১৭৫ তম জন্ম বর্ষের আলোকে বঙ্কিমচন্দ্র প্রবন্ধ রচনা 800+ শব্দে

১৭৫ তম জন্ম বর্ষের আলোকে বঙ্কিমচন্দ্র প্রবন্ধ রচনা

১৭৫ তম জন্ম বর্ষের আলোকে বঙ্কিমচন্দ্র প্রবন্ধ রচনা

ভূমিকা

বাংলা কথাসাহিত্য আজ বিশ্বসাহিত্যের দরবারে বিশেষ মর্যাদার আসন লাভ করেছে। বঙ্গভারতীয় বরপুত্রগন তাঁদের অপূর্বসুন্দর রচনাসম্ভারে সমৃদ্ধ করেছেন এই সাহিত্যের ভান্ডার। আমি বাঙালি। বাংলা আমার মাতৃভাষা বলে বাংলা সাহিত্যের পাঠক হিসাবে গর্ব অনুভব করি। প্রত্যেক পাঠকের প্রিয় গ্রন্থকার আছেন। এক এক জন সাহিত্যিকের লেখা এক একজন পাঠকের মনকে বেশী আকৃষ্ট করে কেন সে প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সহজ নয়।

নানা বিষয়ের রচনা আমার অন্তরে চিরন্তন আসন পেতে স্থায়ী মিনার প্রতিষ্ঠা করলেও সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রকেই আমার প্রিয় গ্রন্থকার বলে মনে করি। কেন তাঁর রচনা আমার মনকে খুব বেশী আকৃষ্ট করে তা আলোচনা সহজ নয়, রুচি ও সহানুভূতি কার্যকারণ বিশ্লেষণ করে তার উত্তর পাওয়া যায় না। সবসময় তা স্বতঃস্ফূর্ত। যুক্তি দিয়ে সাহিত্যের ক্ষেত্রে ভালোমন্দের যথার্থ বিশ্লেষণ দুরহ ব্যাপার, ভালোলাগা একান্ত হৃদয়গত ও মানসপ্রবণতা প্রসূত। কেন বঙ্কিমচন্দ্র রচিত সাহিত্য পাঠ করতে আমার ভাল লাগে তা অন্তরের উপলব্ধির ব্যাপার।

বঙ্কিমচন্দ্রের শুভ আবির্ভাব

বঙ্কিমচন্দ্রের আগের বাংলা সাহিত্যের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় তখন গদ্যসাহিত্য ছিল অবহেলিত। আমাদের দেশে প্রকৃতপক্ষে গদ্যসাহিত্যের পত্তন করেন মিশনারীরা। প্যারীচাঁদ মিত্র প্রভৃতি লেখকেরা উপন্যাস রচনায় ব্রতী হলেও সেই প্রচেষ্টা তেমন স্বার্থকতা লাভ করেনি। এই সময় বাংলা সাহিত্যের দিকচক্রবালে নিবেদিত সূর্যের কিরণপ্রভা বিকীর্ণ করে অভূদ্যয় ঘটল বঙ্কিমচন্দ্রের। বঙ্কিমচন্দ্রের জন্ম ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দের ২৬ শে জুন উত্তর চবিবশ পরগণার কাঁঠালপাড়া গ্রামে। পিতা রামবাহাদুর যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন একজন ডেপুটী ম্যাজিস্ট্রেট। মায়ের নাম দুর্গাসুন্দরী। বঙ্কিমচন্দ্রের গৃহের পরিবেশ ছিল সাহিত্য- সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তাঁর জন্ম থেকে সমুজ্জ্বল। কিন্তু তাঁর আবির্ভাব সূচিত করল বাংলা সাহিত্যের যুগান্তরের। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ” বঙ্কিম বঙ্গসাহিত্য প্রভাতের সূর্যোদয় বিকাশ করিলেন, আমাদের হৃদপদ্ম সেই প্রথম উদ্‌ঘাটিত হইল।”

বঙ্কিমের সম্পাদিত বঙ্গদর্শন

খ্যাতনামা সাহিত্যিক ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের শিষ্যরূপে বঙ্কিম সাহিত্যাঙ্গনে প্রবেশ করলেন কবি হওয়ার স্বপ্নে ভর করে। কিন্তু কবিতা তাঁর মানস ধৰ্ম্মের অনুকূল ছিল না। তিনি আপন প্রতিভায় অগ্রসর হলেন উপন্যাস রচনায়। মাইকেল মধুসূদনের মতো প্রথমে তিনি ইংরেজীর মোহে লেখেন, ‘Rajmohan’s Wife’ নামে ইংরেজী ভাষার উপন্যাস। তিনি মাইকেলের মতো বুঝেছিলেন ‘কেলিনু শৈবালে, ভুলি কমলকানন’- এবং অনাদৃত অবমানিতা বাংলাভাষাকে নিজের স্বার্থক লেখনির দ্বারা জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসনে প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হলেন। তিনি সম্পাদনা করলেন মাসিকপত্র ‘বঙ্গদর্শন’ বাঙালি পাঠকদের দিলেন বিশেষ উপহার, বলিষ্ঠ লেখকগোষ্ঠীর সহযোগে তিনি সাংবাদিতার যে ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠা করলেন তা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকল, জাতীয় সাহিত্যের প্রথম অঙ্কুরোদগম বঙ্গদর্শনে।

বঙ্কিম রচিত উপন্যাস

দেশবাসীকে বিস্ময়চকিত করে তুলল বঙ্গদর্শনে তাঁর উপন্যাস ‘দুর্গেশনন্দিনী’ প্রকাশিত হলে কবিত্ব, ভাষার গম্ভীর ছন্দোভঙ্গি মায়, বর্ণনার নিপূন চাতুর্যে, ঐতিহাসিক ঘটনা ও রোমান্সের আশ্চর্য বিন্যাসে এই উপন্যাস অসাধারণ সৃষ্টির স্বীকৃতি পেল পাঠক সমাজের কাছ থেকে। পূর্ব মেদিনীপুরের হুগলি নদীর মোহনায় তরঙ্গমুখর নির্জন সমুদ্রতীরে আসন্ন সন্ধ্যার পটভূমিতে বনদুহিতা ‘কপালকুণ্ডলা’র যে বাণীবিগ্রহ তিনি রচনা করলেন, রোমান্স হিসাবে বিশ্বসাহিত্যেও তা অতুলনীয়। তিনি রচনা করলেন ‘বিষবৃক্ষ’, ‘চন্দ্রশেখর’, ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’, ‘মৃণালিণী’, ‘আনন্দমঠ’, ‘দেবীচৌধুরাণী’, ‘রজনী’, ‘ইন্দিরা’, ‘সীতারাম’ যা বাংলাসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। বঙ্কিমচন্দ্র এখনও অপ্রতিদ্বন্দ্বী, উপন্যাস – সাহিত্যে সম্রাটের যে মর্যাদা লাভ করেছেন সে বিষয়ে। বাংলা সাহিত্যে অনেক খ্যাতিমান সাহিত্যিকের অভ্যুদয় ঘটেছে, কিন্তু তিনি যে কল্পনার বিস্তার রচনা করেছেন সাহিত্যের পড়ভূমিতে, তিনি রচনার যে শৈল্পিকতার পরিচয় দিয়েছেন তা অনেকের মধ্যে দেখা যায় না।

সমালোচক বঙ্কিমচন্দ্র

শুধু ঔপন্যাসিক হিসাবে নয়, সমালোচক হিসাবে তাঁর ‘বিবিধ প্রবন্ধ’ ‘শ্রীকৃষ্ণচরিত্র’, ‘গীতা’ প্রভৃতি মনন সমৃদ্ধ আলোচনা এবং শ্লেষগর্ভ ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ বাংলা সাহিত্যে এক অমর সৃষ্টি। উপন্যাসের রূপকলা ও রসসৃষ্টির মধ্যে বঙ্কিম যে লোকোত্তর প্রতিভার সাক্ষ্য রেখেছেন, সমালোচনার ক্ষেত্রে তাঁর সূক্ষ্ম বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি সেই প্রতিভার পূর্ণ পরিচিতি বহন করে, তাই রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ‘সব্যসাচী’ বলে আখ্যাত করেছেন।

বঙ্কিমচন্দ্রের শ্রেষ্ঠত্ব

বঙ্কিমচন্দ্রের শ্রেষ্টত্ব বিচার করতে হলে প্রথমেই বলতে হবে, তিনি বাংলা গদ্যকে পূর্ণতা দিয়ে সরসতা ও গতিশক্তি সঞ্চার করেছেন, নির্ধারণ করেছেন গদ্যের নির্দিষ্ট মান। তিনি বিদ্যাসাগর ও প্যাঁরীচাঁদ মিত্রের রচনারীতির সমন্বয় সাধন করে আদর্শ বাংলা গদ্যরীতি নিরূপিত করেন, ঐতিহাসিক ও পারিবারিক উপন্যাস রচনা করে কথাসাহিত্যের পরিধি সুদূর প্রসারিত করলেন। প্রথম মৌলিক তথা সার্থক উপন্যাস রচনা করে বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা সাহিত্যের ঔপন্যাসিকের পথিকৃতের আসন লাভ করলেন।

হাস্যরসের শ্রষ্ঠা বঙ্কিমচন্দ্র

বাংলা সাহিত্যে তিনি প্রর্বতন করলেন রুচিও সূচিতার। প্রাচীন কথাসাহিত্য ‘কামিনীকুমার’ বা ‘নয়নতারা’ জাতীয় গ্রন্থে যে সুলভ ও বিকৃত আদিরসের প্রাবল্য ছিল এবং টপ্পা, খেউড় গানের মধ্যে আমাদের চারিত্রিক অবনতি প্রকটিত হয়েছিল, বঙ্কিমচন্দ্রের লেখনির স্পর্শে তা পরিশোধিত ও মার্জিত হল। ‘বিদ্যাসুন্দর’ কাব্যের রুচি কলুষিত দেশে তিনি সাহিত্য সুন্দরের বেদী রচনা করলেন। আমরা কৌতুক বলতে ‘গোপাল ভাঁড়’ জাতীয় দেখাকে বুঝতাম। তিনি সাহিত্যকে প্রতিষ্ঠিত করলেন অনাবিল আনন্দ ও রসমধুর এক প্রেক্ষাপটে।

জাতীয়তাবাদের উদ্যোক্তা বঙ্কিমচন্দ্র

নৈর্ব্যত্তিক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি ও বলিষ্ঠ বুদ্ধির সহায়তায় যথার্থ সমালোচনা-সাহিত্যের সূত্রপাত করলেন বঙ্কিমচন্দ্র। শুধু তাই নয়, বৈদেশিক শিক্ষার আলোকে হিন্দুধর্ম্মের মমার্থ উদ্‌ঘাটন করার প্রয়াস পেলেন। তিনি হিন্দু শাস্ত্রের গূঢ়ার্থ, হিন্দুর শ্রেষ্ঠ দেবতা শ্রীকৃষ্ণের তাৎপর্য ও ঐতিহ্য প্রাঞ্জল ভাষায় তুলে ধরলেন। জাতীয়তাবোধের মন্ত্রে বাঙালিকে উদ্বুদ্ধ করলেন তিনি। ‘আনন্দমঠের’ ‘বন্দেমাতরম’ গানটি স্বাধীনতা বিপ্লবীদের মনে এনেছিল দেশাত্মবোধের জোয়ার।

এসব দিক থেকে বিচার করলে বাংলা গদ্য সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্র তুষারমৌলি উত্তুঙ্গ হিমাদ্রি শৃঙ্গের ন্যায় প্রদীপ্ত মহিমায় স্তব্ধগম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন হিমালয় নিঃসৃত সহস্র নির্ঝারিণীর মতোই তাঁর শতমুখী সাহিত্য স্রোতস্বিনী বাঙালির হৃদয় প্লাবিত করে চির প্রবাহবান।

উপসংহার

২০১৪ সালে সাহিত্য সম্রাটের ১৭৫ তম জন্মবর্ষ অতিবাহিত হল। বিরাট ব্যাত্বের অনন্যসাধারণ প্রতিভার অধিকারী বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা সাহিত্যের আঙিনায় যে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে প্রতিষ্ঠিত তা আজও অমলিন, দুপুর সূর্যের মতো দীপ্তিমান, সৃজনী ক্ষমতায় বিস্ময়। ইতিহাসের বিস্মৃতিময় তামসলোকে কবিকল্পনার বর্নাঢ্য আলোকসম্পাতে, নর নারীর হৃদয়রহস্য উন্মোচনে যে অসামান্য দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন তা চির সত্যম সুন্দরমের সমুচ্চ মিনারের আলোকে আজও গগনস্পর্শী। তাই বঙ্কিমচন্দ্র আমার হৃদয় জুড়ে সম্রাটের সিংহাসনে সুপ্রতিষ্ঠিত, আমার সবচেয়ে প্রিয় গ্রন্থকার।

আরও পড়ুন – বিশ্ব উষ্ণায়ণ ও গ্রিনহাউস এফেক্ট প্রবন্ধ রচনা

একাদশ শ্রেণির কলা বিভাগের যে কোনো প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন। কোনো উত্তর না পেলে আমাদের কমেন্ট বক্সে জানান।

Leave a Comment