বাংলা গীতিকাব্যের ধারায় কাজী নজরুল ইসলামের অবদান লেখো
গীতিকবিতার সংজ্ঞা ও নজরুলের গীতিকবিতা: যে কবিতায় কবি তাঁর ব্যক্তিগত আবেগ-অনুভূতিকে এক সাবলীল ও আন্তরিক গীতিপ্রবণ ভাষায় ব্যক্ত করেন, সেই সংগীতময় কবিতাকেই গীতিকবিতা বা লিরিক বলে। কবি নজরুলের লেখা বহু কবিতাই গীতিকবিতার বৈশিষ্ট্যযুক্ত।
লেটোর দলে কাজ করার সময়ই তিনি গান রচনা শুরু করেছিলেন, – ভ্রাম্যমাণ এই যাত্রাদলের সঙ্গে কাজ করার সুবাদে নজরুল বাংলার লোকসংগীতের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন, একই সঙ্গে হিন্দু পুরাণ-সংস্কৃতি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনও করেছিলেন। ফলত, নজরুলের গীতিকাব্যের মূর্ছনায় ধরা পড়েছে নানা আঙ্গিক।
কাব্য পরিচয়: নজরুলের গীতিকবিতায় সহজসরল শব্দ ব্যবহার সাধারণ পাঠকের মনে অতিসহজেই কাব্যিক ঝংকার তুলেছে। বস্তুত, তাঁর বেশিরভাগ কবিতাই স্বয়ংসম্পূর্ণ এক-একটি গান। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গীতিকাব্যের উদাহরণ- ‘গীতিশতদল’ (১৯৩৪), ‘সুরলিপি’ (১৯৩৪), ‘বুলবুল’ (১৯৫২) ইত্যাদি। এ ছাড়াও ‘সঞ্চিতা’ (১৯২৮), ‘সন্ধ্যা’ (১৯২৯) ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থও হল গান ও কবিতার সম্মিলিত সংস্করণ।
গীতিময়তা: কবির প্রেমিক সত্তা, মানবপ্রীতি এবং প্রকৃতির প্রতি নিবিড়ময়তার গুণেই গড়ে উঠেছে নজরুলের কবিমানস। কবি জানতেন যে, নৃত্য আর সংগীত হল কাব্যের দুই বিমূর্ত ভাব। তাই তাঁর রচনায় এই দুইয়ের সার্থক মিলন সম্ভব হয়েছিল।
তাঁর ‘বুলবুল’ কাব্যগ্রন্থের অধিকাংশ কবিতাই গজল হিসেবে পরিচিতি পায়। এই কাব্যগ্রন্থে দেখা যায়, পুত্র বুলবুলের অকালমৃত্যুতে কাতর কবির ভাবনায় বিচিত্র সুরের আনাগোনা; যে কারণে এটিকে এলিজি বা শোককাব্যও বলা হয়। ‘চোখের চাতক’ কাব্যগ্রন্থের ৫১টি কবিতায় রাগরাগিণীর সার্থক ব্যবহার লক্ষ করা যায়। সাংগীতিক বৈচিত্র্য ছাড়াও কাব্যিক বোধ ও অনুভূতির ব্যঞ্জনা এই কাব্যগ্রন্থের অন্যতম সম্পদ। ১৯৩১ সালে প্রকাশিত ‘সুর-সাকী’ কাব্যগ্রন্থে কবির সূক্ষ্ম রোমান্টিকতা ও প্রেমভাবনার যুগল সম্মিলন দেখা যায়-
"মৃত্যু-আহত কণ্ঠে তাহার ঐ কি এ গানের জাগিল জোয়ার মরণ বিষাদে অমৃতের স্বাদ আনিলে নিষাদ মম।"
মূল্যায়ন: বিদ্রোহ, অস্থিরতা, কখনও প্রেম, কখনও বা সংগ্রামের বাস্তব সত্যের আলোকেই প্রজ্বলিত হয়েছে নজরুলের কাব্যসাধনার ধারা। গীতিকবিতার ক্ষেত্রে নজরুলের অবদান বাংলা কাব্য-কবিতার ধারায় অনস্বীকার্য।
আরও পড়ুন – নুন কবিতার নামকরণের সার্থকতা