বিভিন্ন দার্শনিক সম্প্রদায় কীরূপে মোক্ষকে ব্যাখ্যা করেছেন
মোক্ষ
একমাত্র চার্বাক দর্শন ছাড়া ভারতীয় দর্শনে সব সম্প্রদায়ই মোক্ষকে সর্বশ্রেষ্ঠ পুরুষার্থ বলে গ্রহণ করেছে। আত্মার সত্য পরিচয় অনুসন্ধান করে সেই আলোকে জীবনধারণ করা হয়। সেই শক্তির প্রভাবে আন্তর ও বাহ্য জগতকে নিয়ন্ত্রণ করে আত্মার সত্য ও শক্তিকে সমস্ত জীবনে প্রতিষ্ঠা করাকেই বলা হয় মোক্ষ। উল্লেখ্য অন্য তিনটি পুরুষার্থ নশ্বর হলেও মোক্ষ কিন্তু অবিনশ্বর। ধর্ম, অর্থ ও কামজাত সুখ স্বল্পকাল স্থায়ী এবং পরিমাণেও বেশি নয়।।
ছান্দোগ্য উপনিষদে বলা হয়েছে- “ন চ পুনরাবর্ততে”
শ্রুতি বাক্যটির অর্থ এই যে ব্রহ্মজ্ঞানের দ্বারা মুক্ত জীবের বারবার শরীর গ্রহণের জন্য জন্ম-মরণরূপ সংসার প্রাপ্তি হয় না। সুতরাং শ্রুতির দ্বারা মোক্ষের নিত্যত্ব প্রমাণিত হয়।
বিভিন্ন দর্শন সম্প্রদায়ের মতে মোক্ষ
বিভিন্ন দার্শনিক সম্প্রদায় মোক্ষের স্বরূপ বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। কেউ বলেন, মোক্ষ হল আনন্দঘন অবস্থা, কেউ বলেন মোক্ষাবস্থায় দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি হয়, কেউ বলেন মোক্ষাবস্থায় ঈশ্বরের সঙ্গে সাযুজ্য লাভ হয়।
চার্বাক মত
চার্বাক মতে, দেহের অতিরিক্ত আত্মা বলে কিছু নেই। দেহের বিনাশেই আত্মার বিনাশ হয়। তাই আত্মার মুক্তি বা মোক্ষের কোনো প্রশ্ন আসে না।
জৈন মত
জৈন মতে, আত্মার সঙ্গে বিশেষ পুদগল বা জড়াণু সংযুক্ত হলে আত্মা দেহ ধারণ করে এবং আত্মার বন্ধন দশা ঘটে। আর পুদগলের বিয়োগ হলে আত্মার মুক্তি প্রাপ্তি হয়।
বৌদ্ধ মত
বৌদ্ধ দর্শন মতে দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি হল নির্বাণ। এই জীবনে প্রজ্ঞা, শীল ও সমাধি অনুশীলনের মাধ্যমে নির্বাণ লাভ করা সম্ভব। জীবিতকালে নির্বাণপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে বৌদ্ধ দর্শনে অর্হৎ বলে।
ন্যায় ও বৈশেষিক মত
ন্যায়-বৈশেষিক দর্শনে মোক্ষকে অপবর্গ বা নিঃশ্রেয়স বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ন্যায়-বৈশেষিক মতে, অবিদ্যা বা মিথ্যাজ্ঞান হল দুঃখের মূল কারণ। তত্ত্বজ্ঞানের সাহায্যেই এই মিথ্যাজ্ঞান দূর করা সম্ভব। তত্ত্বজ্ঞান লাভ হলে মোক্ষলাভ সম্ভব হয়।
সাংখ্য ও যোগ মত
সাংখ্য ও যোগ দর্শনে পুরুষ ও প্রকৃতির অবিবেক অর্থাৎ অভেদ জ্ঞান হল পুরুষের বন্ধনের কারণ। অর্থাৎ পুরুষ ও প্রকৃতির ভেদজ্ঞানই দুঃখ-নিবৃত্তির বা মুক্তির একমাত্র উপায়। সাংখ্য-যোগ দর্শনে এই মোক্ষ বা মুক্তিকে কৈবল্য বলে।
মীমাংসক মত
প্রাচীন মীমাংসা দর্শনে ধর্ম, অর্থ ও কাম-এই ত্রিবর্গ পুরুষার্থ স্বীকৃত। এখানে ধর্মকে পরম পুরুষার্থ হিসেবে স্বীকার করা হত। নব্য মীমাংসক মতে, মানবজীবনের বন্ধন থেকে মুক্তি লাভ করলে তবেই মোক্ষলাভ সম্ভব। পূর্বজন্মের কর্মফল সম্পূর্ণভাবে বিনষ্ট হলে তবে আত্মার মুক্তি বা মোক্ষলাভ ঘটে। এরা জীবন্মুক্তিতে বিশ্বাস করেন না। এদের মতে, বিদেহ মুক্তিই হল প্রকৃত মোক্ষ।
অদ্বৈত বেদান্তীমত
অদ্বৈতবাদী শঙ্করাচার্যের মতে, জীবই ব্রহ্ম। জীবাত্মার সঙ্গে ব্রহ্ম বা পরমাত্মার একাত্মতার উপলব্ধিই হল মোক্ষ বা মুক্তি।
বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী মত
রামানুজের মতে, বেদান্ত পাঠ করলে অবিদ্যার বিনাশ হয়। জীব নিজেকে ঈশ্বরের অংশ বলে উপলব্ধি করে। তিনি বলেন জ্ঞান, কর্ম ও ভক্তি জীবের মুক্তির উন্মুক্ত পথ।
এইভাবে বিভিন্ন সম্প্রদায় বিভিন্নভাবে ‘মোক্ষ‘-কে ব্যাখ্যা করেছেন।
আরও পড়ুন – যুক্তিবিজ্ঞানের প্রকৃতি – অবরোহ এবং আরোহ