বাংলা গীতিকাব্যের ধারায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান লেখো
ভূমিকা
আধুনিক বাংলা কাব্য-কবিতার ধারায় রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাব গীতিকবিতার হাত ধরে। মধুসূদন, রঙ্গলাল, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র প্রমুখ কবিদের কাব্যরচনাধারায় যে মহাকাব্য-আখ্যানকাব্য রচনারীতির সূচনা হয়েছিল; রবীন্দ্রনাথের গীতিকাব্য সেই ধারায় নতুন মাত্রা যোগ করল।
রবীন্দ্রনাথের গীতিকাব্যের ধারা
রবীন্দ্র কাব্যজীবনের সূচনা পর্বে বিহারীলাল চক্রবর্তীর গীতিকাব্যের প্রভাব ‘সন্ধ্যাসঙ্গীত’ কাব্য পর্যন্ত পরিলক্ষিত হয়। রবীন্দ্রনাথের কাব্যজীবন শুরু হয়েছিল কাহিনী-কাব্য, নাটক ও গীতিকবিতার মাধুর্যে। ১৮৭৮ সালে ‘কবিকাহিনী’ থেকে ১৮৮৩ সালে ‘প্রভাত সঙ্গীত’-এই রচনাগুলির অধিকাংশজুড়েই গীতিকবিতার লক্ষণ দৃশ্যমান।
আখ্যানকাব্য, নাটক ও গীতিকবিতার মিশ্র প্রভাবে ‘ভগ্নহৃদয়’ (১৮৮১) কাব্যের সৃষ্টি। ‘কবিকাহিনী’ (১৮৭৮), ‘বনফুল’ (১৮৮০) কাব্যে লিরিকের মালা গাঁথা হয়েছে, গল্প গৌণ হয়ে গীতিকবিতার উচ্ছ্বাসই এখানে প্রাধান্য লাভ করেছে।
‘শৈশব সঙ্গীত’ (১৮৮৪) কাব্যের ‘শুন, নলিনী খোল গো আঁখি’, ‘বলি ও আমার গোলাপবালা’ প্রভৃতি কবিতা গীতিসম্পদে সমৃদ্ধ। এই লিরিকশক্তি বা গীতিসম্পদই কবিকে চালিত করেছিল। এই সময়পর্বে রচিত, ‘সন্ধ্যাসংগীত’ (১৮৮২), ‘প্রভাত সঙ্গীত’ (১৮৮৩) কাব্যগুলির নামকরণ – থেকেই স্পষ্ট হয় যে; কাব্যগুলিতে গীতিকবিতার লক্ষণই প্রধান।
‘মানসী’ (১৮৯০) কাব্যে কবির প্রকাশ স্বমহিমায়। এই কাব্যে বাস্তবের সঙ্গে মানবাত্মার দ্বন্দ্বের প্রকাশমাধ্যম হয়ে উঠেছে গীতিকবিতার সুরঝংকার। ‘সোনার তরী’ (১৮৯৪) পরবর্তী কাব্যধারায় প্রকাশিত হয়েছে কবির প্রকৃতিপ্রেম ও সূক্ষ্ম ভাবনিষ্ঠা (সমকালীন গীতিকবি দেবেন্দ্রনাথ সেন, অক্ষয়কুমার বড়ালের কাব্যেও এই ধরনের রূপতন্ময়তা লক্ষ করা যায়)। বিশ্বকাব্যজগতে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘গীতাঞ্জলি’ (১৯০০) গীতিকাব্যটির মাধ্যমে। এই সময়পর্বে লেখা ‘গীতিমাল্য’ (১৯১৪), ‘গীতালি’ (১৯১৫) কাব্যেও গীতিকাব্যের অনুরণন পরিলক্ষিত হয়।
মূল্যায়ন
বাংলা গীতিকবিতার ধারায় রবীন্দ্রনাথ তাঁর পূর্ববর্তী এবং সমকালীন কবিদের পথ অনুসরণ করেই ক্ষান্ত হননি, বরং নিজেও পথ প্রস্তুত করেছেন। প্রকৃতিবর্ণনায়, বিষাদমূলক কবিতায়, আদর্শায়িত প্রেমের উপস্থাপনে এবং সর্বোপরি গীতিকবিতার ধ্বনিমাধুর্যে রবীন্দ্রনাথ স্বতন্ত্র ধারার সূচনা করেছেন।
আরও পড়ুন – বই কেনা প্রবন্ধের প্রশ্ন উত্তর