বিদ্যাসাগর রচনা
ভূমিকা
মাইকেল মধুসূদন দত্ত লিখেছেন বিদ্যাসাগর সম্বন্ধে,
দয়ার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।
করুণাসিন্ধু তুমি, সেই জনে জানে,
দীন যে দীনের বন্ধু।
ভারতবর্ষ তখন পরাধীন। শিক্ষা, সংস্কৃতি, জাতীয়তাবোধ প্রভৃতি ক্ষেত্রে মানুষ তখন দিশেহারা। এরূপ পরিস্থিতিতে গভীর অন্ধকার থেকে আলোর পথে এগিয়ে চলার পথের সন্ধান দিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তিনি পাণ্ডিত্যে ছিলেন অতুলনীয়, বাক্যালাপে সুরসিক, ক্রোধে উন্মত্ত, দিগভ্রান্ত জাতিকে দিয়েছেন মুক্তিপথের সন্ধান।
জন্ম
বিদ্যাসাগরের আসল নাম ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর জন্ম মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে ১৮২০ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর। তিনি জন্মগ্রহণ করেন খুবই দরিদ্র পরিবারে। তাঁর পিতার নাম ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও মাতার নাম ভগবতী দেবী। তাঁর লেখাপড়া শুরু হয় পাঠশালায় এবং শৈশবে পিতার সাথে হেঁটে কলকাতা আসেন।
শিক্ষা জীবন
তিনি যখন কলকাতায় হেঁটে আসেন তখন তাঁর বয়স সাত-আট বছর। তিনি দেখলেন, রাস্তার ধারে শিলের মতো পাথর পোতা আছে। তিনি তাঁর বাবাকে বললেন-শিল পোঁতা আছে কেন? তা শুনে তাঁর বাবা বললেন, এগুলো মাইল স্টোন। ইংরেজিতে পর পর এক থেকে লেখা আছে। এখন লেখা আছে উনিশ। তিনি মাইলস্টোন দেখে এক থেকে দশ শিখে ফেললেন। তিনি খুব আর্থিক কষ্টের মধ্যে থেকেও রাস্তার গ্যাসের আলোয় পড়ে প্রত্যেক পরীক্ষায় প্রথম হতেন এমন তীক্ষ্ণ ছিল তাঁর মেধা। পাঠশালার শিক্ষা শেষ করে কলকাতার সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হন ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দের ১লা জুন।
কর্মজীবন
মাত্র কুড়ি বছর বয়সে সংস্কৃত কলেজের পড়া শেষ করে প্রথমে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন। পরে সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপক হিসাবে যোগ দেন, এই কলেজের অধ্যক্ষ হন এবং স্কুল পরিদর্শকের দায়িত্বও পালন করেন। তবে কলেজ কর্তৃপক্ষের সাথে মতের মিল না হওয়ায় অধ্যক্ষের পদ ত্যাগও করেছিলেন। মেধার স্বীকৃতি হিসাবে তাঁকে ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি দেওয়া হয়।
সাহিত্য সৃষ্টি
বিদ্যাসাগর রচনা করেছেন শকুন্তলা, সীতার বনবাস, বোধোদয়, কথামালা, বেতাল পঞ্চবিংশতি, ভ্রান্তিবিলাস, ব্যাকরণ কৌমুদী প্রভৃতি গ্রন্থ। তাঁর লেখা বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগ ও দ্বিতীয় ভাগ পড়ার মাধ্যমে আজও শিশুর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। তাঁর চরিত্রের মধ্যে ছিল আধুনিকতার ছোঁয়া এবং অপরিসীম ছিল তার প্রাণশক্তি। তিনি শুরু করেছিলেন প্রথাগত শিক্ষার পরিবর্তে যথার্থ শিক্ষা। তিনি চেয়েছিলেন পাঠক্রম সংস্কার, সংস্কৃতের জটিল ব্যাকরণের পরিবর্তে সহজবোধ্য নতুন ব্যাকরণের সৃষ্টি, গণিতে ইংরেজীর ব্যবহার, দর্শনে পাশ্চাত্য লজিকের প্রবর্তন প্রভৃতি। তিনি ছিলেন জাভিদ প্রথার বিরোধী। তিনি সংস্কৃত কলেজে ব্রাহ্মনোত্তর জাতির প্রবেশাধিকার দিলেন। তিনি শুধু শিক্ষা-সংস্কারে ব্যস্ত থাকলেন না, স্কুলের পাঠ্যের জন্য পাঠ্য বইও লেখেন।
সমাজ সংস্কার
বিদ্যাসাগর শুধু শিক্ষা সংস্কারক ছিলেন না বা বাংলা গদ্যের প্রচলন কর্তা ছিলেন না, তিনি ছিলেন মানব প্রেমিক। তাঁর চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল তাঁর মন অন্যায়ের কাছে বজ্রকঠিন, দুঃখীর দুঃখে খুবই কোমল। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তাঁর সম্বন্ধে লিখেছেন, “দয়া নহে, বিদ্যা নহে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চরিত্রের প্রধান গৌরব তাঁহার অজেয় পৌরুষ তাঁহার অজেয় মনুষ্যত্ব।” তিনি যা বলতেন তা নিজের জীবনেও পালন করতেন। তিনি ছিলেন অনাড়ম্বর সাধাসিধে জীবনে অভ্যস্ত।
বিধবা বিবাহ আইন তাঁর প্রচেষ্টায় প্রচলন হয়। এ ব্যাপারে তাঁকে যিনি সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছিলে তিনি হলেন মহিয়সী নারী রানি রাসমনি। বিদ্যাসাগর নিজের পুত্রের সাথে বিধবা কন্যার বিবাহ দেন, তিনি আদর্শে ছিলেন নিশ্চল, কোনও প্রলোভন তাঁকে আদর্শ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। তিনি চেষ্টা করেছেন বহু-বিবাহ, বাল্য বিবাহ, কৌলিন্য প্রথা বন্ধ করতে। মেয়েদের ওপর মানসিক নিপীড়ন বন্ধ করে নারীশিক্ষা প্রচলনের চেষ্টা করেছেন তিনি। বেথুন কলেজ, মেট্রোপলিটন কলেজ (বর্তমান নাম বিদ্যাসাগর কলেজ) প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। পিতা-মাতাকে দেবতা জ্ঞানে ভক্তি করতেন। মায়ের ইচ্ছা পূরণের জন্য নিজের গ্রামে তিনি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
উপসংহার
দুঃখীর দুঃখে তাঁর হৃদয় কাঁদত বলে তাঁকে করুণাসাগরও বলা হত। এই মহামানবের প্রয়াণ ঘটে ১৮০১ সালের ২৯শে জুলাই বিহারের কারমাটারে। বিদ্যাসাগরের অবদান সম্বন্ধে তাইতো বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন,
রুদ্ধভাষা আঁধারের খুলিল নিবিড় যবনিকা,
হে বিদ্যাসাগর, পূর্বদিগন্তের বনে-উপবনে
নব উদ্বোধনগাথা উচ্ছ্বসিল বিস্মিত গগনে।
আরও পড়ুন – মহাত্মা গান্ধী প্রবন্ধ রচনা