পেশা প্রবন্ধ রচনা
ভূমিকা
‘পেশা’ বা ‘Profession’ শব্দটি খুবই পরিচিত একটি শব্দ। সাধারণভাবে জীবনধারণ বা জীবিকানির্বাহের উপায় বা প্যাকে পেশা হিসেবে অভিহিত করা হলেও সকল প্রকার জীবিকানির্বাহের উপায় কিন্তু পেশা নয়। কেন-না, তা জীবিকানির্বাহের উপায় বা পন্থাকে বলা হয় বৃত্তি বা Occupation। কোনো বৃত্তি তখনই পেশার মর্যাদা লাভ করবে, যখন তার সুশৃঙ্খল জ্ঞান ও তাত্ত্বিক ভিত্তি, বিশেষ দক্ষতা ও নৈপুণ্য, পেশাগত দায়িত্ব ও জবাবদিহিতা, পেশাগত সংগঠন ও নিয়ন্ত্রণ, পেশাগত নীতিমালা ও মূল্যবোধ, জনকল্যাণমুখীনতা ও উপার্জনশীলতা, ঐতিহাসিক পটভূমি এবং সামাজিক স্বীকৃতি থাকে। এদিক থেকে সকল পেশাকেই বৃত্তি বলা গেলেও সকল বৃত্তিকে পেশা বলে উল্লেখ করা যায় না। যেমন- রিকশাওয়ালা হচ্ছেন বৃত্তিজীবী এবং ডাক্তার হচ্ছেন পেশাজীবী।
পেশা কী?
‘পেশা’ শব্দটি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। এখনও পর্যন্ত পেশার সর্বজনস্বীকৃত কোনো সংজ্ঞা নেই। তবে বিভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও মোটামুটিভাবে পেশা বলতে যা বোঝায়, তা হল-এমন সব বৃত্তিমূলক সেবাকর্ম যা থেকে কোনো ব্যক্তি তার জীবিকা অর্জন করতে পারে। যেমন- ডাক্তারের ডাক্তারি, উকিলের ওকালতি, শিক্ষকের শিক্ষকতা। পেশার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে ব্যবস্থাপনা চিন্তাবিদদের মধ্যে মতপার্থক্য তৈরি হয়। যাই হোক, পেশা বলতে এমন এক বৃত্তিমূলক সেবাকর্মকে বোঝায় যার জন্য প্রয়োজন হয় বিশেষ জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ; যা কেবল ব্যক্তির আত্মতুষ্টির জন্য নয়, সেইসঙ্গে সমাজের বৃহত্তর স্বার্থেও ব্যবহৃত হয় এবং যার সাফল্য কেবল আর্থিক মানদণ্ডে নয়, সামাজিক মানদণ্ডেও পরিমাপ করা হয়। সুতরাং, পেশা হল এমন ধরনের কাজ যার জন্য প্রয়োজন হয় বিশেষায়িত দক্ষতা ও প্রশিক্ষণের এবং যার মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করা যায়।
পেশার প্রয়োজনীয়তা
পেশা বলতে আমরা সাধারণত অর্থ উপার্জনের মাধ্যমকেই বুঝি। লেখাপড়া শেষ করে একটা ভালো বেতনের চাকরি পেতে হবে, সরল চোখে এটাই বড়ো চাওয়া। তবে পেশা নির্বাচনে বেতনটাই যে একমাত্র জরুরি বিষয় তাও কিন্তু নয়। যে পেশাগুলো ৪-৫ বছর পরও চাহিদাসম্পন্ন থাকবে, তাতে আয় কেমন হবে-এ বিষয়গুলি ভালো করে বুঝে নিতে হবে। যে পেশায় আমার আগ্রহ আছে সে পেশা সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে হবে।
এক্ষেত্রে আমাদের উচিত ওই পেশায় কর্মরত মানুষের সঙ্গে কথা বলা। এতে কাজের ধরন, পরিবেশ সবকিছু সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে। এ ধরনের সবকিছু যাচাই করার পরই ভবিষ্যতে পছন্দের পেশাটিকে বেছে নিতে হবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পেশা পরিকল্পনায় পরিবর্তন আসতে পারে, এটাই স্বাভাবিক। তবে জীবনে সাফল্য পেতে গেলে এমন কাজ বেছে নেওয়া উচিত, যে কাজ আগ্রহ কিংবা ভালোবাসা থেকে করা যায়। এতে সেই নির্দিষ্ট কাজকে কখনও ‘কাজ’ বলে মনে হবে না, কাজ করতে গিয়ে অযথা একঘেয়েমি তৈরি হবে না।
একক স্বনির্ভর
নিজে উদ্যোগী হয়ে নিজের কাজের ব্যবস্থা করাকে একক স্বনির্ভর কর্মসংস্থান বলে। কোনো ব্যক্তির কোনো প্রতিষ্ঠানে নির্দিষ্ট বেতনের বিনিময়ে চাকরি না করে স্বীয় যোগ্যতা ও দক্ষতার বলে সেবা প্রদানের মাধ্যমে অর্থ উপাজন করে জীবিকানির্বাহ করাকে বলা হয় একক স্বনির্ভর বা আত্ম-কর্মসংস্থান।
যৌথভাবে স্বনির্ভর
স্বনির্ভর দল গঠন কোনো সরকারি প্রকল্প নয়। এটি হল নিজেদের অল্প অর্থ দল বেঁধে সঞ্চয় করে, নিজেদের ছোটো ছোটো প্রয়োজনে সেখান থেকে ঋণ নিয়ে আর সুদসহ শোধ দিয়ে তহবিল বাড়ানোর ব্যবস্থা, ব্যাংকের সঙ্গে সুসম্পর্ক ও বিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরি করার ও ঋণ পাওয়ার উপায়, নিজেদের সক্ষমতা বাড়ানোর পথ। সক্ষমতা তৈরি হলে আর ঋণ পাওয়া গেলে আয় বাড়ানোর মতো জীবিকা তৈরি করা যায়। আবার অন্যভাবে বলা যায়-আয় বাড়লে সক্ষমতাও বাড়ে। তখন সমাজের নানা কাজে যুক্ত হওয়া যায়। এর জন্য দল গঠন করতে হবে। কেন-না, সবার অর্থ, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা আর মতামতকে একত্র করতে পারলে সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষেরা নিজেদের পরিবর্তন করতে পারবে। আর সেইসঙ্গে ঘটবে সামাজিক পরিবর্তন। যৌথ উদ্যোগে গ্রামেরও উন্নয়ন হবে। গ্রামের উন্নতি হলে নিজেরও উন্নতি হবে।
সরকারি চাকরি
কর্পোরেট চাকরির তুলনায় সরকারি চাকরি উচ্চস্তরের নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত থাকে। সরকারি পদগুলি সাধারণত স্থিতিশীলতা, দীর্ঘমেয়াদি কর্মসংস্থান এবং আকস্মিক ছাঁটাই করার বিরুদ্ধে সুরক্ষা প্রদান করে। যাঁরা স্থিতিশীলতা এবং অনুমানযোগ্য সময়সূচি খুঁজছেন এমন ব্যক্তিদের জন্য এটি উপকারী হতে পারে। অনেক সরকারি চাকরি জনসেবার ওপর বিশেষ নজর দেয় এবং সমাজকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। একটি সরকারি চাকরি সেই ব্যক্তিদের জন্য পরিপূর্ণতার অনুভূতি দিতে পারে যারা সম্প্রদায়ের সেবা করে এবং বৃহত্তর ভালোতে অবদান রাখে।
বেসরকারি চাকরি
কোনো ব্যক্তি অনেক সময় তার পেশার জন্য বেসরকারি সংস্থাকে বেছে নেওয়ার পরিকল্পনা করে। বর্তমানে তারা সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে অধিক প্রতিযোগিতা হওয়ার কারণে বেসরকারি কোনো সংস্থায় কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। তবে বেসরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কী কী সুবিধা বা অসুবিধা আছে তা অনেকের কাছেই অজানা। দেখা যাক বেসরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কী কী সুবিধা বা অসুবিধা আছে। বেসরকারি চাকরির নিয়োগ প্রক্রিয়া খুব কম সময়ের মধ্যে হয়। কিন্তু সরকারি ক্ষেত্রে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় বেশি সময় লেগে যায়।
বেসরকারি চাকরিতে কাজের চাপ বেশি থাকে। এই চাকরিতে বেতনের পরিমাণ কমবেশি কর্মচারীর কাজের স্কিলের ওপর নির্ভর করে। তা ছাড়া বেশি কাজ করলে কোম্পানির পক্ষ থেকে অধিক টাকাও দেওয়া হয়। বেসরকারি অফিসের কাজ ডিজিট্যাল পদ্ধতিতে বেশি করানো হয়। এতে অনেক কম সময়েই কাজ হয়ে যায়। তা ছাড়া স্বাধীনভাবে সৃজনশীল কাজ করার সুযোগ থাকে। তবে অনেক অসুবিধাও আছে। যেমন-নির্ধারিত সময়ের বাইরেও কাজ করিয়ে নেওয়া হয়, ছুটির পরিমাণও অনেক কম থাকে, পেনশনের সুবিধা নাও থাকতে পারে।
আধা-সরকারি চাকরি
যে সকল প্রতিষ্ঠানের সবকিছু পরিচালনা, নিয়ন্ত্রণ, হস্তক্ষেপ করে সরকার সেগুলো হল সরকারি। এই সব প্রতিষ্ঠানগুলি সরকারের অধীনেই পরিচালিত হয় অর্থাৎ সরকারি প্রতিষ্ঠানে সরকারের প্রত্যক্ষ প্রভাব বিদ্যমান। আর আধা-সরকারি বলতে যেসব প্রতিষ্ঠানে সরকারের প্রায় ৫০% শেয়ার বা অংশীদার থাকে, সেসব প্রতিষ্ঠানকেই বোঝায়। এসব প্রতিষ্ঠান কিছুটা সরকারি নিয়ম মেনে চলে, তবে এদের বেতন কাঠামো আলাদা। এককথায় এসব চাকরি হল নগদে চাকরি।
স্বদেশে চাকরি
দেশের প্রায় অধিকাংশ মানুষ পেটের দায়ে হোক আর জীবন জীবিকার প্রয়োজনেই হোক দেশের বাইরে কাজ করছে এটাই এখন বাস্তবতা। তারা তাদের আয়ের বেশিরভাগই দেশে পাঠিয়ে দেয়। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার আমদানিকরণে তাদের ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু বিদেশে যারা আছেন তাদের জীবনযাপন কিন্তু সহজ নয়। খাওয়াদাওয়া, থাকা সব কিছুতেই কষ্ট। ছোটো একটা রুমে গাদাগাদি করে থাকতে হয়। হাড়ভাঙা পরিশ্রম, কোনো আরাম-আয়েস নেই, নেই কোনো বিনোদন। তাই স্বল্পশিক্ষিত থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষিত প্রত্যেকেরই উচিত নিজেদের দেশেই থেকে, দেশকে ভালোবেসে দেশের উন্নয়নের স্বার্থে যে-কোনো ধরনের চাকরি করা। সেখানে অর্থের প্রাচুর্য বা বিলাসিতা না থাকলেও নিজের পরিবারের কাছাকাছি থাকা যায়।
বিদেশে চাকরি
বিদেশে কর্মসংস্থানের অনেক সুবিধা রয়েছে, যেমন- নতুন দক্ষতা অর্জন, বিভিন্ন সংস্কৃতির অভিজ্ঞতা এবং উচ্চ বেতন উপার্জন। তবে কিছু অসুবিধার কথাও বলতে হয়, যেমন পরিবার এবং বন্ধুদের থেকে দূরে থাকা, একটি নতুন সংস্কৃতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে সংগ্রাম করা এবং ভিন্ন ভাষার সম্মুখীন হওয়া। বিদেশে সেই প্রবাসীদের সম্মান করা হয় যারা স্কিল নিয়ে যায় বা যাদের বিশেষ কর্মযোগ্যতা থাকে। কারণ, বিদেশে আইন মেনে চলতে হবে। সরকার তাদের দেশের মানুষের সমান সুযোগসুবিধা, অধিকার কোনোটাই তাদের দেবে না, যদি না তোমাকে তাদের প্রয়োজন মনে করে।
উপসংহার
কাজ এবং পেশা মানুষের জীবনে অপরিসীম তাৎপর্য রাখে, বস্তুগত সামাজিক এবং মনস্তাত্ত্বিক চাহিদা পূরণ করে। মৌলিক প্রয়োজনীয়তা প্রদান, মানসিক স্বাস্থ্য বজায় রাখা এবং সামাজিক মর্যাদা নির্ধারণের জন্য পেশার ভূমিকা অপরিহার্য। কাজ আর্থিক পুরস্কারের বাইরে প্রেরণা হিসেবে কাজ করে এবং বিভিন্ন মতাদর্শে কাজের নৈতিক গুরুত্বের ওপর জোর দেয়। বিভিন্ন ধরনের কাজের ওপর স্থাপিত মান পরিবর্তিত হয় এবং বেকারত্ব মানসিক সুস্থতার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। সার্বিকভাবে, কাজ ও পেশাগুলি মানুষের অস্তিত্ব এবং সমাজ গঠনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
আরও পড়ুন – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা