পুঁইমাচা গল্পের নামকরণের সার্থকতা

পুঁইমাচা গল্পের নামকরণের সার্থকতা

পুঁইমাচা গল্পের নামকরণের সার্থকতা
পুঁইমাচা গল্পের নামকরণের সার্থকতা

ভূমিকা

সাহিত্যের যে-কোনো ভাগ অর্থাৎ গল্প-কবিতা-উপন্যাস-নাটক ইত্যাদির নামটি পড়েই পাঠক প্রাথমিকভাবে সে সাহিত্যের বিষয় সম্পর্কে ধারণা করে। সাহিত্যিকের সুচিন্তিত নামকরণ সাহিত্যের প্রতি পাঠককে আগ্রহী করে তোলে অনেকসময়। সুতরাং সাহিত্যের ক্ষেত্রে নামকরণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। নামকরণের মধ্য দিয়েই পাঠক সাহিত্যের সঙ্গে প্রথম পরিচিত হন। আবার সাহিত্যের অর্থও বোঝা যায় নামকরণের মাধ্যমে। স্রষ্টারা নামকরণের ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়- যেমন কখনো কোনো বিষয় বা ঘটনা, আবার কখনো প্রধান চরিত্রকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। কখনো আবার নামকরণের ক্ষেত্রে লেখক আশ্রয় নেন ব্যঞ্জনার। আমাদের আলোচ্য বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুঁই মাচা’ গল্পটির নামকরণ ব্যঞ্জনাধর্মী। আছে সহায়সম্বলহীন

কাহিনি

‘পুঁই মাচা’ গল্পের কেন্দ্রে সহায়হরি চাটুজ্যের পরিবার। স্ত্রী অন্নপূর্ণা আর ক্ষেন্তি-পুঁটি-রাধী এই তিন কন্যাকে নিয়ে দরিদ্র সহায়হরির আটপৌরে সংসার। বিবাহযোগ্যা বড়ো কন্যা ক্ষেন্তিকে নিয়ে যখন অন্নপূর্ণার সীমাহীন দুশ্চিন্তা, তখন দেখা যায় সহায়হরি বা ক্ষেন্তি সে ব্যাপারে নিতান্ত নির্বিকার। স্বাভাবিকভাবেই অন্নপূর্ণা বিরক্ত হন, মাঝেমধ্যে কথা শোনান উদাসীন স্বামীকে, কখনো-বা ভোজনরসিক বাউন্ডুলে বড়ো কন্যাটিকেও। ক্ষেন্তির প্রকৃত বয়স পনেরোর কাছাকাছি হলেও সহায়হরি লোক সমাজে বলে বেড়ান তেরো। গ্রামসমাজে এই বিয়ে নিয়ে মাঝেমাঝেই সহায়হরিকে একঘরে করে দেওয়ার কথা ওঠে চণ্ডীমণ্ডপে। সে-কথা কানে এলে অন্নপূর্ণা অসহায় বোধ করেন। তা ছাড়া পূর্বে ক্ষেন্তির বিবাহ ঠিক হয়ে তা আশীর্বাদ পর্যন্ত গড়িয়েছিল। কিন্তু পাত্রের স্বভাবচরিত্র ভালো নয় জেনে সে বিয়ে নিজেই ভেঙে দেন সহায়হরি। ফলে গ্রামের মাতব্বররা নানান সময়ে তাঁকে সমাজচ্যুত করার ভয় দেখান।

যাকে নিয়ে অন্নপূর্ণার এত দুশ্চিন্তা, যার জন্য সহায়হরির সমাজ্যচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা, সেই ক্ষেন্তি কিন্তু এসব ব্যাপারে চিন্তিত নয় মোটেই। আলোচ্য গল্পের প্রথম থেকেই দেখা যায় জীবনের কাছে বিরাট প্রত্যাশা নেই তার। দীনহীন পরিবারে অনাদরে লালিত অত্যন্ত অগোছালো, নিতান্ত নিরীহ এবং অধিক মাত্রায় ভোজনপটু ক্ষেন্তি সামন্য প্রাপ্তিতেই পরিপূর্ণ তৃপ্তির আনন্দ পায়।

পুঁই মাচা’ গল্পের শুরুতেই দেখা যায় ক্ষেন্তি রায় কাকার দেওয়া পাকা পুঁইশাকের বোঝা এবং গয়াবুড়ির কাছ থেকে কিছু চিংড়ি মাছ চেয়ে এনে অন্নপূর্ণার কাছে চচ্চড়ি খাওয়ার আবদার করেছে। মেয়ের এই আচরণে অন্নপূর্ণা বিরক্ত হয়েছেন, ছোটো মেয়ে রাধীকে নির্দেশ দিয়েছেন শাকগুলি বাইরে ফেলে দিয়ে আসার জন্য। কিন্তু কিছু সময় পরেই ভোজনপটু মেয়েটির সামান্য চাহিদাকে প্রশ্রয় দিয়ে ফেলে দেওয়া শাকপাতা কুড়িয়ে এনে চিংড়ি মাছ দিয়ে চচ্চড়ি রান্না করেছেন। পরমতৃপ্তিতে সে তরকারি চেটেপুটে খেয়েছে ক্ষেন্তি। পৌষ সংক্রান্তিতে যৎসামান্য উপাচারে যখন অন্নপূর্ণা পিঠে বানাতে বসেছেন, তখনও ক্ষেন্তি উপস্থিত থেকেছে স্বমহিমায়। মায়ের কাছ থেকে একটু নারকেলের কুরো চেয়ে নিয়ে দূরে গিয়ে সে যখন খেয়েছে, সংবেদনশীল লেখকমনে তখন ধরা পড়েছে ক্ষেন্তির পরিতৃপ্তির প্রতিচ্ছবি।

নামকরণের সার্থকতা: আলোচ্য গল্পে আগাগোড়া ফুটে উঠেছে খাদ্যবস্তুর প্রতি ক্ষেন্তির অপরিসীম আকর্ষণের ছবি। ভরা শীতে উঠোনের কোণে একটি জীর্ণ পুঁইচারা রোপণ করে ক্ষেন্তি তাকে জল দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার সংকল্প করেছিল। কিন্তু বৈশাখ মাসে তার বিয়ে হয়ে যাওয়ায় সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেনি সে। এমনকি বছর ঘুরে গেলেও বরপণের প্রায় আড়াইশো টাকা বাকি থাকায় ক্ষেন্তিকে পাঠানো হয় না তার বাপের বাড়িতে। এরই মধ্যে বসন্ত রোগে মারা যায় ক্ষেন্তি। ক্ষেন্তির মৃত্যুতে একরাশ আশঙ্কার অপমৃত্যু ঘটে। ক্ষেন্তি মারা যায়, কিন্তু তার হাতে বসানো সেই পুঁইচারাটি ততদিনে মাচা জুড়ে সুপুষ্ট-নধর-প্রবর্ধমান জীবনের লাবণ্যে ভরে ওঠে। বর্ষার জল আর কার্তিক মাসের শিশির পেয়ে পুঁই গাছের কচিকচি সবুজ ডগাগুলি মাচা থেকে বাইরে বেরিয়ে হাওয়ায় দোলে।

গ্রামবাংলার পল্লি প্রকৃতিতে পুঁইশাক কোনো মহার্ঘ বস্তু নয়। সাধারণ গ্রাম্য পরিবেশে বা পরিবারে তা অযত্নলালিত, ঠিক যেন ক্ষেন্তির মতোই। আবার ক্ষেন্তির মতোই তার হাতে বসানো পুঁইশাকগুলি দেখা যায় অপরিসীম প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর। যে সহায়হীন পরিবারের প্রাণ ক্ষেন্তি, সেই পরিবারেরই উঠোনের কোণের মাচাটিতে ক্ষেন্তির বসানো পুঁইশাকগুলির সজীব উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। এখানে প্রতিটি শব্দই লেখক খুব সচেতনভাবে ব্যবহার করেছেন। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, গল্পটির নাম ‘পুঁই গাছ’ কিংবা ‘পুঁইচারা’ হল না কেন? ‘পুঁই মাচা’ বলতেই মাচা থেকে দুলে পড়া এক ক্রমবর্ধমান সুপুষ্ট নধর জীবনলাবণ্যে ভরপুর গাছের ছবি পাঠকের মনে ভেসে ওঠে। তা আসলে হয়ে ওঠে ক্ষেন্তির প্রতিচ্ছবি।

এক অদ্ভুত ব্যঞ্জনায় বিভূতিভূষণ মিলিয়ে দেন ক্ষেন্তির মৃত্যুহীন আশা-আকাঙ্ক্ষাগুলির সঙ্গে সুপুষ্ট নধর-প্রবর্ধমান জীবনের লাবণ্যে ভরা পুঁইশাকগুলিকে। আবার সেই সূত্রেই মিলে যায় সহায়হরি- অন্নপূর্ণার হতদরিদ্র সংসারের সঙ্গে পুঁই মাচাটি, যে সংসারে শত অভাব থাকলেও ক্ষেন্তির মধ্যে প্রাণপ্রাচুর্যের অভাব ছিল না বিন্দুমাত্র। সংবেদনশীল বিভূতিভূষণ তাই আলোচ্য গল্পের নামকরণের ক্ষেত্রে ‘পুঁই মাচা’র ব্যঞ্জনাটিকেই যথার্থ অর্থে ব্যবহার করেছেন, যা – শিরোনামটিকে সার্থক করে তুলেছে।

আরও পড়ুন – ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কবিতার MCQ

একাদশ শ্রেণির কলা বিভাগের যে কোনো প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন। কোনো উত্তর না পেলে আমাদের কমেন্ট বক্সে জানান।

Leave a Comment