পরিবেশ বনাম উন্নয়ন – মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
ভূমিকা
যুগে যুগান্তরে তথা সভ্যতার উষালগ্ন থেকে বিজ্ঞাননির্ভর সভ্যতার দ্বারপ্রান্তে উপনীত মানুষ সবসময়েই কামনা করেছে এক সুন্দর পরিবেশ যা বেঁচে থাকার ও বাঁচিয়ে রাখার অনবদ্য প্রয়াস বলা যেতে পারে।
প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যমন্ডিত কোমল পরিবেশে প্রকৃতি, মানুষ ও জীবজন্তুরা একে অপরের অভিন্ন সত্তা বলে মনে করত কিছু সভ্যতার এগিয়ে চলার সঙ্গে সঙ্গে যান্ত্রিক সভ্যতায় বিপন্ন পরিবেশের মধ্যে দিয়ে আমরা ক্রমশ এগিয়ে চলেছি। বিজ্ঞাননির্ভর যান্ত্রিক সভ্যতার অভিশাপে পর্যুদস্ত আজকের প্রজন্ম, ভবিষ্যত প্রজন্ম আরও ভয়ানক দিনের অপেক্ষায়। নগর উন্নয়নের হাত ধরেই যেন পরিবেশ দূষণের নান্দীপাঠ শুরু হয়েছে। মানুষ ও জীবজন্তুকে বসবাস করতে হচ্ছে আবদ্ধ এক দুষিত পরিবেশের মধ্যে যা এক বিপজ্জনক পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে পৃথিবীর অগণিত মানুষকে।
উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা
উন্নয়ন মানব সমাজের তথা সভ্যতার এগিয়ে চলার পথের এক একান্ত প্রয়োজনীয় চাহিদা। শ্রমজীবী মানুষ পাহাড় পর্বত লঙ্ঘন করে অরণ্য ধ্বংস করে, মরু থেকে মেরুতে অভিযান চালিয়ে মানব সভ্যতাকে ধাতুযুগ থেকে আধুনিক যুগে উপনীত করেছে। আরণ্যক মানুষ নির্মাণ করেছে নগর, বন্দর, সুদৃশ্য অট্টালিকা আর বিজ্ঞানভিত্তিক আবিষ্কারে মত্ত মানুষ উন্নয়নের রথচক্রের গতিকে করেছে ত্বরান্বিত। দেশে দেশে শিল্প আর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মেলবন্ধনে সভ্যতা হয়েছে উন্নততর। মানুষতো চিরকাল একই আবহে বেঁচে থাকতে জানে না, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে সে এগিয়ে যেতে চায় আরও আরও উন্নতির সরণিতে। উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। উন্নয়ন অস্বাভাবিক নয়, আধুনিক মানুষ পাদতিক হতে চায় সভ্যতার এগিয়ে চলার পথে।
উন্নয়ন ও পরিবেশ
উন্নয়ন ও পরিবেশ যেন আজ পরস্পরবিরোধী অভিধায় দাঁড়িয়ে আছে সভ্যতার মিনারে বসে। নগরায়ণ, শিল্পবিপ্লবের কারণে সৃষ্ট ক্ষুদ্র ও বৃহৎ ভারী শিল্পের কলকারখানা কখনো-কখনো জানিয়ে দিচ্ছে পরিবেশ কেমন ভয়ঙ্কররূপে দূষিত হয়ে চলেছে এবং তা জনজীবনকে ভয়াবহভাবে বিপন্ন করে তুলেছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নব নব আবিষ্কারের সঙ্গেঙ্গ যান্ত্রিক সভ্যতার অভিশপ্ত রূপ প্রতি পদে পদে আমরা উপলব্ধি করছি। বিভিন্ন ধরনের দূষণ জীবজন্তু ও প্রাণীসম্পদের সর্বনাশকে করেছে ত্বরান্বিত। উন্নয়নে উন্মত্ত মানুষ হারিয়ে ফেলছে পরিবেশগত চেতনা।
প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে বিকিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর বুক থেকে সবুজের সমারোহ। নগরায়ণের প্রবলতর চাপে ও জনবিস্ফোরণের চাপে সবুজ ধ্বংস করে গড়ে উঠেছে একটার পর একটা আবাসন। জলা জমি বুজিয়ে, ধ্বংস করে এবং মানুষের প্রিয়তম বন্ধু বৃক্ষকে ছেদন করে গড়ে উঠেছে লোকালয়। যে আকাশে বাতাসে ছিল সৌন্দর্য সুখের আবাস, আজ সেখানে চিমনি নির্গত বিষাক্ত ধোঁয়ায় দমবন্ধ আবহ। কর্মব্যস্ত মানুষ সৌন্দর্যের লীলাক্ষেত্রকে হরণ করে নিয়ে দুষিত জনজীবনকে উপহার দিয়েছে। একবিংশ শতাব্দীতে পৌঁছে আমরা অনুভব করলাম, বিজ্ঞাননির্ভর সভ্যতা আমাদের জন্য শুধুমাত্র আশীর্বাদ নিয়ে আসেনি, সঙ্গে সঙ্গে বহন করে এনেছে অনেক অভিশাপ। বিশ্বকবি সেকারণেই বলেছেন-
"আদিম বসনপ্রান্তে উঠেছিল মন্দ্রিত সাগরে ডানহাতে সুধাপাত্র, বিষভাণ্ড লহে বাম করে।"
পরিবেশ বাঁচানোর পথ
ইটের পাঁজরে লোহার খাঁচায় আচ্ছন্ন বিষাক্ত পরিবেশ থেকে বাঁচতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন গণসচেতনতা। উন্নয়নকে স্তন্ধ করে দিয়ে নয়, বরং উন্নয়নের ধারাকে বাঁচিয়ে রেখে আমাদের আজ সচেতন হতে হবে। পরিবেশের স্নিগ্ধতাকে ফিরিয়ে আনার জন্য তাই আমাদের মনে রাখতে হবে,
"জীবনের জন্য অন্ন অন্নের জন্য বৃষ্টি বৃষ্টির জন্য বৃক্ষ বৃক্ষ লাগান প্রাণ বাঁচান।"
কোটি কোটি বিকলাঙ্গ শিশু দাঁড় করিয়ে দিয়েছে এক ভয়ঙ্কর প্রশ্নের সামনে-এ বিশ্ব কি শিশুদের বাসযোগ্য নয়। আগামী দু-তিন দশকের মধ্যে আমাদের বিপুল জমি হবে বন্ধ্যা, তাই পরিবেশকে রক্ষা করতে হলে অবশ্য পালনীয় কর্তব্যগুলি হল-
- ক। অরণ্যসপ্তাহ পালন করতে হবে।
- খ। সামাজিক বনসৃজনপ্রকল্প ও বনসংরক্ষণ কর্মসূচি সঠিকভাবে পালন করতে হবে।
- গ। সরকারি প্রয়াসে চোরাচালানকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে হবে।
- ঘ। বনবিভাগ কর্তৃক বনমহোৎসব-এর জন্য প্রতি বছর বিনামূল্যে যে চারা বিতরণ করা হয়, তা সযত্নে লালনপালন করতে হবে।
- ঙ। শহর ও গ্রামাঞ্চলে পরিবেশ রক্ষার জন্য সক্রিয় হতে হবে।
- চ। শিল্প-কারখানার বর্জ্য পদার্থ বিজ্ঞানভিত্তিক কাজে লাগাতে হবে। দূষক উপাদানগুলিকে পরিবর্তিত করে ব্যবহার করতে হবে।
- ছ। লাগামছাড়া মোবাইল টাওয়ারগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
- জ। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে পরমাণু বিস্ফোরণ বা রকেট উৎক্ষেপণ নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন।
উপসংহার
উন্নয়নের উজ্জ্বল আলোকস্তম্ভের মায়াময় বিচ্ছুরিত আলোতে আমরা হারিয়ে ফেলেছি পরিবেশ বাঁচানোর সচেতনতা। এভাবে চললে একদিন বিপন্ন হবে জনজীবন, ভেঙে পড়বে জনস্বাস্থ্য, পরিবেশের আনাচে কানাচে শোনা যাবে সূক্ষ্মভাবে বেঁচে থাকার জন্য আর্তনাদ-হাহাকার। অবুঝ মনের বল্লাহীন উন্নয়ন কাম্য নয়, সভ্যতার অমরত্ব লাভের জন্য পরিবেশকে সবুজ ও সজীব রাখতেই হবে। তবেই বেঁচে থাকা যাবে আনন্দে, নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া যাবে বাসযোগ্য পৃথিবী।
আরও পড়ুন – ১। পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা
২। পরিবেশ রক্ষায় অরণ্য – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা