পুরুষার্থ প্রশ্ন উত্তর একাদশ শ্রেণি দর্শন | Class 11 Second Semester WBCHSE
ভারতীয় নীতিবিদ্যায় ‘পুরুষার্থ’ শব্দের অর্থ কী?
অথবা, পুরুষার্থের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ কী?
‘পুরুষার্থ’ বলতে বোঝায় মানুষ বা পুরুষের কাঙ্ক্ষিত বিষয়। মানুষের কাঙ্ক্ষিত এই চারটি পুরুষার্থ হল ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ। সকল মানুষ সুখের আকাঙ্ক্ষা করে। আর এই সুখলাভের উপায়ও আছে, সেই উপায়গুলিকে বলা হয় পুরুষার্থ। প্রকৃতপক্ষে, পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করার পর মানুষ যা চায়, তার সমস্ত কিছু এই চারটি লক্ষ্যের মধ্যে কোনো-না-কোনো লক্ষ্যের অন্তর্গত থাকে। কিছু লোক ধর্মকে লক্ষ্য করে, কেউ অর্থ চায় এবং কেউ যৌনতার পরিপূর্ণতা চায় আবার কেউ মুক্তির আকাঙ্ক্ষা করে। সাধারণত মানুষ দুঃখনিবৃত্তি ও সুখপ্রাপ্তির প্রার্থনা করে। বৈদিক দৃষ্টিতে জীবনের লক্ষ্য ভোগ নয় ত্যাগ, আসক্তি নয় বৈরাগ্য বা অনাসক্তি। এই প্রসঙ্গে মহর্ষি জৈমিনি তাঁর ‘মীমাংসাসূত্র’ গ্রন্থে বলেছেন-“যস্মিন্ প্রীতিঃ পুরুষস্য তস্য লিন্সার্থলক্ষণম্”। অর্থাৎ যেখানে বা যে বিষয়ে মানুষের প্রীতি নিহিত থাকে তার কামনাই পুরুষার্থ।
‘পুরুষার্থ’ পদের ‘অর্থ’-কে দুইভাবে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে-
• পুরুষের ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষরূপ যে প্রয়োজন।
• পুরুষের দ্বারা যা কিছু অর্জিত বা প্রার্থিত।
‘অর্থ’ পদের অর্থ প্রার্থনা বা যাচনা। তবে যে-কোনো ভাবে যাচনা বা প্রার্থনা নয়। ‘অর্থ’ পদের অর্থ সম্যকরূপে যাচনা বা প্রার্থনা অর্থাৎ যথাযথরূপে যাচনা বা প্রার্থনা।
ভারতীয় নীতিবিদ্যায় কয়প্রকার পুরুষার্থ স্বীকৃত হয়েছে ও কী কী? সংক্ষেপে লেখো।
পুরুষার্থের প্রকার
কাম্যবস্তু মনে করে মানুষ যাকে কামনা করে তাই মানুষের জীবনের পুরুষার্থ। সাধারণত মানুষ দুঃখনিবৃত্তি ও সুখপ্রাপ্তির প্রার্থনা করে। তাই চিরাচরিতভাবে ভারতীয় নীতিবিদ্যায় চার প্রকার পুরুষার্থ স্বীকৃত। যথা- ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ।
ধর্ম
ধর্ম সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠী বা বর্ণের মধ্যে শৃঙ্খলা ও সংহতি রক্ষা করে। অর্থাৎ ধর্ম সর্বদা রক্ষণশীল সমাজের কথা বলে যা সুখজনক তথা উন্নত জীবনযাপনের পথকে প্রশস্ত করে স্বর্গলাভের কথা বলে, তাই এটি পুরুষার্থ।
অর্থ
অর্থ হল বস্তুসম্পদ, যা ব্যক্তিকে বস্তুগত আরাম দেয়। মানুষের জীবনের বিভিন্ন কামনা-বাসনা ও সামাজিক কর্তব্য পালনের জন্য অর্থের প্রয়োজন হয়। সহজ কথায় অর্থ সাক্ষাৎভাবে সুখ উৎপাদন না করলেও তার দ্বারা কাম তৃপ্ত হয়। তাই এটি পুরুষার্থ।
কাম
কাম জৈবতৃষ্ণা পরিতৃপ্ত করে সুখ উৎপন্ন করে। তাই এটি পুরুষার্থ। অর্থাৎ কাম বলতে জাগতিক যে-কোনো বিষয়ের প্রতি আকাঙ্ক্ষাকে বোঝানো হয়েছে।
মোক্ষ
মোক্ষলাভে সমস্ত দুঃখের ঐকান্তিক ও আত্যন্তিক নিবৃত্তি হয়। এই মোক্ষই পরম পুরুষার্থ, যা পেলে মানুষ আর কিছু চায় না।
কাম্যবস্তু কী? কাম্যবস্তুকে কীভাবে লাভ করা যায়?
কাম্যবস্তু
মানুষের কাঙ্ক্ষিত বা প্রার্থনীয় বিষয়কে বলা হয় কাম্যবস্তু। পুরুষ বা মানুষের ঈপ্সিত বা কাম্যবস্তু হল পুরুষার্থ, যাকে সচেতন মানুষ প্রয়োজনসাধক বস্তুরূপে গ্রহণ করে। আর পরমপুরুষার্থ বলতে পরমকাম্য বস্তুকে বোঝায়। পরম কাম্যবস্তু হল সেই বস্তু যা লাভ করলে মানুষ আর কিছুই চায় না।
কাম্যবস্তু লাভের উপায়
ভারতীয় নীতিশাস্ত্রে মানুষের কাম্যবস্তু হল চারটি। যথা- ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ। ভালো থাকার তাগিদেই এই চতুর্বর্গ পুরুষাৰ্থ প্রার্থিত হয়ে উঠেছে। কাম্যবস্তুগুলিকে সাধনা ও প্রচেষ্টার দ্বারা লাভ করতে হয়। জ্ঞানযোগ, কর্মযোগ, ভক্তিযোগ প্রভৃতির মাধ্যমে নির্দেশিত পথ অবলম্বন করে কাম্যবস্তুকে লাভ করা যায়। এই কাম্যবস্তু নৈতিক আদর্শের আলোকে আলোকিত, যা মানুষের চরিত্র গঠনে সহায়তা করে।
ত্রিবর্গ ও চতুর্বর্গ পুরুষার্থ কী?
পুরুষার্থের সংখ্যা নিয়ে কিছু মতভেদ আছে। অনেকের মতে আদিতে ধর্ম, অর্থ ও কাম এই ত্রিবর্গই পুরুষার্থের অন্তর্গত ছিল। যারা ত্রিবর্গ স্বীকার করেন তাদের মতে শুধু অর্থ নয়, ধর্মও কাম সিদ্ধির উপায় অর্থাৎ এই মতে কামই আসল লক্ষ্য। কেউ কেউ ত্রিবর্গের অন্তর্গত ধর্ম, অর্থ ও কামের মধ্যে ধর্ম ও অর্থকে কামের তুলনায় শ্রেয় বলেছেন। আবার কেউ কেউ কাম ও অর্থকে ধর্মের তুলনায় শ্রেয় বলে গণ্য করেছেন। সুতরাং ত্রিবর্গের অন্তর্গত ধর্ম, অর্থ ও কাম-এই তিনটি পুরুষার্থ একপ্রকার নয়। আসলে ধর্ম, অর্থ ও কাম-এই তিনটি পুরুষার্থের আবেদন সাধারণ মানুষের কাছে অনুভূত হয়। সেই কারণে ত্রিবর্গ সাধারণ মানুষের আদর্শ।
অপরদিকে বৈদিক ধর্মনীতি অনুসারে চতুর্বর্গরূপে স্বীকৃত ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ এই চার প্রকারের পুরুষার্থের আলোচনা অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থান পেয়েছে। এই চারটি পুরুষার্থকে একত্রে চতুর্বর্গ বলা হয়। চতুর্বর্গে বিশ্বাস করেন যারা তাদের মতে মোক্ষই মানবজীবনের প্রকৃত লক্ষ্য। ধর্ম, অর্থ ও কাম মোক্ষলাভের উপায়। কেন-না ধর্মবোধের দ্বারা পরিচালিত অর্থ ও কামের সাধনা মানুষের চিত্তকে নিষ্কলুষ করে। আর মানুষকে মোক্ষ সাধনায় উপযোগী করে। তাই ধর্ম, অর্থ ও কাম মানুষের প্রেয় হতে পারে। কিন্তু একমাত্র মোক্ষই মানুষকে শ্রেয়-এর দিকে নিয়ে যায়। তাই শাস্ত্রকারগণ মোক্ষকেই পরমপুরুষার্থ বলেছেন।
চতুর্বিধ পুরুষার্থ আমাদের প্রার্থিত কেন?
চতুর্বিধ পুরষার্থের ধারণা একাধারে মানুষের ভোগ প্রবৃত্তির এবং ভোগ বিযুক্ত নিবৃত্তির পারস্পরিক নিবিড় সম্বন্ধে গ্রথিত করে রেখেছে। দুঃখনিবৃত্তি ও সুখপ্রাপ্তি মানুষের মুখ্য প্রয়োজন। বিচার করলে দেখা যাবে যে প্রতিটি পুরুষার্থই দুঃখনিবৃত্তি ও সুখপ্রাপ্তির উপায়। এ কথা অনস্বীকার্য যে সাধারণ মানুষ পার্থিব সুখেরই কামনা করে। ‘কাম’ শব্দটি জৈব তৃষ্ণার নিবৃত্তিজনিত সুখকে বোঝায়। জৈব কামনা পরিতৃপ্ত হলে সুখ উৎপন্ন হয়। অর্থ সাক্ষাৎভাবে সুখ উৎপাদন না করলেও এর দ্বারা কাম তৃপ্ত হয়। অর্থ ও কাম যখন ধর্মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয় তখন যে সুখ লাভ হয় তা মানুষের ইষ্টলাভে সাহায্য করে। এক্ষেত্রে ধর্মকে নৈতিক মূল্য হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। যাই হোক অর্থ, কাম, ধর্ম, মোক্ষ সবই পুরুষের অভীষ্ট-এ কথা অস্বীকার করা যায় না। ধর্ম মোক্ষের সাধন এবং ধর্মই অর্থ ও কামের নিয়ামক। সুতরাং বলা যায় যে, ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ- এই চারটি পুরুষার্থ আমাদের জীবনযাত্রার ভিত্তিস্বরূপ।
পূরুষার্থকে কেন সাধ্য বলা হয়? সমাজজীবনে ধর্মের প্রয়োজনীয়তা কী?
ভিতরে সাধনালব্ধ বিষয়রূপে পুরুষার্থ: সাধনীয় বিষয়কে বলা হয় সাধ্য। ভারতীয় নীতিবিদ্যায় মানুষের সাধনীয় বিষয় হল পুরুষার্থ। এই পুরুষার্থ বৈদিক চতুরাশ্রম জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে পর্যায়ক্রমে লাভ করতে হয়। ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ এদের পর্যায়ক্রম এত দৃঢ় যে একটিকে বাদ দিয়ে অপরটিকে লাভ করা যায় না। ভারতীয় নীতিশাস্ত্রে এই সকল কাম্যবস্তু চরম ও পরমমূল্যবান। কারণ তা মানুষের চরিত্রকে তার উচ্চ আদর্শের স্তরে উত্তরণ করতে সাহায্য করে। সুতরাং ভারতীয় নীতিতত্ত্বে পুরুষার্থ যেহেতু সাধনালব্ধ বিষয় সেহেতু তাকে সাধ্য বলা হয়।
সমাজজীবনে ধর্মের প্রয়োজনীয়তা: ধর্মকে সমাজজীবনের আদর্শ হিসেবে গণ্য করা যায়। কারণ ধর্মের বিচ্যুতি ঘটলে সেই সমাজে অমঙ্গল নেমে আসে। আধুনিক পরিভাষায় যাকে ‘ন্যায়ধর্ম’ বলা হয়, তাকেই ভারতীয় নীতিশাস্ত্রে ধর্ম বলা হয়েছে। এক কথায় বলা যায়, সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে মানুষ নিজের ও সমাজের সামগ্রিক মঙ্গলের জন্য যে-সমস্ত আচরণবিধি অনুসরণ করে তাই ধর্ম।
ধর্মকে পরতমূল্যবান পুরুষার্থ বলা হয় কেন? পুরুষার্থের তালিকায় ধর্মের উল্লেখ প্রথমে করা হয় কেন?
যা নিজমূলোই মূল্যবান তাকে বলা হয় স্বতঃমূল্যবান। অপরপক্ষে যা নিজমূল্যে মূল্যবান নয় এবং যাকে মূল্যবান হওয়ার জন্য অপরের উপর নির্ভর করতে হয় তা হল পরতমূল্যবান। ধর্মকে পরতমূল্যবান পুরুষার্থ বলা হয় কারণ ধর্মকে আমরা শুধুমাত্র ধর্মের জন্যই কামনা করি না, মোক্ষ প্রাপ্তির পথ সুগম করার জন্যই আমরা ধর্মের কামনা করে থাকি। ধর্মকে তাই স্বতঃমূল্যবান বলা যাবে না, কারণ ধর্মের মূল্য অপরের উপর নির্ভরশীল।
প্রবৃত্তির ক্ষেত্রে সংযম ও নিয়ন্ত্রণ রক্ষাই ধর্মের কাজ। পুরুষার্থের বর্গচতুষ্টয়ে ধর্মকে প্রথম স্থান দেওয়া হয়েছে। কারণ ধর্ম হল পুরুষার্থ লাভের পথ। ধর্মের পথ অনুসরণ করে কামনা পরিতৃপ্তি করতে হবে, অর্থ উপার্জন করতে হবে এবং মোক্ষলাভ করতে হবে। এই জন্য পুরুষের প্রয়োজন সাধক বস্তুর মধ্যে ধর্মের স্থান প্রথম।
প্রশস্তপাদ ও যাজ্ঞবন্ধ্যের মতে সামান্য ধর্ম কোনগুলি?
প্রশস্তপাদমতে সামান্য ধর্ম
সমাজে প্রতিটি মানুষের যে কর্ম করা কর্তব্য, সেই কর্মকেই প্রশস্তপাদ সামান্য ধর্ম বলেছেন। প্রশস্তপাদ যে সমস্ত সামান্য ধর্মের উল্লেখ করেছেন, তা হল- ধর্মে শ্রদ্ধা, অহিংসা, ভূতহিতত্ব, সত্যবচন, অস্তেয়, ব্রহ্মচর্য, অনুপধা, ক্রোধবর্জন, স্নান বা অভিষেচন, শুচিদ্রব্য সেবন, বিশিষ্ট দেবতা ভক্তি, উপবাস এবং অপ্রমাদ। এখানে অহিংসা বলতে শুধু হিংসা থেকে নিবৃত্ত হওয়ার কথা বলা হয়নি, বরং কোনো প্রাণীকূলকে আঘাত না করার সংকল্পকেই প্রকৃত অহিংসা বলা হয়েছে। প্রশস্তপাদ-এর মতে অহিংসা ও ভূতহিতত্ব মানুষের সংকীর্ণ আত্মবোধ ত্যাগ করতে সাহায্য করে।
যাজ্ঞবন্ধ্যমতে সামান্য ধর্ম
যাজ্ঞবন্ধ্য তাঁর ‘যাজ্ঞবল্ক্যস্মৃতি’-তে নয়টি সাধারণ ধর্মের উল্লেখ করেছেন। নয়টি সাধারণ ধর্ম হল- অহিংসা, সত্য, অস্তেয়, শৌচ, ইন্দ্রিয়নিগ্রহ, দান, দম, দয়া এবং শাস্তি।
পুরাণে উল্লিখিত নৈতিক নিয়ম কয়টি ও কী কী? ভারতীয় নীতিতত্ত্বে মূল্য কত প্রকার ও কী কী?
পুরাণমতে নৈতিক নিয়ম
পুরাণে উল্লিখিত নৈতিক নিয়ম হল দশটি। যথা- অহিংসা, ক্ষমা, শম-দম, দয়া, শৌচ, দান, সত্য, তপস্, অস্তেয় এবং জ্ঞান। মনুসংহিতায় বর্ণিত দশটি সাধারণ ধর্মের সঙ্গে পুরাণে উল্লিখিত দশটি নৈতিক নিয়মের সামঞ্জস্য পরিলক্ষিত হয়।
ভারতীয় নীতিতত্ত্ব অনুসারে মূল্যের প্রকারভেদ
ভারতীয় নীতিতত্ত্বে দুই প্রকার মূল্যের কথা বলা হয়েছে। যথা- স্বতঃমূল্য ও পরতমূল্য। মোক্ষ হল স্বতঃমূল্যবান পুরুষার্থ। আর ধর্ম, অর্থ ও কাম হল গৌণ বা পরতমূল্যবান পুরুষার্থ। স্বতঃমূল্য পুরুষার্থ কামনার জন্য মানুষের কাছে আবেদন করার প্রয়োজন হয় না। যা অপরের প্রয়োজন সাধন করে মূল্যবান হয় তা পরতমূল্যবান। ফলে তার নৈতিক প্রয়োজনীয়তা মানুষকে বোঝাতে হয়।
ভারতীয় শাস্ত্রে ‘ধর্ম’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে?
অথবা, ধর্ম পূরুষার্থকে কীরূপে ব্যাখ্যা করা যায়? এই পুরুষার্থটি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কেন?
‘ধর্ম’ পদের একাধিক অর্থ আছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল কর্ম অর্থে ধর্মের প্রয়োগ। ‘ধর্ম’ শব্দের একটি প্রাচীন অর্থ হল- “ধারণাৎ ধর্মম্ ইত্যাহুঃ” অর্থাৎ ধর্ম হল তাই যা মানুষ ও সমাজকে ধারণ বা রক্ষা করে। ‘ধর্ম’ শব্দটি এসেছে ‘ধৃ’ ধাতু থেকে। ‘ধৃ’ ধাতুর অর্থ ধারণ। ধর্মকে বলা হয়েছে ‘সর্বস্য ধারকম্’। অর্থাৎ ধর্ম সবকিছুকেই ধারণ করে। মনু ভাষ্যকার মেধাতিথির ব্যাখ্যা অনুযায়ী ধর্ম হল সমাজবন্ধ মানুষের কর্তব্য। এই অর্থে ধর্মকে কর্তব্যতা বলা যায়। কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হলে মানুষ ও সমাজ বিপর্যস্ত হয়। একইভাবে ধর্ম বিনষ্ট হলে ধর্ম বিনষ্টকারীর বিনাশ হয়। আর ধর্ম রক্ষিত হলে ধর্ম সাধনকারী রক্ষা পায়। সুতরাং বলা যায় পুরুষার্থ সমূহের ভিত্তি ধর্ম ছাড়া আর কিছু নয়। তাই ধর্মকে উপেক্ষা করে অর্থ বা কাম এমনকি মোক্ষের সাধনাও করা যায় না।
সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠী বা বর্ণের মধ্যে শৃঙ্খলা ও সংহতি স্থাপনের জন্য ধর্মকে একটি সামাজিক ও নৈতিক বিধি বলে স্বীকার করা হয়েছে। ধর্মের এই সামাজিক তাৎপর্য বিচার করলে দেখা যায় যে ধর্ম যেন একটি শৃঙ্খলাসূত্র। ধর্ম একটি নীতি যা ব্যক্তিকে সমাজকল্যাণে উদ্বুদ্ধ করে। সহজ কথায় বলতে গেলে বলতে হয় কাম ও অর্থ এই দুটি পুরুষার্থ ধর্মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হলেই মানুষ যথার্থ সামাজিক জীবনযাপন করতে পারবে।
ধর্মের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লেখো।
ভারতীয় নীতিশাস্ত্রে ধর্মকে প্রথম পুরুষার্থ হিসেবে গণ্য করা হয়। ধর্ম হল সুনীতি ও সদাচার যেগুলি ব্যক্তিমানুষের জীবনে অবশ্য পালনীয়। ধর্মের কিছু বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হল-
প্রথমত মনুস্মৃতিতে বলা হয়েছে-
বেদ বা শ্রুতি, স্মৃতি, সাধু ব্যক্তির অনুমোদিত সৎ আচরণকে যেমন ধর্মরূপে গ্রহণ করা হয় তেমনি প্রতিটি ব্যক্তির বিবেকের কাছে গ্রহণীয় বিষয়কেও ধর্ম হিসেবে স্বীকার করা হয়।
দ্বিতীয়ত মহাভারতে ধর্ম বলতে সদাচার ও সুনীতি পালনকে বোঝানো হয়েছে।
তৃতীয়ত প্রাচীনকালে স্বীকৃত নীতিহীন অনুষ্ঠানাদি-ক্রিয়া যে মূল্যহীন – তা স্বীকার করলে সমস্ত নৈতিক আরচণকে ক্রিয়া অনুষ্ঠানের আবশ্যিক শর্ত বলতে হয়।
চতুর্থত ঋগ্বেদে যজ্ঞকর্ম বোঝাতে ধর্ম কথাটি ব্যবহৃত হয়।
পঞ্চমত মহর্ষি কণাদ তাঁর ‘বৈশেষিক সূত্রে’ ধর্মের লক্ষণে বলেছেন “যতোহভ্যুদয় নিঃশ্রেয়স সিদ্ধিঃ স ধর্মঃ” অর্থাৎ যা হতে অভ্যুদয় অর্থাৎ তত্ত্বজ্ঞানের দ্বারা নিঃশ্রেয়স বা মোক্ষ লাভ হয় তাই তত্ত্বজ্ঞানই ধর্ম।
ষষ্ঠত মহর্ষি জৈমিনি তাঁর মীমাংসাসূত্রে ধর্মের লক্ষণ দিয়ে বলেছেন-“চোদনালক্ষণঃ অর্থঃ ধর্মঃ” (১/১/২) অর্থাৎ বেদবাক্য দ্বারা লব্ধ কর্মই হল ধর্ম। এককথায় বেদে কথিত যাগযজ্ঞ প্রভৃতি কর্মই হল ধর্ম।
ধর্মকে নৈতিক ও সামাজিক বিধি বলে উল্লেখ করা হয় কেন?
ভারতীয় নীতিশাস্ত্রে ধর্মকে সামাজিক ও নৈতিক বিধি হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ধর্ম একদিকে নৈতিক বিধি, কেন-না মানুষের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে; অন্যদিকে আবার ধর্ম ব্যক্তিমানুষকে সমাজ কল্যাণে উদ্বুদ্ধ করে। ধর্মের দ্বারা ব্যক্তির শুধু বাহ্যিক আচরণ নয়, আত্মিক আচরণকেও বোঝায়। ভারতীয় নীতিশাস্ত্রে ধর্মকে ‘কর্তব্য’ হিসেবে বোঝানো হয়েছে। মানুষ নৈতিক কর্তারূপে কর্তব্য পালন করে। সমাজে তার আশ্রম বা বর্ণ অনুযায়ী কর্তব্য নির্ধারণ হয়।
ভারতীয় নীতিশাস্ত্রে চারটি আশ্রমধর্ম ও চারটি বর্ণধর্মের উল্লেখ রয়েছে। চারটি আশ্রম ধর্ম হল- ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বাণপ্রস্থ ও সন্ন্যাস এবং চারটি বর্ণধর্ম হল- ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। আশ্রমধর্ম হল মানুষের জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ক্রম এবং বর্ণধর্ম এর অন্তর্গত। ‘বর্ণ’ কথাটির দ্বারা মানুষের মানসিক প্রবণতাকে বোঝানো হয়। ভারতীয় নীতিশাস্ত্রে শাস্ত্রবিহিত কর্তব্যকর্ম হল ধর্ম। আর এই শাস্ত্রবিহিত ধর্মীয় আচরণ হল নৈতিক কর্তব্যবিধি। ধর্ম আসলে এক নিয়মশৃঙ্খলা যা মানুষের মধ্যে শুভ চেতনার আবির্ভাব ঘটায়।
নীতিশাস্ত্র অনুযায়ী ধর্ম কয় প্রকার এবং সেগুলি সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
ধর্মের প্রকার
ভারতীয় নীতিশাস্ত্রে মোট তিন প্রকার ধর্মের উল্লেখ করা হয়েছে। সেগুলি হল- প্রবৃত্তিমূলক ধর্ম, নিবৃত্তিমূলক ধর্ম ও প্রবৃত্তি-নিবৃত্তিমূলক ধর্ম। নিম্নে তিন প্রকার ধর্ম নিয়ে আলোচনা করা হল-
প্রবৃত্তিমূলক ধর্ম
প্রবৃত্তিমূলক ধর্মের মূল উদ্দেশ্য হল চিত্তবৃত্তিকে পরিতৃপ্তি করা। চার্বাক দর্শনে এই ধর্ম সমর্থিত হয়েছে। চার্বাকদের মতানুযায়ী সুখ ক্ষণিক তাই সুখ-দুঃখ মিশ্রিত জীবনে ক্ষণিকের সুখকে উপেক্ষা করা ঠিক নয়। তাই বুদ্ধিমান মানুষের উচিত মৃত্যুকে ভয় না করে জীবনকে উপভোগ করা।
নিবৃত্তিমূলক ধর্ম
নিবৃত্তিমূলক ধর্মের ক্ষেত্রে চিত্তবৃত্তি নিরোধের কথা বলা হয়। অর্থাৎ নিবৃত্তিমূলক ধর্ম হল প্রবৃত্তিমূলক ধর্মের বিপরীত ধর্ম। যোগ দর্শনে মহর্ষি পতঞ্জলি চিত্তবৃত্তি নিরোধকে যোগ বলেছেন, যা অষ্টাঙ্গ যোগের মাধ্যমে লাভ করা সম্ভব।
প্রবৃত্তি-নিবৃত্তিমূলক ধর্ম
প্রবৃত্তি-নিবৃত্তিমূলক ধর্মের ক্ষেত্রে সৎ প্রবৃত্তিগুলিকে পরিতৃপ্ত এবং অসৎ প্রবৃত্তিগুলিকে বর্জনের কথা বলা হয়। তবে প্রবৃত্তিমূলক ও প্রবৃত্তি-নিবৃত্তিমূলক ধর্মের ক্ষেত্রে ভোগবাসনা থাকায় এই দুটি স্তরে মুক্তিলাভ সম্ভব নয়। শুধুমাত্র নিবৃত্তিমূলক ধর্ম পালনের দ্বারাই মোক্ষলাভ সম্ভব হয়।
সাধারণ ধর্ম কাকে বলে? সাধারণ ধর্ম কী কী?
সাধারণ ধর্ম
বর্ণ ও আশ্রম নির্বিশেষে যে-কোনো মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কর্তব্যকে সাধারণ ধর্ম বলা হয়। সাধারণ ধর্ম প্রতিটি মানুষের পালনীয় ধর্ম। প্রধানত সাধারণ ধর্ম বলতে পাঁচটি ধর্মকে বোঝানো হয়। সেগুলি হল- অহিংসা, সত্য, অস্তেয়, শৌচ ও সংযম। এ ছাড়াও মনু, প্রশস্তপাদ, যাজ্ঞবল্ক্য বিভিন্ন সাধারণ ধর্মের উল্লেখ করেন।
দশটি সাধারণ ধর্ম
মনু দশটি সাধারণ ধর্মের কথা বলেন। সেগুলি হল- ক্ষমা (অপরাধ মার্জনা), ধৃতি (নিজের প্রতি অবিচল নিষ্ঠা), অন্তেয় (অন্যের দ্রব্যের প্রতি লোভ না করা), ধী (বিচারশক্তি), বিদ্যা (তথ্যমূলক জ্ঞান), দম (সহনশীলতা), শৌচ (পরিচ্ছন্নতা), অক্রোধ (ক্রোধশূন্যতা), সত্য (সততা), ইন্দ্রিয়নিগ্রহ (ইন্দ্রিয় সংযম বা ইন্দ্রিয়কে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখা)। মনুসংহিতায় এই সাধারণ ধর্মগুলি মানুষের পালনীয় কর্তব্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই কর্তব্যগুলি পালন করলে ব্যক্তিমানুষের উন্নতি ও আত্মশুদ্ধি ঘটে।
বর্ণাশ্রম ধর্ম বলতে কী বোঝো?
বর্ণধর্ম ও আশ্রমধর্মের মিলিত রূপই হল বর্ণাশ্রম ধর্ম। ‘বর্ণ’ হল মানুষের মানসিক প্রবণতা এবং ‘আশ্রম’ হল অবস্থা অনুযায়ী মানুষের পালনীয় কর্তব্য। প্রতিটি মানুষের চরিত্রের মধ্যে সত্ত্ব, রজো ও তমোগুণের প্রাধান্য থাকে। তবে গুণগুলি সকলের মধ্যে সমানভাবে থাকে না। এই তিন গুণের তারতম্যের ভিত্তিতে ব্যক্তিমানুষের বর্ণভেদ করা হয়েছে। বর্ণভেদের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাচীন সমাজে চতুর্বর্ণের প্রাধান্য দেখতে পাওয়া যায়। যথা- ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র।
এ ছাড়া বৈদিক মতে, প্রতিটি মানুষের জীবনে চারটি পর্যায় থাকে। জীবনের এই পর্যায়গুলি হল ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বাণপ্রস্থ ও সন্ন্যাস। জীবনের প্রতিটি পর্যায়ের পালনীয় কর্তব্যসমূহ হল আশ্রমধর্ম। প্রতিটি আশ্রমের ধর্ম ও কর্তব্য ভিন্ন ভিন্ন হলেও একটির সঙ্গে অন্যটির এক নিবিড় যোগসূত্র রয়েছে।
বর্ণবিভাগের উৎপত্তির ধারণাটিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে? অথবা, ঋগ্বেদ অনুযায়ী বর্ণের উৎপত্তি কীভাবে হয়?
বর্ণধর্ম হল মানুষের বিভিন্ন সামাজিক অবস্থানগত ধর্মের মধ্যে একটি। মানবজাতিকে যে বিভিন্ন বর্ণে বিভক্ত করা হয়েছে তাদের বিশেষ ধর্মকেই ‘বর্ণধর্ম’ বলে। বর্ণের বিভাগ জন্মের দ্বারাই নির্ধারিত হয়।
বর্ণের চতুর্বিধ বিভাগ ঈশ্বরের দ্বারাই সৃষ্ট হয়েছে। ঋগ্বেদের ‘পুরুষসূক্তে’ বলা হয়েছে যে সৃষ্টিকর্তা বিরাট পুরুষের মুখমণ্ডল থেকে ব্রাহ্মণের উদ্ভব হয়েছিল। ক্ষত্রিয়ের উদ্ভব হয়েছিল বাহুদ্বয় থেকে। বৈশ্যের উদ্ভব উরুদেশ থেকে এবং শূদ্রের উদ্ভব হয়েছিল পদদ্বয় থেকে। আমাদের দেহে প্রতিটি অঙ্গের যেমন গুরুত্ব আছে তেমনি সমাজে প্রতিটি বর্ণের সামাজিক প্রয়োজন আছে। সেক্ষেত্রে কোনো বর্ণকেই অধিক গুরুত্বপূর্ণ বা কম গুরুত্বপূর্ণ বলা যায়না।
বর্ণধর্ম বলতে কী বোঝো?
মানুষের বিভিন্ন সামাজিক অবস্থানগত ধর্মের মধ্যে একটির নাম বর্ণধর্ম। সমাজে শ্রমবিভাজন বর্ণব্যবস্থার ফল। মানুষের এই মানসিক প্রবণতা তার একটি স্থায়ী বৈশিষ্ট্য। এই প্রবণতার উপর ব্যক্তির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নির্ভর করে। পৃথিবীর অন্যান্য সকল পদার্থের মতো মানুষও সত্ত্ব, রজো ও তমো গুণের সমন্বয়ে সৃষ্ট। সকল মানুষের মধ্যেই তিনটি গুণ আছে কিন্তু ত্রিগুণ সম্যাবস্থায় থাকে না। এই তিনটি গুণ ও কর্মের বিভাগ অনুসারে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র- এই চতুর্বর্ণের সৃষ্টি হয়েছে।
এই চারটি বর্ণের পালনীয় কর্তব্যগুলি হল- কর্ম – যজ্ঞানুষ্ঠান, দান গ্রহণ ও অধ্যাপনা। ব্রাহ্মণের পালনীয় ক্ষত্রিয়ের পালনীয় কর্ম অসাধু নিগ্রহ, প্রজাপালন ও যুদ্ধ। বৈশ্যের পালনীয় কর্ম কৃষিকাজ, বাণিজ্য, পশুপালন। শূদ্রের পালনীয় কর্ম – অন্য বর্ণভুক্ত মানুষের সেবা ও পরিচর্যা ইত্যাদি।
টীকা লেখো: ব্রহ্মচর্য আশ্রম।
ব্রহ্মচর্যকে মানুষের গুরুগৃহে থেকে শিক্ষালাভের অধ্যায় বলা হয়েছে। মানুষের সমগ্র জীবনের ভিত্তি রচনা করে ব্রহ্মচর্য। এই পর্যায় মূলত – গুরুগৃহে অবস্থান করে শিক্ষালাভের পর্যায়। আত্মসংযম ও ইন্দ্রিয় সংযমের মাধ্যমে এই পর্যায়ে শিক্ষার্থীর চরিত্র গঠিত হয়। এই পর্যায়ে গুরুর শুশ্রুষা, খাদ্য প্রস্তুতি, কাঠ সংগ্রহ, হোমাগ্নির আয়োজন অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। গুরুকে সেবার মাধ্যমে সন্তুষ্ট করে গুরুর থেকে সকল প্রকার বিদ্যা অর্জনের চেষ্টা করা হত।
আর-এক অর্থে বলা যায় যিনি সমস্ত কর্মের মধ্যে থেকেও ব্রহ্ম ভাবনায় লীন থাকেন তিনিই ব্রহ্মচারী। (“ব্রহ্মনি চরতি ইতি ব্রহ্মচারী।”) প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্মচর্য আশ্রম একজন শিক্ষার্থীর চরিত্র গঠনের আশ্রম। মানুষের আধ্যাত্মিক জীবনে উত্তরণের প্রথম পর্যায় বা স্তর হিসেবে ব্রহ্মচর্যের স্থান রয়েছে বৈদিক শাস্ত্রে।
টীকা লেখো: গার্হস্থ্য আশ্রম।
ব্রহ্মচর্য আশ্রম সমাপ্ত হলে একজন মানুষকে ব্যাবহারিক কর্তব্য পালনের জন্য গার্হস্থ্য জীবনে প্রবেশ করতে হয়। এই পর্যায়ে মানুষ সাংসারিক দায়দায়িত্ব বহন করে এবং বংশধারাকে অব্যাহত রেখে মানবজাতির প্রবাহকে অক্ষুণ্ণ রাখে। গার্হস্থ্য পর্যায় বলতে এখানে বিবাহিত তথা সংসার জীবনে প্রবেশ করাকে বোঝানো হয়েছে। বংশবৃদ্ধি ছাড়াও পিতামাতার সেবা, সংসার প্রতিপালন, অতিথি সেবা, দেব সেবা-এই আশ্রমে অবশ্য করণীয়। দেবতারা মানুষের ভাগ্যনিয়ন্তা, পিতৃপুরুষ তার জন্মদাতা, ঋষিগণ তাকে বিদ্যাদান করেছে, আবার যেকোনো প্রাণী ও প্রকৃতির প্রতিও মানুষ ঋণী। গার্হস্থ্য আশ্রমে মানুষকে বেশ কিছু ঋণ পরিশোধ করতে হয়। যেমন- দেবঋণ, পিতৃঋণ, ঋষিঋণ, প্রকৃতিঋণ প্রভৃতি। গার্হস্থ্য আশ্রমে ব্রহ্মযজ্ঞ, নৃযজ্ঞ বা মনুষ্যযজ্ঞ, দেবযজ্ঞ, পিতৃযজ্ঞ, ভূতযজ্ঞ প্রভৃতি পালনীয় কর্তব্য।
পঞ্চযজ্ঞ কাকে বলে এবং প্রতিটি যজ্ঞের সম্বন্ধে লেখো।
পঞ্চযজ্ঞ
প্রতিটি মানুষ প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। তাই মানুষ কোনো-না-কোনোভাবে প্রকৃতির কাছে ঋণী। মানুষকে গার্হস্থ্য আশ্রমে তার যে মৌলিক ঋণগুলিকে নানা যজ্ঞের মাধ্যমে পরিশোধ করার কথা বলা হয়, সেগুলি হল- ব্রহ্মযজ্ঞ, পিতৃযজ্ঞ, দেবযজ্ঞ, ভূতযজ্ঞ, নৃযজ্ঞ বা মনুষ্যযজ্ঞ। এই পাঁচটি যজ্ঞকে একত্রে ‘পঞ্চযজ্ঞ’ বলা হয়।
ব্রহ্মযজ্ঞ
পঞ্চ মহাযজ্ঞের মধ্যে ব্রহ্মযজ্ঞ হল শ্রেষ্ঠ মহাযজ্ঞ। গার্হস্থ্য আশ্রমে প্রবেশ করে নিয়মিত বেদ ও পুরাণ প্রভৃতি পাঠ করা এবং প্রাপ্ত জ্ঞান সাধ্যমতো অন্যকে দান করা হল ব্রহ্মযজ্ঞ।
পিতৃযজ্ঞ
পরলোকগত পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠিত তর্পণের নাম পিতৃযজ্ঞ। প্রত্যেক মানুষই তার পিতৃপুরুষের কাছে নানাভাবে ঋণী। সেই ঋণ পরিশোধ করা আমাদের দায়িত্ব। প্রয়াত পিতৃপুরুষের কাছে শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের জন্য শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করা অবশ্যই দরকার। এর মাধ্যমে পূর্বপুরুষদের প্রতি কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপন ও তাদের স্মরণ হয়।
দেবযজ্ঞ
নিসর্গ দেবতাদের কাছে আমাদের ঋণ অশেষ এবং এই ঋণ পরিশোধ করার জন্য আমাদের দেবযজ্ঞের প্রয়োজন। দেবতাদের উদ্দেশ্যে হোম বা যজ্ঞ করাই হল দেবযজ্ঞ।
ভূতযজ্ঞ
ভূতযজ্ঞ বলতে বোঝায় আমাদের চারপাশের দৃষ্ট-অদৃষ্ট, ক্ষুদ্র-বৃহৎ, সূক্ষ্ম-স্থল সবরকম জীব ও উদ্ভিদের পরিচর্যা করা।
নৃযজ্ঞ
মানুষ সমগ্র মানবজাতির কাছে ঋণী। সেই কারণে মানুষের উচিত সমগ্র মানবজাতির ঋণ পরিশোধ করা। একে বলে নৃযজ্ঞ বা – মনুষ্যযজ্ঞ। যেমন- আশ্রয়হীনকে আশ্রয়দান, ক্ষুধার্তকে অন্নদান প্রভৃতি।
বাণপ্রস্থ আশ্রমে পালনীয় কর্ম কী?
গার্হস্থ্য আশ্রমে নানা কর্তব্য পালন ও ভোগের পর মোক্ষলাভের প্রয়োজনে মানুষ বাণপ্রস্থ আশ্রমে প্রবেশ করে। এই আশ্রমের প্রধান উদ্দেশ্য আত্মশুদ্ধি বা চিত্তশুদ্ধি। এর মাধ্যমে মানুষ পরবর্তী আশ্রম অর্থাৎ সন্ন্যাস জীবনের জন্য প্রস্তুত হয়। বাণপ্রস্থ আশ্রমে মানুষ সংসার জীবনের যাবতীয় সুখস্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দেয় এবং ইষ্ট সাধনার উপযোগী কর্তব্য পালন করে। যেমন- গাছের ছাল পরা, ফলমূল ভোজন, জটা চুল ধারণ, অতিথির খাওয়ার পর অবশিষ্টাংশ ভোজন ইত্যাদি। এই সকল কর্তব্য পালন এবং কৃষ্ণসাধন, অহিংসা, করুণা ইত্যাদি গুণের অধিকারী হলে মানুষ সন্ন্যাস জীবনের উপযোগী হয়। বাণপ্রস্থ আশ্রমধর্মকে স্বেচ্ছা নির্বাসনের অধ্যায় হিসেবে অভিহিত করা যায়।
সন্ন্যাস আশ্রমে পালনীয় কর্ম কী?
উত্তর বাণপ্রস্থ আশ্রমের শেষে মোক্ষলাভের প্রয়োজনে মানুষ সন্ন্যাস আশ্রমে প্রবেশ করে। সন্ন্যাসের মধ্যে দিয়ে বাণপ্রস্থ পূর্ণতা লাভ করে। এই আশ্রমকালে ব্যক্তি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সকল বিষয় থেকে নিজেকে বিযুক্ত করে নিরবচ্ছিন্ন ধ্যানের মাধ্যমে নিরাসক্তভাবে জ্ঞানের অনুশীলন করেন। যে ব্যক্তি সন্ন্যাস গ্রহণ করেন তাকে সন্ন্যাসী বলে। সন্ন্যাসীরা কোনো নির্দিষ্ট স্থানে বা গৃহে অবস্থান করে না। এই পর্যায়ে মানুষ সাধনার মাধ্যমে নিজের চিত্তশুদ্ধি করে নিজেকে ঈশ্বর অভিমুখী করে তোলে। এই সময় ব্যক্তির তত্ত্বজ্ঞান বা আত্মজ্ঞানের উদয় হয়। এই অবস্থায় ব্যক্তি নির্মোহ, নির্লোভ ও নিরাসক্ত হয়ে নিষ্কাম কর্ম সম্পাদনের দ্বারা পরম পুরুষার্থ মোক্ষকে লাভ করতে পারে। অর্থাৎ সন্ন্যাস হল ত্যাগ বৈরাগ্যের পথ।
স্বধর্ম বা বিশেষধর্ম ও পরধর্ম সম্বন্ধে লেখো।
স্বধর্ম বা বিশেষ ধর্ম
স্বধর্ম বা বিশেষ ধর্ম সর্বজনীন কর্তব্য নয়। মানুষের সামাজিক অবস্থান (বর্ণ) এবং জীবনের নানা পর্যায় ভেদে (আশ্রম) বিশেষ ধর্ম নির্ধারিত হয়েছে। বিশেষ ধর্ম দুই প্রকার। বর্ণ ধর্ম ও আশ্রম ধর্ম। যেমন- ব্রাহ্মণের কাজ পূজার্চনায় নিজেকে নিযুক্ত করা, ক্ষত্রিয়ের কাজ যুদ্ধ বিগ্রহ করা, বৈশ্য মূলত ব্যবসায়ী সম্প্রদায় এবং শূদ্রের কাজ উপরের তিনটি শ্রেণির অনুগত্য মেনে চলা। প্রত্যেক বর্ণের কর্মগুলি সঠিকভাবে পালন করাই হল স্বধর্ম। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে ক্ষত্রিয়ধর্ম অনুযায়ী যুদ্ধে নিযুক্ত থাকার পরামর্শ দিয়ে স্বধর্ম পালন করতে বলেছেন।
পরধর্ম
স্বধর্মের বিপরীত ধর্ম হল পরধর্ম। বর্ণাশ্রম অনুযায়ী ব্যক্তিমানুষ নিজ নিজ ধর্ম বা কর্তব্য পালন না করে যদি অন্য বর্ণের জন্য নির্ধারিত কর্ম করে তবে ব্যক্তিটির দ্বারা কৃতকর্ম বা কর্তব্যকর্ম হল পরধর্ম। গীতায় শ্রীকৃয় বলেছেন যে, স্বধর্মের তুলনায় পরধর্ম আকর্ষণীয় মনে হলেও পরধর্ম পালন অনুচিত (পরধর্মো ভয়াবহঃ)।
পুরুষার্থ অনুসারে অর্থ বলতে কী বোঝায়?
পুরুষার্থ প্রসঙ্গে ‘অর্থ’ বলতে জীবিকা অর্জনের উপায়কে বোঝানো হয়েছে। যদিও বর্তমান প্রেক্ষাপটে অর্থ বলতে সাধারণত বস্তুগত সমৃদ্ধিকে বোঝায়। এটি অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্তরে আমাদের প্রয়োজনীয়তা পূরণ করে। আমাদের নিজস্ব ব্যক্তিগত চাহিদা পূরণের সঙ্গে অন্যকে সাহায্য করার জন্য বস্তুগত সমৃদ্ধি একান্ত প্রয়োজন।
অর্থ লাভের উপায়ের কথা বলতে গিয়ে মহাভারতে বলা হয়েছে যে উত্থানশক্তির সাহায্যেই অর্থ লাভ হয়। ‘উত্থান’ শব্দের অর্থ প্রচেষ্টা। মানুষের শারীরিক দক্ষতাকেই ‘উত্থান’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কৃষিকাজ, বাণিজ্য, গোরক্ষা এবং শিল্পে মানুষের এই দক্ষতার বিকাশ ঘটে, যার ফলে অর্থ অর্জিত হয়। কিন্তু অর্জিত অর্থ সৎপথে অর্থাৎ ধর্ম মেনে উপার্জন করতে হবে, তবেই উপার্জিত অর্থকে বৈধ অর্থ বলা যাবে। আর একমাত্র বৈধ অর্থই পুরুষার্থরূপে গণ্য হয়। অসৎ উপায়ে অর্জিত অর্থ মোক্ষের সহায়ক হয় না।
অর্থের বৈধতা জানার উপায় কী?
চতুর্বিধ পুরুষার্থের মধ্যে অর্থ জীবনযাপনে অন্যতম ভূমিকা পালন করে। অর্থ বলতে এমন কোনো সম্পদকে বোঝানো হয়নি যা চৌর্যবৃত্তি বা অসৎ উপায়ে সংগৃহীত। একমাত্র সেই অর্থই পুরুষার্থ হিসেবে গণ্য করা হয় যা ন্যায়পথে বা ধর্ম মেনে অর্জিত হয়। অর্থের বৈধতা তখনই স্বীকৃত হয় যদি তা সৎ উপায়ে, অন্যের ক্ষতি না করে সংগৃহীত হয়।
শাস্ত্রে সেই অর্থকেই পুরুষার্থ হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে যা সদবস্তু লাভ ও মিতব্যয়ের দ্বারা জীবনযাপনকে স্বীকৃতি দেয়। দৈনন্দিন জীবনে যতটা অর্থ প্রয়োজন ততটাই সঞ্চয় করা উচিত, তার অধিক নয়। ব্যক্তি যদি নিজ প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থকে সঞ্চয় করে তাহলে সেই ব্যক্তি অপরাধী হিসেবে পরিগণিত হয়।
অর্থকে পরতমূল্যবান বলা হয় কেন? অতিরিক্ত অর্থ কেন কাম্য নয়?
অর্থ হল পরতমূল্যবান
অর্থ ইষ্ট সাধনের উপায়। সেইকারণে ব্যাবহারিক প্রয়োজন ব্যতিরেকে অর্থের আর কোনো দরকার নেই। অর্থাৎ শুধুমাত্র অর্থের জন্য অর্থকে কামনা করা যায় না। তাই অর্থকে পরতমূল্যবান বলা হয়। তবে ব্যক্তিমানুষকে এমনভাবে অর্থ উপার্জন করতে হবে, যা অন্যের ক্ষতিসাধন না করে। অসৎ উপায়ে অর্থ উপার্জন করা কোনোভাবেই নীতিসম্মত কাজ নয়।
অর্থ কাম্য বস্তু নয়
অর্থের প্রতি অতিরিক্ত আকাঙ্ক্ষা বা আসক্তি থাকলে তা ক্রমাগত বেড়েই চলে। তাই অতিরিক্ত অর্থ্য কাম্য নয়। অর্থ হল বস্তু সম্পদের সাধনা যা ব্যক্তিকে বস্তুগত আরাম প্রদান করে। মানুষের জীবনের নানা কামনা-বাসনাকে পূরণ করার জন্য, সামাজিক কর্তব্য পালনের জন্য এবং ধর্মাচরণের জন্যও অর্থের প্রয়োজন হয়। মানুষ সৎভাবে যে অর্থটুকু উপার্জন করবে সেই অর্থ দিয়েই জীবনের চাহিদা পূরণ করা উচিত। অতিরিক্ত অর্থ ব্যক্তি মানুষের কাছে থাকলে তাদের চাহিদার প্রতি আসক্তি বা আকাঙ্ক্ষা ক্রমাগত বেড়ে চলে, যা মানুষকে অসৎ উপায়ের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
পুরুষার্থ অনুসারে ‘কাম’ বলতে কী বোঝো?
পুরুষার্থ প্রাপ্তি হল মানব জীবনের লক্ষ্য অর্জন। তৃতীয় পুরুষার্থ হল কাম, যার অর্থ হল সুখ বা আনন্দ। ‘কাম’ শব্দটির সাধারণ অর্থ কামনা, প্রেম, ইন্দ্রিয়সুখ, লোভ প্রভৃতি। কাম হল মূলত পার্থিব বাসনাপূরণ। মানুষ হিসেবে সম্পদ, ক্ষমতা, যৌন চাহিদা, প্রাপ্তি এবং সেবা-সহ আমাদের বহু আকাঙ্ক্ষা থাকতেই পারে। ‘কাম’ এমন এক পুরুষার্থ যা জীবদ্দশায় ব্যক্তি পূরণ করতে চায়, নিজের ইচ্ছার মূল্য দিতে চায়। তবে তা যেন অপরের ক্ষতি বা দুখের কারণ না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। উপনিষদে বলা হয়েছে যে, কাম মানুষকে কর্মে প্রবৃত্ত করে। কাম থেকে আসে কর্ম-সংকল্প এবং তারপর আসে কর্মপ্রযত্ন। কাম যদি সুনিয়ন্ত্রিত শৃঙ্খলের মাধ্যমে মানুষের আকাঙ্ক্ষিত বস্তুলাভে সাহায্য করে, তবে সেই কাম-ই হবে পুরুষার্থ।
ভারতীয় দর্শনে মোক্ষ বলতে কী বোঝানো হয়েছে?
ভারতীয় দর্শনে মোক্ষ বিষয়ে মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। চার্বাক মতে দেহের বিনাশই মোক্ষ। বৌদ্ধ মতে বিজ্ঞান ধারার নিরোধই নির্বাণ বা মোক্ষ। জৈন মতে কর্মপুদ্গলের বন্ধন মোচন হল মোক্ষ। ন্যায়-বৈশেষিক মতে দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি হল মোক্ষ। সাংখ্য মতে ত্রিবিধ দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি হল কৈবল্য বা মোক্ষ। যোগ দর্শন মতে অষ্টাঙ্গ যোগের মাধ্যমে পুরুষের শুদ্ধি হল কৈবল্য বা মোক্ষ। মীমাংসা মতে দুঃখের আত্যন্তিক প্রাগভাব হল মোক্ষ। অদ্বৈতবেদান্ত মতে সর্বদুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি এবং পরমানন্দাত্মক ব্রহ্মস্বরূপ প্রাপ্তি হল মোক্ষ। বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী রামানুজের মতে ব্রহ্মসাযুজ্যই হল মোক্ষ। সুতরাং ভারতীয় দর্শনে মোক্ষ বলতে বোঝায় বন্ধন থেকে নিষ্কৃতি। চার্বাক দর্শন ব্যতীত অন্যান্য দার্শনিক সম্প্রদায় এই মোক্ষকে পরম পুরুষার্থরূপে স্বীকার করেছেন।
মানুষের কাছে মোক্ষ চরম ও পরম পুরুষার্থ কেন?
ভারতীয় দর্শনে মোক্ষের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আস্তিক দর্শনের প্রারম্ভেই প্রস্তাব থাকে যে মোক্ষলাভই তাদের দর্শনের মুখ্য উদ্দেশ্য। মোক্ষ শব্দটির বুৎপত্তিগত অর্থ হল মুক্তি। সাধারণ মানুষের কাছে মুক্তির স্বাদ অনস্বীকার্য। মোক্ষ একমাত্র পুরুষার্থ যা নিজস্ব মূল্যে মূল্যবান। তাই মোক্ষকে চরম পুরুষার্থ বলা হয়েছে এবং ‘পরম’ শব্দের অর্থ ‘নিরতিশয়’ অর্থাৎ যার অধিক সুখ হয় না এবং যার কখনও ক্ষয় হয় না। এই কারণে মোক্ষ সর্বোত্তম ও অক্ষয় হওয়ায় মোক্ষকে পরম পুরুষার্থ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
পুরুষার্থ কথার আক্ষরিক অর্থ হল কোনো বিষয়কে পুরুষের কামনা। মানুষ স্বাভাবিক ভাবেই দুঃখের হাত থেকে মুক্তি চায় এবং মোক্ষের মূল ধারণাটিই হল দুঃখের হাত থেকে মুক্তি। সেই কারণে মানুষের কাছে মোক্ষ চরম ও পরম পুরুষার্থ।
মোক্ষ বা মুক্তি কয় প্রকার ও কী কী? সংক্ষেপে আলোচনা করো।
ভারতীয় নীতিবদ্যিায় দুই প্রকার মোক্ষ বা মুক্তি স্বীকার করা হয়েছে। যথা- জীবন্মুক্তি ও বিদেহ মুক্তি। জীবিত অবস্থায় মুমুক্ষু ব্যক্তির যে মুক্তি তাকে বলে জীবন্মুক্তি। জীবন্মুক্ত অবস্থায় মুক্তিকামী ব্যক্তি সুখ-দুঃখ সমুদয়ের ঊর্ধে হলেও প্রারব্ধ কর্মফল ভোগের জন্য তাকে দেহধারণ করে থাকতে হয়। বৌদ্ধ মতে নির্বাণ হল জীবন্মুক্তি, যা বুদ্ধদেব লাভ করেছিলেন।
অপরপক্ষে প্রারব্ধ কর্মফল ভোগ শেষ হলে দেহের বিনাশ ঘটে। অর্থাৎ শরীর থেকে আত্মার বিযুক্তি ঘটে। আর শরীর থেকে আত্মার এরূপ বিযুক্তিই বিদেহ মুক্তি। মুমুক্ষুর বিদেহ মুক্তি হলে আর পুনর্জন্ম হয় না। বৌদ্ধ, জৈন, সাংখ্য, যোগ, মীমাংসক ও অদ্বৈতবেদান্তীগণ জীবন্মুক্তি স্বীকার করেন। আর ন্যায়-বৈশেষিক, সাংখ্য, যোগ, নবমীমাংসক, অদ্বৈতবেদান্ত ও বিশিষ্টাদ্বৈত বিদেহ মুক্তি স্বীকার করেন।
ভারতীয় নীতিবিদ্যায় একমাত্র মোক্ষ পুরুষার্থ স্বীকার করলে কী অসুবিধা হত?
ভারতীয় নীতিবিদ্যায় যে চতুর্বিধ পুরুষার্থ স্বীকার করা হয়েছে, সেগুলির মধ্যে প্রথম তিনটি (ধর্ম, অর্থ ও কাম) হল উপায় বা সাধন এবং মোক্ষ হল উপেয়। উপায় ব্যতীত উপেয় সম্ভব নয়। যেমন- ধর্ম ‘মোক্ষ’ বা ‘মুক্তি’ লাভে সহায়ক। আর অর্থ ও কাম ধর্মপথে পরিচালিত হয় বলে সেগুলিও পুরুষার্থ বলে গণ্য। অসদুপায়ে অর্জিতার্থ ও অসংযতভাবে ইন্দ্রিয় পরিতৃপ্তি রূপ কাম পুরুষার্থ নয়। ধর্মই এদের নিয়ন্ত্রক। ধর্ম মোক্ষলাভের সহায়ক হওয়ায় পুরুষার্থের পরিকল্পনায় ধর্ম প্রধান ও মূল ভিত্তিরূপে স্থান পেয়েছে। ধর্ম মানুষের শ্রেষ্ঠ সহচর। তবে ভারতীয় দর্শনে লক্ষ করলে দেখা যায় চার্বাকরা কেবল দুটি পুরুষার্থ অর্থাৎ কাম ও অর্থ স্বীকার করেছেন।
প্রাচীন মীমাংসকরা ত্রিবর্গ পুরুষার্থ স্বীকার করেছিলেন অর্থাৎ তারা ধর্ম, অর্থ ও কামকে পুরুষার্থ হিসেবে স্বীকার করেছিলেন। কিন্তু অন্যান্য দার্শনিক সম্প্রদায় চারটি পুরুষার্থ স্বীকার করেছেন। সুতরাং উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় ভারতীয় নীতিবিদ্যায় এমন কেউ নেই যারা ত্রিবর্গ পুরুষার্থ ব্যতীত কেবল মোক্ষকে পুরুষার্থরূপে স্বীকার করেছেন। বরং বৈল্পবরা চতুর্বর্গের অতিরিক্ত পঞ্চম পুরুষার্থরূপে ‘প্রেম’ স্বীকার করেছেন।
ত্রিবর্গের ধারণা থেকে মোস্কের ধারণা পৃথক কেন?
অথবা, মোক্ষ ত্রিবর্গ পুরুষার্থের অন্তর্গত নয় কেন?
ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ এই চতুর্বিধ পুরুষার্থের মধ্যে ধর্ম, অর্থ ও কাম এই ত্রিবর্গকে পৃথক করা হয়েছে মোক্ষ থেকে। ত্রিবর্গ পুরুষার্থ মানুষের কামনাকে তৃপ্ত করে। কিন্তু মোক্ষ পুরুষার্থের দ্বারা কোনো বাসনার পরিতৃপ্তি হয় না, কারণ বাসনার উচ্ছেদই হল মোক্ষ।
ত্রিবর্গ একে অপরের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। এদের কোনো স্বতঃমূল্য নেই, এগুলি পরতমূল্যবান। অর্থ ও কাম ধর্মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। অপরপক্ষে মোক্ষ হল আধ্যাত্মিক আদর্শ। মোক্ষ হল এমন এক পর্যায় যেখানে মানুষ জগৎ থেকে বিযুক্ত হয় না, কেবল জগতের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটে। মোক্ষ মানেই জীবন থেকে মুক্তি পাওয়া বা পরিত্রাণ নয় বরং মোক্ষ জীবনে এমন এক পর্যায়ের সূত্রপাত করে যা নিরাসক্ত ও নির্মোহ।
এই কারণে মোক্ষ ত্রিবর্গের ধারণা থেকে পৃথক।
মোক্ষ অন্যান্য পুরুষার্থ থেকে গুণগতভাবে কীভাবে পৃথক?
মোক্ষ লাভের মধ্যেই ধর্ম, অর্থ ও কাম পরিপূর্ণতা ও সার্থকতা লাভ করে। একমাত্র মোক্ষই এমন একটি পুরুষার্থ যা নিজস্ব মূল্যে মূল্যবান। চার্বাক ও প্রাচীন মীমাংসা ব্যতিরেকে, আর সকলেই (ভারতীয় দার্শনিক সম্প্রদায়) বলেছেন যে মোক্ষ প্রাপ্তিতে দুঃখের উচ্ছেদ ঘটে। সংসারে দুঃখ রক্তবীজের মতো। একটি দুঃখ ধ্বংস হলে অন্য একটি দুঃখ প্রকটিত হয়। কিন্তু মোক্ষ প্রাপ্তিতেই দুঃখের আত্যন্তিক বিনাশ ঘটে।
মোক্ষ অতীত ও ভবিষ্যতের দুঃখ ও দুঃখের সম্ভাবনাকে বিনষ্ট করে। সকল পুরুষার্থেই দুঃখের বিনাশ ঘটে থাকে। কিন্তু ‘মোক্ষ’ অন্যান্য পুরুষার্থগুলির থেকে গুণগতভাবে উচ্চস্তরে অবস্থান করে। এইকারণেই মোক্ষ পৃথক। মোক্ষ প্রাপ্তিতে দুঃখ সম্পূর্ণরূপে বিনাশ হওয়ার পর আর দুঃখ জন্মায় না। সেই কারণে আর পুনরায় দুঃখভোগের অবকাশ থাকে না।
মোক্ষ অর্জনের উপায় কী?
মোক্ষ অর্জনের জন্য ব্যক্তিকে অবশ্যই সকল বস্তুগত আকাঙ্ক্ষা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে হবে এবং আত্মায় গভীর জ্ঞানের বিকাশ করতে হবে। মোক্ষ হল জীবন, মৃত্যু এবং পুনর্জন্মের চক্র থেকে অমর আত্মার মুক্তি। মানুষ প্রথম তিনটি পুরুষার্থ তথা লক্ষ্যের (ধর্ম, অর্থ ও কাম) মধ্য দিয়ে অগ্রসর হওয়ার সাথে সাথে তারা জাগতিক সম্পদ এবং আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সংযুক্তি ছেড়ে দেয়, যা ব্যক্তিকে মোক্ষ অর্জনের লক্ষ্যের দিকে পরিচালিত করে। মোক্ষ যখন অর্জিত হয় তখন আত্মা পরম সত্তার সঙ্গে একত্রিত হয় এবং আত্মা চিরন্তন আনন্দময় অবস্থায় প্রবেশ করে। ফলে আত্মা ঐশ্বরিক উপলব্ধি অর্জন করে।
মোক্ষলাভের জন্য কয়টি মার্গ স্বীকার করা হয়েছে? সংক্ষেপে লেখো।
মোক্ষলাভের মার্গ
মোক্ষই একমাত্র নিত্য সুখস্বরূপ। তাই ভারতীয় নীতিশাস্ত্রে মোক্ষকেই পরম পুরুষার্থ বলা হয়। মানুষের জীবন দুঃখময়। এই দুঃখময় জীবনের মূলে রয়েছে অবিদ্যা। অবিদ্যার জন্ম হয় আত্মার বন্ধনের মাধ্যমে। আত্মা বন্ধন থেকে মুক্ত না হলে ব্যক্তিমানুষ বন্ধনদশা থেকে মুক্তিলাভ করতে পারে না। এই মুক্তিলাভ সম্ভব হবে তত্ত্বজ্ঞানের মাধ্যমে। এই মুক্তি বা মোক্ষলাভের জন্য দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে তিনটি মার্গ বা পথের উল্লেখ করা হয়েছে। তিনটি মার্গ হল- জ্ঞানমার্গ বা জ্ঞানের পথ, কর্মমার্গ বা কর্মের পথ ও ভক্তিমার্গ বা ভক্তির পথ। এই মুক্তি বা মোক্ষলাভের পথ বা মার্গগুলিকে যোগও বলা হয়।
জ্ঞানমার্গ বা জ্ঞানাযাগ
জ্ঞানযোগ অনুযায়ী মানুষ জ্ঞানের মাধ্যমে ব্রহ্মের সঙ্গে একাত্ম অনুভব করে। এই ব্রহ্মজ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তি এই জন্মেই মুক্তিলাভ করতে পারে।
কর্মমার্গ বা কর্মযোগ
কর্মযোগ অনুযায়ী মানুষকে কর্ম করার সময় কোনোরকম ফলের আশা না করে ঈশ্বরকে সমর্পণ করে কর্ম করতে হবে। ভারতীয় ষড়দর্শন সম্প্রদায়ের মধ্যে মীমাংসক দার্শনিক সম্প্রদায় কর্মযোগের সমর্থক।
ভক্তিমার্গ বা ভক্তিযোগ
ভক্তিযোগ অনুযায়ী ভক্তির ভাব অবলম্বন করে ঈশ্বরের প্রতি আত্মসমর্পণ করলে মুক্তিকামী ব্যক্তির ঈশ্বর লাভ সম্ভব হবে। যিনি সমস্ত ইন্দ্রিয়কে সংযত করে ঈশ্বরের প্রতি নিজের চিত্তকে সমর্পণ করতে পারেন, তিনিই ভক্তিযোগী। বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী রামানুজ হলেন ভক্তিযোগের সমর্থক।
কাম ও অর্থের নিয়ন্ত্রক কোন পুরুষার্থ এবং কেন?
চতুর্বিধ পুরুষার্থ ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষের মধ্যে মোক্ষকে পরমপুরুষার্থ হিসেবে স্বীকার করা হয়েছে। কারণ মোক্ষ হল অক্ষয় সুখস্বরূপ। ধর্ম, অর্থ ও কাম- এই ত্রিবর্গ পুরুষার্থ মোক্ষ লাভের অভিমুখী হয়ে থাকে। ধর্মকে কাম ও অর্থের নিয়ন্ত্রক বলা হয়েছে।
সেই অর্থই গ্রহণযোগ্য হয় যা সৎপথে অর্জন করা হয়। আবার অর্থের সংযত ব্যবহার প্রয়োজন, অর্থের সংযত ব্যবহার তখনই সম্ভব যদি ধর্মের দ্বারা তা নিয়ন্ত্রিত হয়। ধর্ম মানুষকে সংযত জীবনযাপনে উদ্বুদ্ধ করে। অর্থ ধর্মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হলে তবেই তা পরমপুরুষার্থ মোক্ষের অভিমুখী হয়। কাম হল গার্হস্থ্য ধর্ম। ধর্ম কামকে ততটাই প্রশ্রয় দেয় যতটা তা (কাম) মানুষকে বেঁচে থাকার প্রেরণা যোগায়। কাম ব্যক্তিকে জীবনধারণের জন্য অর্থ সংগ্রহে প্রবৃত্ত করে। কাম ধর্মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হলে তবেই তা মোক্ষের অভিমুখী হয়।
ত্রিবর্গ পুরুষার্থ কীভাবে পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত?
অথবা, ধর্ম, অর্থ ও কাম পরস্পরের সঙ্গে কীরূপে যুক্ত?
ত্রিবর্গ যথা- ধর্ম, অর্থ ও কাম এই তিনের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। ত্রিবর্গের অন্তর্গত ধর্ম, অর্থ ও কামের মধ্যে অনেকে ধর্ম ও অর্থকে কামের তুলনায় শ্রেয় বলেছেন। আবার অনেকের কাছে কাম ও অর্থই শ্রেয়। আবার কারো দৃষ্টিতে ধর্মই একমাত্র শ্রেয়। অর্থ ও কাম যখন ধর্মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয় তখন যে সুখলাভ হয় তাই কাম্য। অর্থ ও কাম ধর্ম থেকেই আসে- “ধর্মাদর্থশ্চ কামশ্চ”।
সুতরাং ধর্ম, অর্থ ও কাম- এই তিনটি পুরুষার্থ একপ্রকার নয়। তাদের মধ্যে কোনোটি মুখ্য, কোনোটি গৌণ। চার্বাক মতে একমাত্র কামই মুখ্য, অর্থ ও ধর্ম গৌণ। কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে বলেছেন যে ধর্ম, অর্থ ও কাম এই ত্রিবর্গই সাধনা করা উচিত। কিন্তু অর্থ ও কাম যদি ধর্মের অনুশাসনের বিরোধী হয় তাহলে তাদের পরিত্যাগ করা উচিত। ধর্ম সমাজ কল্যাণের আদর্শে কাম ও অর্থকে নিয়ন্ত্রণ করে। মহাভারতে বলা হয় অর্থ শ্রেষ্ঠতম পুরুষার্থ। কারণ অর্থ, কৃষি, বাণিজ্য, পশুপালন ও শিল্প প্রভৃতি সমুদয় কর্মের মূল। অর্থ ছাড়া ধর্ম ও কাম লাভ সম্ভব নয়। ধর্ম ও কাম অর্থের অঙ্গস্বরূপ। আবার অনেকে বলেন কামই শ্রেষ্ঠ। কেন-না যে কামনাশূন্য সে কখনও অর্থ ও ধর্মের বাসনা করে না। সুতরাং বলা যেতে পারে যে এই ত্রিবর্গ একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
অর্থ ও ধর্মের মধ্যে সম্পর্ককে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায়?
উত্তর ভারতীয় ধর্মনীতির প্রেক্ষিতে অর্থের প্রয়োজন স্বীকার করা হলেও, অর্থ ধর্ম দ্বারা পরিচালিত হওয়ার প্রয়োজনীয়তা বহু স্থানে আলোচিত হয়েছে। বিভিন্ন শাস্ত্রগুলিতে অর্থের যথাযথ ব্যবহার, উপার্জন ইত্যাদির প্রসঙ্গ আলোচিত ও সমর্থিত হয়েছে। অর্থকে সংকীর্ণ লক্ষ্যরূপে বিবেচনা না করে বরং বৃহত্তর লক্ষ্য সাধনের উপায়রূপে গণ্য করার উপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। পুরুষার্থ প্রসঙ্গে ‘অর্থ’ বলতে জীবিকা অর্জনের উপায়কে বোঝায়। বিষয়-সম্পত্তি, জীবনধারণের আর্থিক উপকরণ সবই অর্থ। মহাভারতে অর্জুন ত্রিবর্গের মধ্যে অর্থের প্রাধান্যের কথা বলেছেন। বলা হয়েছে যে উত্থানশক্তির সাহায্যেই অর্থলাভ হয়। ধর্ম, কাম, স্বর্গ, আনন্দ, ক্রোধ, শাস্ত্রজ্ঞান এবং ইন্দ্রিয়দমন- এই সমস্ত কিছুই অর্থের দ্বারা নিষ্পন্ন হয়। আবার মানুষের বিভিন্ন আচরণের ক্ষেত্রে ধর্মই নিয়ন্ত্রক। কেন-না ধর্মের দ্বারা পরিচালিত না হলে অর্থ অনর্থের মূল হতে পারে। দৈনন্দিন প্রয়োজনে যতটা অর্থ আবশ্যক তার অধিক অর্থ সঞ্চয় করা উচিত নয়।
অর্থের এই সংযত ব্যবহারের জন্য ধর্মের নিয়ন্ত্রণ আবশ্যক। অর্থের সদ্ব্যবহার কেবলমাত্র ধর্মের নিয়ন্ত্রণেই সম্ভব। অর্থ যখন ধর্মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় তখনই তা পরমপুরুষার্থ মোক্ষের অভিমুখে নিয়ে যায়।
ধর্মের সঙ্গে অর্থ, কাম ও মোক্ষের সম্পর্ক সংক্ষেপে আলোচনা করো।
উত্তর ধর্ম এক স্বতন্ত্র ধারণা, সত্য ও অবিকল্প। ‘ধর্ম’ শব্দটির কোনো আনুষঙ্গিক ধর্মীয় ধারণা নেই। ধর্ম হল বেদবাক্য দ্বারা জ্ঞাপিত কর্ম। ধর্মের নামে যথেচ্ছাচার প্রকৃতপক্ষে কোনো ধর্ম নয়। ধর্ম একটা শৃঙ্খলাসূত্র, একটা বিশ্বনীতি। ঋগ্বেদের যুগে এই ধর্মই ‘ঋত’ নামে পরিচিত ছিল। এটি একটি নৈতিক বিধি যা মানব আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে। অর্থাৎ তৃতীয় পুরুষার্থ কামকে সংযত করে। অর্থোপার্জনই হোক্ বা কাম পরিতৃপ্তিই হোক্ কোনোটিই অনৈতিক ও অধর্মীয়ভাবে পালন করা পুরুষার্থ নয়। পুরুষার্থ হল মানুষের কর্তব্যকর্ম, যা সমাজে তার (মানুষের) বর্ণ ও আশ্রমানুযায়ী নির্ধারিত হয়। উক্ত ত্রিবর্গ পুরুষার্থ ব্যতীত মোক্ষলাভ সম্ভব নয়। সুতরাং পুরষার্থ চতুষ্টয়ের মধ্যে নিগূঢ় সম্পর্ক বিদ্যমান।
অর্থের সঙ্গে ধর্ম, কাম ও মোক্ষের সম্পর্ক সংক্ষেপে আলোচনা করো।
অর্থ মানবজীবনের অপরিহার্য প্রয়োজনীয় বিষয় হলেও স্বতঃমূল্যবান পদার্থ নয়, পরতমূল্যবান পদার্থ। অর্থ সুখলাভের উপায় মাত্র; কিন্তু উপেয় নয়। তাই অর্থ তখনই পুরুষার্থ বলে বিবেচিত হয় যখন ধর্মানুকূল হয়। যদি তা না হয় তাহলে অর্থ আধ্যাত্মিক জীবনের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। যদি কোনো ব্যক্তি জীবনযাপনের জন্য অর্থলাভে সচেষ্ট হয় তাহলেও সতর্ক থাকতে হবে যে সেই অর্থে যেন তার আসক্তি না জন্মায়। জীবনযাপনের জন্য ঠিক যতটুকু অর্থের প্রয়োজন তার অতিরিক্ত অর্থ উপার্জন থেকে বিরত থাকতে হবে। সুতরাং অর্থ ধর্মপথে সৎকামনা পূর্বক অর্জন করতে হবে তবেই তা পুরুষার্থ হবে। অর্থ ব্যতীত অন্যান্য পুরুষার্থগুলি স্বতন্ত্রভাবে পূর্ণতা পায় না বলেও তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান।
কামের সঙ্গে ধর্ম, অর্থ ও মোক্ষের পারস্পরিক সম্পর্ক সংক্ষেপে আলোচনা করো।
কাম অর্থাৎ ইন্দ্রিয় উপভোগজনিত সুখের কামনা যা আধ্যাত্মিক জীবনের পথে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ অন্তরায়। ‘ভগবদ্গীতায়’ বলা হয়েছে- “ধর্মাবিরুদ্ধো ভূতেষু কামোহস্মি।” অর্থাৎ ‘আমিই ধর্মের অবিরোধী কাম’। মানুষের লোভ-লালসাকে অর্থ প্রশান্ত করে, কিন্তু কাম প্রশমিত হওয়ার পরিবর্তে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। অর্থ উপার্জনে মানুষের যেমন নিয়ন্ত্রণ থাকা প্রয়োজন তেমনই কামকেও নিয়ন্ত্রণ করা উচিত এবং তা ধর্মপথেই সম্ভব। ধর্মই শুভ ও অশুভ কর্মকে নির্ধারণ করে। ত্রিবর্গের যথাযথ সাধন সম্ভব হলেই মোক্ষলাভ সম্ভব হয়। সুতরাং কামের সঙ্গে ধর্ম, অর্থ ও মোক্ষের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান।
মোক্ষের সঙ্গে ধর্ম, অর্থ ও কামের পারস্পরিক সম্পর্ক সংক্ষেপে আলোচনা করো।
মোক্ষই একমাত্র নিত্য সুখস্বরূপ। তাই মোক্ষ হল পরমপুরুষার্থ। ধর্ম, অর্থ ও কাম- এই ত্রিবর্গ সাধনা ছাড়া মোক্ষলাভে অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়। স্বতঃমূল্যবান পরমপুরুষার্থ ‘মোক্ষ’ লাভের আবশ্যিক উপায় হিসেবেই ‘ধর্ম’ প্রয়োজনীয়। আবার কাম মানুষকে কর্মে প্রবৃত্ত করে, কামের ফলে আসে সংকল্প, তার থেকে আসে প্রযত্ন এবং সংকল্পের মধ্যে প্রযত্ন শৃঙ্খলিত হলে সেই কর্মই অর্থকে বহন করে নিয়ে আসে। সংকল্প, প্রবৃত্তি, প্রযত্ন-এগুলি ব্যতিরেকে মোক্ষলাভে প্রয়াসী হওয়া যায় না। মোক্ষকামী ব্যক্তিই একমাত্র মোক্ষলাভের যোগ্যতা অর্জন করতে পারে। যার মুক্তির প্রতি ইচ্ছা নেই, প্রবৃত্তি নেই, সংকল্প নেই সে কখনও মোক্ষলাভের চেষ্টাই করে না। সুতরাং মোক্ষের সঙ্গে ধর্ম, অর্থ ও কামের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান।
চার্বাক, জৈন ও বৌদ্ধমতে মোক্ষ কী?
চার্বাক
চার্বাকরা মোক্ষ বলতে দেহ-বন্ধন থেকে আত্মার মুক্তিকে বোঝেন না, আবার দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তিও বোঝেন না, তাদের মতে আত্মার যেহেতু কোনো সত্তা নেই, তাই তার বন্ধনমুক্তির প্রশ্ন ওঠে না। তা ছাড়া দেহ থাকলেই সুখ ও দুঃখ থাকবে। কাজেই দুঃখের সম্পূর্ণ মুক্তি সম্ভব নয়। একমাত্র মৃত্যুতেই দুঃখের আত্যন্তিক বিনাশ সম্ভব।
জৈন
জৈন মতে আত্মার সঙ্গে বিশেষ পুদগল বা জড়াণু যুক্ত হলে আত্মা দেহধারণ করে এবং বন্ধনদশা প্রাপ্তি হয়। এই পুদগলের বিয়োগ ঘটলে আত্মার মুক্তি ঘটে। জৈন দর্শনে সম্যক দর্শন, সম্যক জ্ঞান ও সম্যক চরিত্র – এই তিনটিকে একত্রে ‘ত্রিরত্ন’ বলা হয়। এই ত্রিরত্নের অনুশীলনে আত্মার মুক্তি বা মোক্ষপ্রাপ্তি হয়।
বৌদ্ধ
বৌদ্ধ নীতিশাস্ত্রে মোক্ষকে ‘নির্বাণ’ রূপে অভিহিত করা হয়েছে। বুদ্ধদেবের মতে দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি হল নির্বাণ। তাঁর মতে দুঃখ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য ভবচক্রের আবর্তনের গতিকে বুদ্ধ করতে হবে। আমাদের অবিদ্যাকে দূর করতে হবে। কারণ অবিদ্যাই দুঃখের জন্ম দেয়। বুদ্ধদেবের চারটি আর্যসত্য সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানই ব্যক্তিমানুষকে অবিদ্যা থেকে মুক্ত করতে পারে। এরপর প্রজ্ঞা, শীল ও সমাধি অনুশীলনের মাধ্যমে ব্যক্তির অবিদ্যা দূরীভূত হলে নির্বাণ লাভ করা সম্ভব। জীবিতকালে নির্বাণপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে বৌদ্ধ দর্শনে ‘অর্হৎ’ বলা হয়।
সাংখ্যমতে দুঃখ কয় প্রকার ও কী কী? মোক্ষ সম্পর্কে সাংখ্য ও যোগ দর্শনে কী বলা হয়?
সাংখ্যমতে ত্রিবিধ দুঃখ
আধ্যাত্মিক, আধিদৈবিক ও আধিভৌতিক এই ত্রিবিধ দুঃখের কথা সাংখ্য দর্শনে বলা হয়েছে। এই ত্রিবিধ দুঃখ থেকে মুক্তিই হল কৈবল্য। দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তির উপায় নির্দেশ প্রসঙ্গে সাংখ্য দার্শনিক ঈশ্বরকৃয় বলেছেন “ব্যক্তাব্যক্তজ্ঞবিজ্ঞানাৎ” -এর অর্থ হল, ‘ব্যক্ত’, ‘অব্যক্ত’ এবং ‘জ্ঞ’ বা জ্ঞানের মাধ্যমে লব্ধ বিবেকজ্ঞানের দ্বারা মোক্ষলাভ সম্ভব।
সাংখ্য ও যোগদর্শন মতে মোক্ষ
সাংখ্য মতে ও যোগ দর্শনে পুরুষের নিজের স্বভাবে অবস্থানকে মোক্ষ বলে। পুরুষ ও প্রকৃতির অবিবেক অর্থাৎ অভেদজ্ঞান হল পুরুষের বন্ধনের কারণ। পুরুষ ও প্রকৃতির ভেদজ্ঞানই দুঃখ নিবৃত্তির একমাত্র উপায়। পঞ্চবিংশতি-তত্ত্বজ্ঞানের দ্বারা পুরুষের বিবেক খ্যাতি হয়। ফলে পুরুষ নিজেকে প্রকৃতি থেকে আলাদা বলে উপলব্ধি করে।
ন্যায়-বৈশেষিক ও মীমাংসা দর্শনে মোক্ষ সম্বন্ধে কী বলা হয়েছে?
ন্যায় বৈশেষিক মতে মোক্ষ
ন্যায়-বৈশেষিক মতে, সবরকম দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি-ই হল মোক্ষ। নৈয়ায়িকদের মতে শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসনের দ্বারা মিথ্যা জ্ঞান দূর হলে জীবের মোক্ষপ্রাপ্তি হয়। ন্যায়- দার্শনিকদের মতে মুক্তি দুই প্রকার- অপরনিঃশ্রেয়স ও পরনিঃশ্রেয়স। উভয়প্রকার মুক্তি তত্ত্বজ্ঞান থেকে লাভ করা যায়।
অপরনিঃশ্রেয়স মুক্তি শরীর থাকাকালীন অবস্থায় অর্থাৎ জীবিত অবস্থায় তত্ত্বজ্ঞানের উদয় হলে লাভ হয়।
পরনিঃশ্রেয়স মুক্তি জ্ঞানীর প্রারব্ধ কর্মের ফলভোগ শেষ হলে লাভ হয়। প্রথমটিকে জীবন্মুক্তি এবং দ্বিতীয়টিকে বিদেহমুক্তি বলা হয়।
মীমাংসা মতে মোক্ষ
মীমাংসা দর্শনের মতে মোক্ষ হল স্বর্গপ্রাপ্তি। মানবজীবনের বন্ধন থেকে মুক্তিলাভ করলে তবেই মোক্ষলাভ সম্ভব। পূর্বজন্মের কর্মফল সম্পূর্ণভাবে বিনষ্ট হলে তবে আত্মার মুক্তি বা মোক্ষলাভ ঘটে। মীমাংসকরা জীবন্মুক্তিতে বিশ্বাস করেন না। তাদের মতে বিদেহ মুক্তিই হল প্রকৃত মোক্ষ।
অদ্বৈত বেদান্ত ও বিশিষ্টাদ্বৈতবাদের মতে মোক্ষ বলতে কী বোঝায়?
অদ্বৈত বেদান্ত মতে মোক্ষ
শঙ্করাচার্যের মতে জীবাত্মার সঙ্গে ব্রহ্মের একাত্মতা উপলব্ধিই হল মোক্ষ। তাঁর মতে জীবই ব্রহ্ম। ‘আমিই সেই ব্রহ্ম’- এইভাবে জীবাত্মা ও পরমাত্মার অভেদ জ্ঞান হলেই মুক্তি ঘটে। ব্রহ্ম সৎ, চিৎ ও আনন্দস্বরূপ। জীবও ব্রহ্মের মতো সৎ, চিৎ ও আনন্দস্বরূপ। অবিদ্যার কারণে জীব এই সত্য ভুলে গিয়ে নিজেকে দেহ, মন ও ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে অভিন্ন মনে করে। এই অজ্ঞানতা হল জীবের বন্ধনের কারণ। শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসনের মধ্য দিয়ে জীব মোক্ষলাভ করে এবং পরম আনন্দের অধিকারী হয়।
বিশিষ্টাদ্বৈত বেদান্ত মতে মোক্ষ
বিশিষ্টাদ্বৈতবাদীরা মনে করেন মোক্ষ ঈশ্বরের সঙ্গে অভিন্ন নয়। কেন-না ঈশ্বর অসীম, মানুষ সসীম। তাই সমগ্রের সঙ্গে অংশের অভিন্নতা সম্ভব নয়। ঈশ্বরের কৃপালাভে ব্যক্তি মোক্ষ লাভ করতে পারে। অর্থাৎ ঈশ্বরকে অনুভব বা উপলব্ধি করতে পারে। মুক্ত আত্মায় বিশুদ্ধ চৈতন্য থাকায় তা ঈশ্বর বা ব্রহ্মসদৃশ হয়ে পড়ে এবং মুক্ত আত্মা ঈশ্বরের নিত্য-সান্নিধ্য অনুভব করে।
রামানুজের মতে জীবাত্মা ব্রহ্মের অংশ- এই উপলব্ধিই হল মোক্ষ। মোক্ষ অবস্থায় জীব ব্রহ্মসম হয়। মোক্ষলাভের পথ হল ভক্তি।
আরও পড়ুন – যুক্তিবিজ্ঞানের প্রকৃতি – অবরোহ এবং আরোহ