ব্যাপক ও সংকীর্ণ অর্থে গণতন্ত্র বলতে কী বোঝায়? গণতন্ত্রের সর্বাধুনিক সংজ্ঞাগুলি আলোচনা করো
ব্যুৎপত্তিগত অর্থে গণতন্ত্র বলতে জনগণের শাসনকে বোঝানো হয়। তবে তত্ত্বগত পর্যালোচনায় গণতন্ত্র শব্দটিকে ব্যাপক ও সংকীর্ণ এই দুই অর্থে ব্যবহার করা হয়।
ব্যাপক অর্থে গণতন্ত্র
ব্যাপক অর্থে গণতন্ত্র বলতে এমন একটি শাসনব্যবস্থাকে বোঝানো হয় যেখানে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সাম্য ও সমানাধিকার প্রতিষ্ঠিত থাকে। এইরূপ শাসনব্যবস্থায় নারী-পুরুষ, ধনী-দরিদ্র, জ্ঞানী-মূর্খ সকলেই সমান অধিকার লাভ করতে পারে। এখানে যে-কোনো ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণকে অস্বীকার করা হয়। সি ডি বার্নসের মতে, একটি আদর্শ হিসেবে গণতন্ত্র হল এমন একটি সমাজব্যবস্থা, যেখানে প্রতিটি মানুষ সামাজিক দিক থেকে ভিন্ন পর্যায়ভুক্ত হলেও এক অর্থে তারা অভিন্ন সামাজিক মর্যাদার অধিকারী। অর্থাৎ সমাজের সকল নাগরিকই অবিচ্ছেদ্য ও অপরিহার্য অঙ্গ। *1
সংকীর্ণ অর্থে গণতন্ত্র
সংকীর্ণ অর্থে গণতন্ত্র বলতে গণতান্ত্রিক সরকার বা শাসনব্যবস্থাকে বোঝায়। এই ধরনের শাসনব্যবস্থায় জনসাধারণ প্রত্যক্ষভাবে কিংবা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করে। তাই সংকীর্ণ গণতন্ত্র বলতে অনেকেই জনগণের শাসনকে বুঝিয়েছেন। অধ্যাপক ডাইসির ভাষায় বলা যায়, যে শাসনব্যবস্থায় তুলনামূলকভাবে জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের হাতে শাসনক্ষমতা ন্যস্ত থাকে, তাকে গণতন্ত্র (Democracy) বলে অভিহিত করা যায়। এককথায় সংকীর্ণ অর্থে গণতন্ত্র বলতে রাষ্ট্রপরিচালনার এক বিশেষ পদ্ধতিকে বোঝায়। এইরূপ ব্যবস্থায় সমাজের সকল ব্যক্তির কাছে রাজনৈতিক সাম্যের দাবি উন্মুক্ত থাকে, অর্থাৎ গণতন্ত্র হল রাষ্ট্রপরিচালনার এক বিশেষ পদ্ধতি।
গণতন্ত্রের সর্বাধুনিক সংজ্ঞা
আধুনিক গণতন্ত্রের বিকাশে সাহায্য করেছে ইংল্যান্ডের মহাসনদ বা ম্যাগনা কার্টা (১২১৫ খ্রি.), গৌরবময় বিপ্লব (১৬৮৮ খ্রি.), আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ (১৭৭৫ ১৭৮৩ খ্রি.) এবং ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯ খ্রি.) ইত্যাদি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ঘটনাবলি।
ম্যাকইভার, বার্কার-সহ হারবার্ট স্পেনসার, হবহাউস, গ্রিন, ল্যাক্সি প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীও গণতন্ত্রকে সংকীর্ণতা মুক্তভাবে গড়ে তুলতে চেয়েছেন। অন্যদিকে, আধুনিক কয়েকজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের দেওয়া গণতন্ত্রের সর্বাধুনিক সংজ্ঞা নিম্নে আলোচনা করা হল-
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জোসেফ শ্যুমপিটার: রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জোসেফ শ্যুমপিটার মনে করেন, গণতন্ত্র হল গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শাসক প্রতিনিধি নির্বাচনের এক ব্যবস্থা।
অধ্যাপক জি সি ফিন্ড: অধ্যাপক জি সি ফিল্ড বলেন যে, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা হল সেই শাসনব্যবস্থা যেখানে জনসাধারণ সক্রিয়ভাবে সরকারের সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়।
রবার্ট ডাল: রবার্ট ডাল মনে করেন, গণতন্ত্র হল বিভিন্ন স্বার্থগোষ্ঠীর মধ্যে সমঝোতা বা সমন্বয়সাধনের একটি প্রক্রিয়া (“Democracy is an understanding process among different pressure groups.”)।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী কার্ল পপার: কার্ল পপার মনে করতেন, গণতন্ত্র হল এমন কতগুলি প্রতিষ্ঠানের সমষ্টি, যার মাধ্যমে জনগণ শাসকশ্রেণিকে নিয়ন্ত্রণ ও প্রয়োজনানুসারে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্লামেনাজ: রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্লামেনাজ মনে করেন, শাসিতের দ্বারা স্বাধীনভাবে নির্বাচিত ও তাদের দ্বারা গঠিত শাসনব্যবস্থাই গণতন্ত্র রূপে পরিচিত হয়। এইরূপ শাসনব্যবস্থায় শাসক জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকে।
জন স্টুয়ার্ট মিল: জন স্টুয়ার্ট মিল মনে করেন, রাষ্ট্রে সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগে সকলের প্রবেশাধিকারই হল গণতন্ত্র।
আরও পড়ুন – জাতি ও জাতীয়তাবাদ প্রশ্ন উত্তর