বর্ণধর্ম বিষয়টি ব্যাখ্যা করো
বর্ণধর্ম
বর্ণধর্ম হল মানুষের বিভিন্ন সামাজিক অবস্থানগত ধর্মের মধ্যে একটি ধর্মকেন্দ্রিক বর্ণব্যবস্থা। বিভিন্ন বর্ণের মানুষের বিশেষ কর্তব্য বা ধর্মকেই বর্ণধর্ম বলা হয়। ‘বর্ণ’ শব্দটির দ্বারা মনস্তাত্ত্বিক প্রবণতাকে বোঝানো হয়।
শ্রীকৃষ্ণ ‘শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা’-তে বলেছেন- “চাতুর্বর্ণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ।” (৪/১৩)
এখানে ‘গুণ’ বলতে সত্ত্ব, রজো, তমো-এই গুণত্রয়ের কথা বলা হয়েছে। প্রতিটি মানুষের মধ্যেই সত্ত্ব, রজো ও তমো- এই তিনটি গুণের সমাবেশ রয়েছে। তবে এই তিনটি গুণ প্রতিটি মানুষের মধ্যে সমানভাবে থাকে না, ফলে মানব প্রকৃতির মধ্যে এই তিন গুণের বৈষম্য থাকে। এই তিনগুণের বৈষম্য অনুযায়ী মানবজাতিকে চারটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়। শুধু গুণের বৈষম্যের জন্যে নয়, সমাজে এই বর্ণব্যবস্থা শ্রমবিভাজনের ফলেও ঘটে।
গীতায় শ্রীকৃষ্ণ গুণ ও কর্মের বিভাগ অনুসারে চারটি বর্ণের কথা বলেছেন। যথা- ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। এই চারটি বর্ণকে একত্রে চতুর্বর্ণ বলা হয়।
নিম্নে চতুর্বর্ণ সম্বন্ধে আলোচনা করা হল-
ব্রাহ্মণ
'শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা'-তে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন- ক্ষান্তিরার্জবমেবচ। "শমো দমস্তপঃ শৌচং জ্ঞানং বিজ্ঞানমাস্তিক্যং ব্রহ্মকর্ম স্বভাবজম্।।” (১৮/৪২)
অর্থাৎ শম (মনের সংযম), দম (বাহ্য ইন্দ্রিয়ের সংযম), তপস্যা, শৌচ (দেহ ও মনের শুচিতা), ক্ষমা, আর্জব (সরলতা), জ্ঞান (শাস্ত্রজ্ঞান), বিজ্ঞান (তত্ত্বানুভূতি) এবং আস্তিক্যবুদ্ধি (শাস্ত্র ও ভগবানে বিশ্বাস) এগুলি ব্রাহ্মণের স্বভাবজাত কর্ম। অর্থাৎ গীতাতে ব্রাহ্মণদের নয়টি গুণ স্বীকার করা হয়েছে। ব্রাহ্মণের মধ্যে তিনটি গুণের (সত্ত্ব, রজো, তমো) মধ্যে সত্ত্বগুণের প্রাধান্য বেশি থাকে। ব্রাহ্মণরা নিয়ত ব্রহ্ম বা ঈশ্বর চিন্তাতে নিয়োজিত থাকেন।
ক্ষত্রিয়
শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন-
"শৌর্যম্ তেজো ধৃতিদাক্ষ্যং যুদ্ধে চাপ্যপলায়নম্ দানমীশ্বরভাবশ ক্ষাত্রং কর্ম স্বভাবজম্।।” (১৮/৪৩)
অর্থাৎ শৌর্য, তেজ, ধৃতি (ধৈর্য্য), দাক্ষ্য (কর্মকুশলতা), যুদ্ধে অপলায়নতা, দানে মুক্তহস্ততা, ঈশ্বরভাব (শাসন ক্ষমতা) – এগুলি ক্ষত্রিয়ের স্বভাবজাত ধর্ম। গীতার মতো ‘মনুসংহিতা’-তেও ক্ষত্রিয়দের এগারোটি গুণ তথা কর্ম স্বীকার করা হয়েছে।
বৈশ্য
শ্রীকৃষ্ণ ‘শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা’-য় বলেছেন-
“কৃষিগোরক্ষ্যবাণিজ্যং বৈশ্যকর্ম স্বভাবজম্।” (১৮/৪৪)
অর্থাৎ কৃষিকাজ, গো রক্ষা (পশুপালন) ও বাণিজ্য বৈশ্যের স্বভাবজাত কর্ম। গীতার মতো ‘মনুসংহিতা’তেও বৈশ্যদের সাতটি গুণ তথা কর্ম স্বীকার করা হয়েছে। বৈশ্যগণের মধ্যে রজো ও তমোগুণের প্রাধান্য বেশি।
শূদ্র
শ্রীকৃষ্ণ ‘শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা’-য় বলেছেন- “পরিচর্যাত্মকং কর্ম শূদ্রস্যাপি স্বভাবজম্।” (১৮/৪৪)
অর্থাৎ পরিচর্যা (সেবা করা) শূদ্রের স্বভাবজাত ধর্ম। শূদ্রবর্ণের মানুষের মধ্যে রয়েছে তমোগুণের প্রাধান্য। গীতার মতো ‘মনুসংহিতা’-তেও শূদ্রদের একটি মাত্র গুণ স্বীকার দেখা হয়েছে।
বর্ণাশ্রমের বিভাগ প্রসঙ্গে ঋব্বেদের পুরুষসূক্তে বলা হয়েছে-
"ব্রাহ্মণোহস্য মুখমাসীদ্বাহ্ রাজন্যঃ কৃতঃ। উরু তদস্য যদ্বৈশ্যঃ প্যাং শূদ্রোহজায়তঃ।।”
অর্থাৎ সেই বিরাট পুরুষের মুখ থেকে ব্রাহ্মণ, বাহু থেকে ক্ষত্রিয়, উরু থেকে বৈশ্য ও পদযুগল থেকে শূদ্রের উৎপত্তি হয়েছে।
কিন্তু ভারতীয় শাস্ত্রে এই বর্ণবিভাগ জন্মগত নয়, কর্ম তথা গুণগত। নিজকর্মগুণে ক্ষত্রিয় যেমন ব্রাহ্মণ হতে পারে, ব্রাহ্মণও তেমনি ক্ষত্রিয় হতে পারে। যেমন- দ্রোণাচার্য প্রমুখ।
আরও পড়ুন – যুক্তিবিজ্ঞানের প্রকৃতি – অবরোহ এবং আরোহ