ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় রেমাল প্রবন্ধ রচনা
জীবনধারণের লক্ষ্যে যে মানবজাতি তার বুদ্ধিমত্তার জোরে প্রকৃতির সঙ্গে হৃদ্যতার সম্পর্ক স্থাপন করেছিল, আপন ক্ষুদ্র স্বার্থ চরিতার্থতায় আজ তাকেই আঘাতে আঘাতে ধ্বংস করতে উদ্যত। গগনচুম্বী বহুতল ভেদ করে কলকারখানার কালো ধোঁয়ার মধ্য দিয়ে উড়ছে প্রকৃতি বিজয়ের পতাকা। প্রকৃতিও তাই ক্ষমা করেনি। প্রত্যাঘাত হেনে প্রকৃতিও আজ তাণ্ডবলীলায় উন্মত্ত। বারে বারে আছড়ে পড়েছে ভয়াবহ বন্যা, সামুদ্রিক ঝড়, সুনামি। দেখা দিচ্ছে খরা, প্রকৃতি বারংবার দুলে উঠছে ভূমিকম্পে। প্রকৃতির সেই ভয়াবহতার সাম্প্রতিক নামান্তর ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’।
এদেশে প্রতিটি ঘূর্ণিঝড়েরই কোনো-না- কোনো নামকরণ করা হয় এবং তা করে থাকে কোনো-না-কোনো দেশ। ‘রেমাল’ নামটি ওমানের দেওয়া। আরবি ভাষায় ‘রেমাল’-এর অর্থ বালি। গত ২৬ মে, ২০২৪, রবিবার, রাত সাড়ে ৯টা নাগাদ বঙ্গোপসাগরে উদ্ভূত এই ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশের ‘মংলা’ বন্দরের কাছাকাছি এলাকা দিয়ে স্থলভাগে প্রবেশ করে। মধ্যরাতেই সমস্ত শক্তি নিয়ে আছড়ে পড়ে এই ঝড়। আছড়ে পড়ার সময় তার গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১১০ থেকে ১২০ কিলোমিটার। স্থলভাগে এই ঝড় যত প্রবেশ করেছে ততই বেড়েছে ঝড়বৃষ্টির দাপট। পুরোপুরি স্থলভাগে প্রবেশ করতে ‘রেমাল’-এর সময় লেগেছে প্রায় চার ঘণ্টা। এ রাজ্যে বাংলাদেশ লাগোয়া উত্তর এবং দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় ঝড়বৃষ্টির দাপট ছিল সবথেকে বেশি।
বঙ্গোপসাগরে উদ্ভূত নিম্নচাপই ২৪মে, ২০২৪ অর্থাৎ শুক্রবার নাগাদ পরিণত হয় গভীর নিম্নচাপে। সেটি আরও শক্তি বাড়িয়ে পরিণত হয় ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল‘-এ। আবহবিদগণ প্রথম থেকেই অনুমান করেছিলেন বাংলাদেশের মাটিতেই আছড়ে পড়তে চলেছে এই ঘূর্ণিঝড়। এর প্রভাবে উপকূলবর্তী এলাকায় শনিবার থেকেই শুরু হয়ে যায় বৃষ্টি ও ঝোড়ো হাওয়ার দাপট। শুরু হয়ে যায় মাইকে মাইকে প্রচার।
মৎস্যজীবীদের সমুদ্র থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রশাসনিক তৎপরতা পৌঁছোয় তুঙ্গে। বাড়তি নিরাপত্তার জন্য কলকাতা বা শহরতলি এবং উপকূলবর্তী একাধিক জায়গায় বিদ্যুৎসংযোগ আগে থেকেই বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। জেলায় জেলায় কন্ট্রোল রুম খোলা হয়। শনিবার, ২৫মে থেকেই বন্ধ করে দেওয়া হয় ফেরি সার্ভিস। বাতিল করা হয় লোকাল ট্রেন, দূরপাল্লার বহু ট্রেন। এমনকি কলকাতা বিমান বন্দরের পরিসেবাও প্রায় ২১ ঘণ্টা বন্ধ রাখা হয়। সমুদ্রসৈকতে আগত পর্যটকদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণেও চলতে থাকে তৎপরতা।
ঝড়ের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৩৫ কিলোমিটার। এ রাজ্যে দুই চব্বিশ পরগনা ছাড়াও পূর্ব মেদিনীপুর, কলকাতা, হাওড়া ও হুগলিতেও ব্যাপক ঝড়বৃষ্টি হয়। রবিবার, অর্থাৎ ২৬ মে সকাল থেকেই পূর্ব মেদিনীপুরের উপকূল দিঘা, মন্দারমণি, তাজপুর এবং সংলগ্ন এলাকায় প্রবল ঝড়বৃষ্টি, জলোচ্ছ্বাস শুরু হয়ে যায়। জলোচ্ছ্বাস তীব্র আকার ধারণ করে শঙ্করপুরে।
গঙ্গাসাগর, বকখালি, গোবর্ধনপুর, মৌসুনি ঘোড়ামারা ইত্যাদি এলাকায় নদী উত্তাল থাকায় বেশ কিছু জায়গায় বাঁধ উপচে নদীর জল ঢুকে যায়। ফ্রেজারগঞ্জ, ঈশ্বরীপুর, গোবর্ধনপুর, বোটখালি, • সাতেরঘেরি এলাকাতেও বাঁধ উপচে জল ঢোকে। গোসাবার বিভিন্ন জায়গার নদীবাঁধে ধস নামে।
এই ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে এ রাজ্যে ৭ জন মানুষের প্রাণহানি ঘটে। রাজ্যে প্রায় ২৫০০ টি বাড়ি পুরোপুরি এবং ২৭০০০ বাড়ি আংশিকভাবে ভেঙে পড়েছে। ২৬ মে, রবিবার গভীর রাত পর্যন্ত কলকাতায় বৃষ্টিপাত হয়েছে অন্তত ৭২ মিলিমিটার। কলকাতা শহরের একাধিক জায়গায় কয়েকশো গাছ ভেঙে পড়েছে। এ শহরে দেয়াল ভেঙে পড়ে মৃত্যু হয়েছে এক জনের। জল ঢুকে পড়ে ব্যাহত হয়েছে মেট্রো চলাচল।
দুই চব্বিশ পরগনায় প্রায় ১৭০০টি বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে পড়েছে। এসব জায়গায় আনাজ, পাট, আম চাষেও বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কেবল এই রাজ্যেই নয়, রেমাল-এর প্রভাবে মিজোরাম ও মণিপুরের বিভিন্ন অংশে ধস নেমে ও হড়পা বানে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ত্রিপুরা রাজ্যেও রেকর্ড বৃষ্টিপাত হয়েছে। মিজোরামে রেমাল-এর বলি ২৭ জন এবং অসমে অন্তত ৫ জন। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে ত্রিপুরা, মিজোরাম এবং অসমের বরাক উপত্যকার মধ্যে।
দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা করতে দক্ষিণ ২৪ পরগনার বহু মানুষকে আগে থেকেই সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় ত্রাণশিবিরে। এমনকি, প্রশাসনিক সক্রিয়তায় ভেঙে পড়া গাছ সরাতে বা নদীবাঁধ মেরামতেও খুব বেশি সময় লাগেনি। ফ্লাড শেল্টারগুলিতে দুর্গতদের থাকার পাশাপাশি ওষুধপত্রও মজুত করা হয় পর্যাপ্ত পরিমাণে।-
সারা রাজ্যে প্রায় দু-লক্ষেরও বেশি মানুষকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৪০০- র বেশি ত্রাণশিবিরে দুর্গতদের খাবার সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়। ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলার প্রস্তুতি নিয়ে জরুরি বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী এবং রাজ্য সরকারকে সবরকম সাহায্যদানের প্রতিশ্রুতি দেন। বঙ্গোপসাগরে দুর্যোগ মোকাবিলায় মোতায়েন করা হয় উপকূল রক্ষীবাহিনী এবং নৌসেনা। রাজ্যে যে- সমস্ত বাড়ি সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়েছে, তাদের জন্য নবান্নের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করেছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। সুন্দরবন উন্নয়ন মন্ত্রী জানিয়েছেন যে, সুন্দরবন এলাকায় বিপর্যয় মোকাবিলায় আশানুরূপ কাজ করেছে প্রশাসন।
দুর্যোগ মোকাবিলার থেকেও বড়ো কথা হল রুখতে হবে এহেন দুর্যোগকে। হ্যাঁ, সংশোধনের সময় এখনই। প্রকৃতির উপর মানুষের স্বেচ্ছাচার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। প্রকৃতি সুস্থির হলে স্বাচ্ছন্দ্য ফিরবে আমাদের জীবনেই। স্নেহের সন্তান আবার ফিরে পাবে প্রকৃতি মাতার স্নেহাঞ্চল।
আরও পড়ুন – ভারতে প্রচলিত ভাষা পরিবার MCQ