মানসিক যন্ত্রণা পান। কৃষ্ণ রাধাকে চিরতরে ত্যাগ করে চলে যাওয়ার পর তাঁদের মিলনের আর কোনো সম্ভাবনা থাকে না। রাধা তখন তাঁর মানসলোকে কৃষ্ণের উপস্থিতি কল্পনা করেন। বাস্তবে দেখা না হলেও মানসলোকে কৃষ্ণের সঙ্গে রাধার কাল্পনিক মিলন ঘটে প্রতিদিন। এই কাল্পনিক মিলনকেই ভাবোল্লাস বা ভাবসম্মিলন বলে।
সখি (সখী): রাধাকৃষ্ণের সর্বসময়ের সহচরী হলেন সখীরা। সখীদেরকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। এঁদের মধ্যে ‘সাধারণী’ হলেন যাঁরা কৃষ্ণের রূপলাবণ্য দর্শন করে বাসনা তৃপ্ত করেন, যেমন- কুজা। ‘সমঞ্জুসা’ হলেন যাঁরা কৃষ্ণের গুণের কথা শুনে তাঁকে পাওয়ার বাসনা তৃপ্ত করেন, যেমন- রুক্মিণী, সত্যভামা। ‘সমর্থা’ হল যেসব সখী সমাজ-সংসার ত্যাগ করে ভগবানরূপী কৃষ্ণের সেবায় নিজেদের নিয়োগ করেন। এই রূপের সখীরা হলেন ললিতা, বিশাখা, চন্দ্রাবলী, শ্রীরাধা। এঁরাই কৃষ্ণের নিত্যপ্রিয়া। এই নিত্যপ্রিয়াদের মধ্যে চন্দ্রাবলী ও রাধার আসন উচ্চতর। সখীদের মধ্যে একমাত্র রাধাই হ্লাদিনী শক্তির অধিকারী। সখীদের মধ্যে তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ।
বিদ্যাপতি: বাংলা সাহিত্যে কবি বিদ্যাপতি প্রধানত পদাবলি রচয়িতা হিসেবে পরিচিত। পদাবলি সাহিত্যে বিদ্যাপতি প্রেম ও সৌন্দর্যের রূপকার। তাঁর রচিত রাধাকৃষ্ণের পদ বাংলা সাহিত্যের পরম সম্পদ। তাঁর অঙ্কিত প্রেমের সঙ্গে জড়িয়ে আছে শ্রীরাধিকার লজ্জা, ভয়, ঈর্ষা, ছলনা, উদ্বেগ, মিলনের নানারকম মানসিক টানাপোড়েন। শ্রীরাধিকার এই নানাবিধ অনুভূতির প্রকাশের জন্যই মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব এই পদগুলি পাঠ করে আনন্দলাভ করতেন।
চিরদিনে মাধব মন্দিরে মোর: আমাদের পাঠ্য ‘ভাব সম্মিলন’ কবিতায় আমরা দেখি শ্রীরাধিকার আত্ম-উপলব্ধির কথা বর্ণনা করা হয়েছে এই পঙ্ক্তিটি দ্বারা। বাস্তবে শ্রীকৃষ্ণ কংসদমনের জন্য মথুরায় গিয়ে আর ফিরে আসেননি অর্থাৎ, বাস্তবে তাঁদের আর মিলন সম্ভব ছিল না। তাই শ্রীরাধিকার অনুভবে, তাঁর কল্পনাজগতে ফিরে এসেছেন শ্রীকৃয়। শ্রীরাধিকা ভাবলোকে অনুভব করেছেন প্রিয়র সান্নিধ্য। এই ভাবের জগৎ এমনই যেখান থেকে শ্রীকৃষ্ণের আর চলে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তাই তিনি চিরদিন শ্রীরাধিকার হৃদয় মন্দিরে বিরাজ করবেন।
পাপ সুধাকর: সুধাকর শব্দের অর্থ হল চাঁদ। চাঁদ বা চাঁদের আলো কাব্যে কবিতায় রোমান্টিকতাকে ফুটিয়ে তোলে। আলোচ্য পদেও আমরা দেখি চাঁদের আলো শ্রীরাধিকাকে তাঁর প্রিয়তমের কথা মনে করায়। কৃষ্ণের অনুপস্থিতিতে নিঃসঙ্গ রাধা বহুদিন বিরহ দুঃখে কাটিয়েছেন। মায়াবী জ্যোৎস্না বারংবার শ্রীরাধিকাকে তাঁর প্রিয়র কথা মনে করিয়েছে। প্রিয় কৃষ্ণের মথুরায় চলে যাওয়ার কষ্টকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই চন্দ্রকে পাপ সুধাকর বলা হয়েছে।
মহানিধি: ‘মহানিধি’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ হল মহামূল্যবান ধনরত্ন। পাঠ্য কবিতায় বলা হয়েছে শ্রীরাধিকা যদি আঁচল ভরে মহামূল্যবান ধনরত্নও পান তাহলেও তিনি শ্রীকৃয়কে কাছ ছাড়া করবেন না। কারণ শ্রীকৃয়ই তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ, মহান ঐশ্বর্য। তাই জাগতিক সব ধনসম্পদ শ্রীরাধিকার কাছে তুচ্ছ হয়ে গিয়েছে।
“শীতের ওঢ়নী পিয়া গীরিষির বা।/ বরিষার ছত্র পিয়া দরিয়ার না।।”: আলোচ্য পদে শ্রীরাধিকার জীবনে সময়ে-অসময়ে শ্রীকৃষ্ণ যে কতটা মূল্যবান তা বোঝাতে, বিদ্যাপতি বলেছেন- প্রিয়তম কৃষ্ণ শ্রীরাধিকার কাছে শীতের ওড়নার মতো। অর্থাৎ, প্রবল শীতে উন্নতার আশ্রয়। কখনও আবার গ্রীষ্মের দিনে সুশীতল বাতাসের মতো- যা তাঁকে প্রবল তাপে শীতলতা দেয়। কখনও বর্ষার ছাতার মতো তিনি শ্রীরাধিকাকে প্রবল ঝড়-ঝঞ্ঝা থেকে রক্ষা করেন পরম ভালোবাসায়। কখনও আবার হয়ে ওঠেন অতল সমুদ্রের বুকে পার পাওয়ার একমাত্র ভরসা নৌকার মতো। অর্থাৎ শ্রীকৃয় হলেন শ্রীরাধিকার জীবনের নিরাপদ আশ্রয়। যে তাঁর জীবনের সব দুঃখবেদনা দূর করেন।
ভণিতা: পদাবলি রচয়িতাদের পরিচয় তাঁদের নিজেদের লেখা পদেই পাওয়া যায়। প্রায় প্রত্যেক লেখক পদের শেষে নিজের নাম উল্লেখ করেন। পদের শেষে এইরকম কবির নাম-পরিচয় উল্লেখের পদ্ধতিকে ‘ভণিতা’ বলে। তবে এ প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে, বহু কবি নিজের নাম প্রচারের বিষয়ে তেমন আগ্রহী ছিলেন না। তাই কখনো-কখনো ভণিতা ছাড়া পদও পাওয়া যায়। পাঠ্যপদের পদকর্তা বিদ্যাপতি তাঁর পদসমূহে কখনও ‘কবিশেখর’, কখনও ‘কবিকণ্ঠহার’ কখনও ‘কবিবল্লভ’ নামে নিজের স্বাক্ষর রেখেছেন পদে।
আরও পড়ুন – শিক্ষামনোবিজ্ঞান প্রশ্ন ও উত্তর