“পূর্ণ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি সম্ভবও নয়, সমীচীনও নয়”-আলোচনা করো
“পূর্ণ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি সম্ভবও নয়, সমীচীনও নয়।” আলোচনা
মূল বক্তব্য
আধুনিক রাষ্ট্রে সরকারের যাবতীয় কাজকর্ম পরিচালনা করার জন্য প্রধান তিনটি বিভাগ রয়েছে, যথা-আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ। ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির মূল কথা হল, সরকারের এই তিনটি বিভাগ নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ক্ষমতা প্রয়োগ করবে। ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি অনুসারে এক বিভাগ অন্য বিভাগের কাজে হস্তক্ষেপ করবে না এবং একই ব্যক্তি একাধিক বিভাগের সঙ্গে যুক্ত থাকবে না।
মঁতেস্কুর অভিমত
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির মূল প্রবক্তা ফরাসি দার্শনিক মঁতেস্কু তাঁর The Spirit of the Laws গ্রন্থে এই অভিমত প্রকাশ করেন যে, সরকারের মূল তিনটি কাজ [যথাক্রমে আইন প্রণয়ন, আইনের বাস্তবায়ন (প্রশাসন) ও বিচারকার্য তিনটি পৃথক বিভাগের মাধ্যমে সম্পাদিত হওয়া উচিত। একই ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হাতে সরকারের এই তিনটি কাজ থাকা উচিত নয়। কারণ সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বৈরাচারী প্রবণতা দেখা দেবে ও তার ফলে ব্যক্তিস্বাধীনতা বিপন্ন হয়ে পড়বে। কাজেই ব্যক্তিস্বাধীনতা বজায় রাখার জন্য ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির স্বীকৃতি প্রয়োজন। মূলত সমকালীন (1748 খ্রি.) ইংল্যান্ডের শাসনব্যবস্থাকে বিশ্লেষণ করে মতেস্ক ব্যক্তিস্বাধীনতার রক্ষাকবচ হিসেবে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ তত্ত্বের প্রচার করেন। মার্কিন সংবিধান রচয়িতাদের অন্যতম ম্যাডিসন বলেন, একই হাতে সকল ক্ষমতার পুঞ্জীকরণকে সঠিক অর্থে স্বৈরাচারিতার অন্য নাম বলে চিহ্নিত করা যেতে পারে (“The accu- mulation of all powers… in the same hands may justly be pronounced as the very definition of tyranny”)।
পূর্ণ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ সম্ভব নয়
যে সমস্ত কারণে পূর্ণ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ বাস্তবে সম্ভব বলে মনে করা হয় না, সেগুলি হল-
[1] সরকারি বিভাগগুলি পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে চালিত হয়: ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির পূর্ণ প্রয়োেগ বাস্তবে আদৌ সম্ভব নয়। কারণ আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকারের প্রধান তিনটি বিভাগকে কখনোই পুরোপুরি পৃথক করা যায় না। সংসদীয় ব্যবস্থায় একজন ব্যক্তি একাধিক বিভাগের সঙ্গে যুক্ত থাকে। যেমন, ভারত ও ব্রিটেনের মন্ত্রীপরিষদ চালিত শাসনব্যবস্থায় দেখা যায় মন্ত্রীরা একদিকে যেমন শাসন বিভাগের কার্যাবলি সম্পাদন করছেন, অন্যদিকে তেমনি আইনসভার সদস্য হিসেবে আইন প্রণয়নের কাজেও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছেন। অনুরূপভাবে ভারতের রাষ্ট্রপতি ও ব্রিটেনের রানি একদিকে যেমন শাসন বিভাগের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ, অন্যদিকে তেমনি আবার আইনসভার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
[2] মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি প্রয়োগে অসংগতি: ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিটি যে দেশের সংবিধানে প্রথম গৃহীত হয়, সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তত্ত্বগতভাবে তিনটি বিভাগকে পুরোপুরি পৃথক করে দেওয়ার কথা বলা হলেও বাস্তবে কিন্তু বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। যেমন মার্কিন রাষ্ট্রপতি শাসন বিভাগের প্রধান হলেও বিচারপতিদের তিনি নিয়োগ করেন। বিচারপতিরা আবার প্রয়োজন মনে করলে রাষ্ট্রপতির নিয়োগ সংক্রান্ত নির্দেশ বাতিল করে দিতে পারেন।
অনুরূপভাবে মার্কিন আইনসভার উচ্চকক্ষ সিনেট সরকারি কর্মচারীর নিয়োগ সংক্রান্ত রাষ্ট্রপতির নির্দেশনামা অনুমোদন না করলে তা কোনোভাবেই বাস্তবায়িত হয় না। বস্তুত সংসদীয় বা রাষ্ট্রপতি-শাসিত যে ধরনের সরকারই হোক না কেন, বর্তমান বিশ্বে দলব্যবস্থার প্রভাবের ফলে আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। এ অবস্থায় ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির পূর্ণ প্রয়োগ কখনোই সম্ভব নয়।
[3] তত্ত্বগতভাবে সম্ভব, বাস্তবে নয়: অনেকের মতে, পূর্ণ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ তত্ত্বগতভাবে সম্ভব হলেও বাস্তবে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। বাস্তবে সরকারের বিভিন্ন বিভাগ একে অপরের সঙ্গে জড়িত রয়েছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, আইনসভার হাতে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা থাকলেও যে সময়ে আইনসভার অধিবেশন বন্ধ থাকে সেই সময়ে শাসন বিভাগের প্রধান (ভারতের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি) দেশের প্রয়োজনে সাময়িকভাবে অধ্যাদেশ বা অর্ডিন্যান্স জারি করতে পারেন। এ ছাড়াও বর্তমানে আইনসভার কাজকর্ম যেভাবে বেড়ে গেছে তাতে আইনের খুঁটিনাটি বিষয়গুলির নির্ধারণের ভার আইনসভা শাসন বিভাগের হাতে তুলে দেয়। শাসন বিভাগের প্রণীত এ ধরনের আইনকে অর্পিত ক্ষমতাপ্রসূত আইন (Dele- gated Legislation) বলা হয়। অনুরূপভাবে, বিচারকার্য সম্পাদন করতে গিয়ে অনেক সময় চলতি আইন যথেষ্ট বলে মনে না হলে বিচারপতিরা আইনের উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য ব্যাখ্যার মাধ্যমে নতুন আইন সৃষ্টি করেন। একে বিচারপতিদের দ্বারা প্রণীত আইন বলা হয়। অন্যদিকে শাসন বিভাগের হাতেও বিচারের কিছু কাজ থাকে, যেমন রাষ্ট্রপ্রধান কর্তৃক দণ্ডিত অপরাধীর শাস্তি মকুব বা হ্রাস ইত্যাদি। ব্রিটেন ও ফ্রান্সে প্রশাসনিক ন্যায়বিচার (Administrative Justice)-এর অস্তিত্ব রয়েছে। এর মাধ্যমে শাসন বিভাগের সঙ্গে জড়িত কর্মীদের অন্যায় আচরণের বিচার ও শাস্তি দেওয়া হয়। কাজেই এ থেকে সুস্পষ্টভাবে বলা যায় যে, পূর্ণ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ বর্তমান আধুনিক রাষ্ট্রের পক্ষে অসম্ভব।
পূর্ণ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ সমীচীনও নয়
পূর্ণ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণকে সমীচীন মনে না করার কারণগুলি হল-
[1] প্রশাসনিক অচলাবস্থার আশঙ্কা: জন স্টুয়ার্ট মিল, ব্লুন্টন্সি, ফাইনার, ল্যাস্কি প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মতে, ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিটির পূর্ণ প্রয়োগ আদৌ সমীচীন বা কাম্য নয়। অধ্যাপক ল্যাস্কির মতে, আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে কাজ করলে এই স্বাতন্ত্র্য বিরোধ ডেকে আনবে। ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির পটভূমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্বয়ং ম্যাডিসন ও অন্য যুক্তরাষ্ট্রীয়পন্থীরা এ বিষয়ে ওয়াকিবহাল ছিলেন যে, ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিকে কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হলে প্রশাসন অচল হয়ে পড়বে।
[2] জৈব মতবাদীদের বক্তব্য: বিখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ব্লুন্টন্সির মতে সরকারি কাজকর্মের দক্ষতা ও সফলতা অর্জনের কারণেও পূর্ণ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ সমীচীন নয়। কারণ সরকারের দক্ষতা ও সাফল্য প্রধান তিনটি বিভাগের পারস্পরিক সহযোগিতার ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু পূর্ণ ক্ষমতা-স্বতন্ত্রীকরণের ফলে তিনটি বিভাগ যদি একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করে তাহলে সরকারের কাজকর্ম কখনোই সুষ্ঠুভাবে চলতে পারে না। সেক্ষেত্রে, সরকারি কাজকর্ম অচল হয়ে পড়তে পারে।
[3] আইন বিভাগের শ্রেষ্ঠতা: ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি মনে করে যে, সরকারের তিনটি বিভাগের ক্ষমতা সমান। কিন্তু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সাধারণত আইন বিভাগ অন্য দুটি বিভাগ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতার দাবি রাখে। সংসদীয় গণতন্ত্রে আইনসভা হল চূড়ান্ত সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। তা ছাড়া আইন বিভাগ যথাযথভাবে আইন প্রণয়ন না করলে শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়তে পারে। এই কারণে পূর্ণ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ কখনোই সমীচীন বা কাম্য হতে পারে না।
[4] সংসদীয় গণতন্ত্রে কাম্য নয়: সর্বোপরি যেসব দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র বা মন্ত্রীসভা-চালিত শাসনব্যবস্থা রয়েছে (যেমন গ্রেট ব্রিটেন, ভারত প্রভৃতি), সেখানে আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের মধ্যে পৃথকীকরণ কখনোই সমীচীন বা কাম্য হতে পারে না। সংসদীয় গণতন্ত্রের নিয়ম অনুসারে আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগকে সবসময় ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে চলতে হয়।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায়, বাস্তবে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির পূর্ণ প্রয়োগ কখনোই সমীচীন হতে পারে না। তবে আংশিক ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ বিচার বিভাগের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রয়োজন। কারণ ন্যায় ও নিরপেক্ষ বিচারের স্বার্থে বিচার বিভাগের স্বাতন্ত্র্য অপরিহার্য।
আরও পড়ুন – রাজনৈতিক তত্ত্বের মূল ধারণাসমূহ ২ নম্বরের প্রশ্ন ও উত্তর