বাংলা কবিতার ধারায় কাজী নজরুল ইসলামের সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষবিরোধী মনোভাবের পরিচয় দাও
প্রেক্ষাপট: বাঙালি জাতির ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের উজ্জ্বল অধ্যায় শুরু হয়েছিল ‘ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ’, ‘ওয়াহাবি আন্দোলন’, ‘সিপাহি বিদ্রোহ’ (১৮৫৭), ‘খিলাফত আন্দোলন’ ইত্যাদির মধ্য দিয়ে। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে। এর পূর্ব থেকেই ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতির মাধ্যমে ধর্মীয় ও জাতিগত বিরোধকে জিইয়ে রাখা হয়েছিল। ফলত, হিন্দু ও মুসলিম-সহ বহু জাতির এই দেশ ধর্মীয় হানাহানিতে উন্মত্ত হয়ে ওঠে। এই পরিস্থিতিতে ধূমকেতুর মতো এক হাতে ‘বাঁকা বাঁশের বাঁশরী’ আর-এক হাতে ‘রণ-তূর্য’ নিয়ে কবি কাজী নজরুল ইসলামের – আবির্ভাব ঘটেছে ভারতীয় উপমহাদেশে।
বাংলা কাব্য-কবিতার ধারায় কবি নজরুলের এই আগমনের অন্যতম উদ্দেশ্যই ছিল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রতিষ্ঠা-
"সকল কালের সকল দেশের সকল মানুষ আসি এক মোহনায় দাঁড়াইয়া শোনো এক মিলনের বাঁশি"
[কবিতা-‘কুলি মজুর’]
কাব্যবৈশিষ্ট্য: কবির প্রথম কবিতা ‘বিদ্রোহী’-তে হিন্দু ও মুসলমান উভয় ঐতিহ্য থেকে আহরিত শব্দ, উপমা, রূপক ও বাভঙ্গিই অনায়াসে মিশে গিয়েছে-
"আমি বেদুঈন, আমি চেঙ্গিস, আমি আপনারে ছাড়া করিনা কাহারে কুর্ণিশ, আমি বজ্র, আমি ঈশান-বিষাণে ওঙ্কার, আমি ইস্রাফিলের শিঙ্গার মহা-হুঙ্কার।"
তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’-তেই পাওয়া গিয়েছিল একজন ধর্মনিরপেক্ষ সমন্বয়বাদী কবিকে। তিনি এই গ্রন্থে ‘মোহররম’, ‘কোরবানী’, ‘খেয়া পারের তরণী’, ‘শাত-ইল-আরব’ ইত্যাদি মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্ত অনুষঙ্গের কবিতার সঙ্গে সংযোজন করলেন হিন্দু দেবী ও উৎসব নিয়ে রচিত কবিতা ‘রক্তাম্বরধারিণী মা’ ও ‘আগমনী’।
কাজী নজরুল ইসলামের মতে, বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের কোনো বিভেদ নেই। ‘সাম্যবাদী’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘মানুষ’ কবিতার মূলকথা এটিই। একদিকে ব্রিটিশদের দখল, দুঃশাসন আর অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বিষবাষ্পে কবির প্রতিবাদ তাই পরিলক্ষিত হয়- ‘সর্বহারা’ কাব্যগ্রন্থের ‘আমার কৈফিয়ৎ’ কবিতায়-
"বন্ধু গো, আর বলিতে পারিনা, বড় বিষ-জ্বালা এই বুকে! দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে।”
উপসংহার: কবি নজরুলের কবিতার মূলভাব মানবতার জয়গান। তিনি শোষণহীণ সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন, যে সমাজে ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় থাকবে। তাই তাঁর কলমে ধ্বনিত হয়েছে-
"মোরা এক বৃস্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মোসলমান। মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ।।” আরও পড়ুন - নুন কবিতার নামকরণের সার্থকতা