পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা
“অন্ন চাই, প্রাণ চাই, আলো চাই। চাই মুক্ত বায়ু। চাই বল, চাই স্বাস্থ্য, আনন্দ উজ্জ্বল পরমায়ু।”-বসুন্ধরার বুকে প্রাণে উজ্জীবন, স্বাস্থ্য, আনন্দ উজ্জ্বল পরমায়ুর সাধনা মানবের ঐকান্তিক ইচ্ছা ও প্রচেষ্টা, প্রকৃতি মাতৃস্বরূপা, বিশ্বপ্রাণের ধাত্রী। সভ্যতার অগ্রগমনের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে মানুষের ব্যবধান বেড়েই চলেছে। মানুষ অবলীলাক্রমে প্রকৃতিকে করে চলেছে ধ্বংসসাধন। তাই ক্রমশ মানবজীবন ভয়াবহ পরিণতির দিকেই এগিয়ে চলেছে। মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ভয়াবহ সমস্যার সামনে দাঁড়িয়ে। পরিবেশ দূষণ যার অন্যতম প্রধান কারণ।
পরিবেশ দূষণের নানা দিক
বিভিন্ন কারণে পরিবেশ দূষিত হয়; পরিবেশ দূষণকে মোটামুটি চারটি ভাগে ভাগ করা যায়-(ক) বায়ুদূষণ, (খ) জলদূষণ, (গ) শব্দদূষণ, (ঘ) মাটিদূষণ।
আধুনিক সভ্যতার এগিয়ে চলার পথে মারণান্তিক ব্যাধিসম দূষণের এই নানা রূপ মানবজীবনে ভয়ঙ্কর স্বাস্থ্যহানি ও
বিপজ্জনক নানাবিধ আয়ুক্ষয়কর অসুখের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শস্যশ্যামলা সবুজ মাঠ, সুনির্মল আকাশ আর বিশুদ্ধ বাতাস ক্রমশ অলীক কল্পনা বলে মনে হয়, কেন-না জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে যেন শুধুই ধোঁয়া, ধুলো, বর্জ্য পদার্থ, কীটনাশক আর জীবন-হানিকর ধাতব পদার্থের সমাবেশ।
বায়ুদূষণ
মানুষের বেঁচে থাকার একান্ত প্রয়োজনীয় উপাদান হল বাতাস। ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ওপরে যে অদৃশ্য গ্যাসের আবরণ পৃথিবীকে পরিবেষ্টন করে থাকে, তাকেই বলে বায়ুমণ্ডল। সমগ্র বায়ুমণ্ডল আজ বিষাক্ত শ্বাসরোধকারী ভয়াবহ আবহে পরিণত। বিশুদ্ধ বাতাসের সঙ্গে যখন কিছু মারাত্মক ক্ষতিকর পদার্থ মিশে যায় তখন সেই বাতাস দুষিত হয়ে ওঠে এবং সেই বিশেষ অবস্থাকেই আমরা বায়ুদূষণ বলি। বায়ুমন্ডলে স্বাভাবিক বায়ুর উপাদান হল-নাইট্রোজেন ৭৮.০৩%, অক্সিজেন ২০.৯৯%, কার্বন ডাইঅক্সাইড ০.০৩%, বাকি অংশ মিথেন এবং অন্যান্য বিরল গ্যাস।
যদি বায়ুমণ্ডলের এই স্বাভাবিক উপাদানগুলির পরিমাণ বা অনুপাত বৃদ্ধি পায়, তখনই বায়ুদূষণ ঘটে। কলকারখানার চিমনি থেকে নির্গত ধোঁয়া প্রতি মুহূর্তে পরিবেশকে করে তুলছে দূষিত, ফলে মানুষের জীবন হয়ে উঠেছে ভয়াবহ। কলকারখানা, ঘরের রান্নার কাজে ব্যবহৃত কাঠকয়লার ধোঁয়া, যানবাহনের ইঞ্জিনের জ্বালানি থেকে সৃষ্ট কার্বন ডাইঅক্সাইড, কার্বন মনোঅক্সাইড, নাইট্রোজেন প্রভৃতি বিষাক্ত গ্যাসের মাত্রা যেমন বাড়িয়ে দেয়, অন্যদিকে তেমনি অক্সিজেনের মাত্রা কমিয়ে দেয়, ফলে বায়ুদূষণ ঘটে। বায়ুদূষণের কারণে প্রাণীজগৎ ও উদ্ভিদজগৎ এমনকি জড় পদার্থও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, নানাবিধ রোগের প্রকোপ প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে।
জলদূষণ
পরিবেশ দূষণের অন্যতম বিশেষ একটি কারণ হল জলদূষণ। প্রাকৃতিক অবস্থায় ব্যবহৃত জল যখন নানা বাহ্যিক অবাঞ্ছিত বস্তু বা উপাদান ও জীবাণুর মিশ্রণে আর ব্যবহারের উপযোগী থাকে না, তখনই তাকে জলদূষণ বলে। কলকারখানার বর্জ্য পদার্থ, কৃষিকাজে ব্যবহৃত উচ্চফলনশীল কৃত্রিম সার এবং কীটনাশক ওষুধ জলদূষণের অন্যতম কারণ। জ্বালানি হিসেবে কয়লার পরিবর্তে তেলের ব্যবহার বৃদ্ধির ফলে জলদূষণের মাত্রা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। আধুনিক সভ্যতার মান উন্নয়নে মানুষ বিভিন্ন বাঁধ ও জলাধার নির্মাণ করেছে, যার ফলে পরিবেশের প্রকৃতিগত ভারসাম্য চূড়ান্তভাবে বিঘ্নিত।
শব্দদূষণ
আধুনিক সভ্যতার এক ভয়ঙ্কর অভিশাপ শব্দদূষণ। যানবাহনের শব্দ, তীব্র হর্নের শব্দ, শব্দবাজির অবাঞ্ছিত ব্যবহার, জেট প্লেন ও কলকারখানার যন্ত্রপাতির আওয়াজ এবং উৎসব অনুষ্ঠান ও সভাসমিতিতে ব্যবহৃত উচ্চগ্রামের মাইক্রোফোনের আওয়াজ প্রভৃতি শব্দদূষণের অন্যতম কারণ। শব্দদূষণের ফলে শ্রবণেন্দ্রিয়ের বিরাট ক্ষতি সাধিত হয়, মানসিক রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পায়, হৃদযন্ত্রের বিরাট ক্ষতি হয়, ব্লাডপ্রেসারের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে এবং স্নায়ুতন্ত্র পর্যন্ত বিকল হয়। শব্দযন্ত্রণার প্রভাবে মাথা যন্ত্রণা, মাথা ঘোরা, মস্তিষ্ক বিকৃতি পর্যন্ত ঘটতে পারে। এককথায় বলা যায়, শব্দদূষণের কারণে বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিদারুণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
মাটিদূষণ
শব্দদূষণ, জলদূষণ, বায়ুদূষণের মতো মাটিদূষণও পরিবেশ দূষণের অন্যতম অঙ্গ। শহরাঞ্চলের বর্জ্য পদার্থ, শিল্প, ধাতুশোধনাগার, ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পে বর্জ্য পদার্থের তামা ও সিসার মতো বিষাক্ত ধাতু মাটির সঙ্গে মিশে গিয়ে মাটিদূষণ সৃষ্টি করে। বিভিন্ন তেজস্ক্রিয় পদার্থ মাটিতে মিশে তেজস্ক্রিয় দূষণের সৃষ্টি করে। অবাঞ্ছিত বৃক্ষচ্ছেদন, কীটনাশক ব্যবহার, অ্যাসিড বৃষ্টি প্রভৃতির ফলে ক্রমশ মাটি দূষিত হচ্ছে। মাটিদূষণের ফলে বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হয়, হাঁপানি প্রভৃতি কষ্টকর রোগের সঞ্চার হয়।
প্রতিকার
পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য তথা প্রতিকারের জন্য বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করতে হবে।
প্রথমত, শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য কলকারখানায় কম অপসর সৃষ্টিকারী যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, শব্দদূষণ থেকে মুক্তির একটি অন্যতম উপায় হল বৃক্ষরোপণ। কারণ ডালপালাযুক্ত বৃক্ষ শব্দতরঙ্গের পথে বাধা সৃষ্টি করে।
তৃতীয়ত, বৃক্ষরোপণের ফলে মাটিদূষণ নিয়ন্ত্রিত হতে পারে। কেন-না ভূমিক্ষয় রোধের জন্য ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষ অপরিহার্য।
চতুর্থত, পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে পরমাণু বিস্ফোরণ বা রকেট নিক্ষেপ প্রভৃতি নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন।
পঞ্চমত, বড়ো বড়ো নদীতে কলকারখানার আবর্জনা ও বর্জ্য পদার্থ নিক্ষেপকরণে নিষেধাজ্ঞা প্রয়োজন।
ষষ্ঠত, হর্নের তীব্র আওয়াজ, মাইক্রোফোনের উচ্চগ্রামের ব্যবহার ও শব্দবাজির ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে হবে।
সপ্তমত, পরিবেশ দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ প্লাস্টিকের ব্যবহার, যা আইনপূর্বক পুরোপুরি ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে হবে।
অষ্টমত, গঙ্গানদী বা বড়ো বড়ো অন্যান্য নদীগুলোর জল দূষণমুক্ত করে তুলতে হবে, যাতে তা মানুষের কল্যাণকর কাজে ব্যবহার করা যায়।
নবমত, শহরাঞ্চলে পার্ক, উদ্যান নির্মাণ, জলাশয় সংস্কার বিশেষ প্রয়োজন।
দশমত, জলাভূমি বুজিয়ে আবাসন নির্মাণ আজকের দিনের এক নিদারুণ সমস্যা। জলাভূমি সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী সেগুলিকে রক্ষা করতে হবে।
উপসংহার
পরিবেশ দূষণ মানব সভ্যতারই সৃষ্ট অভিশাপরূপে দেখা দিয়েছে-সতর্ক ও সচেতন না হলে একদিন পৃথিবীর মানুষের কাছেই তা আর বসবাসযোগ্য থাকবে না। বিশ্বজননীর বুকেই প্রাণের পদসঞ্চার কিন্তু প্রকৃতি কলুষিত হলে প্রাণের স্পন্দন একদিন হয়তো স্তব্ধ হয়ে যেতে পারে। তাই অবিলম্বে প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য, পরিবেশকে দূষণ মুক্ত করার জন্য কেবলমাত্র সরকারি পদক্ষেপই যথেষ্ট নয়, সকলের সমবেত অঙ্গীকারেই বিশ্বপ্রকৃতি হয়ে উঠবে শিশুর বাসযোগ্য-
“এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি,
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।”
আরও পড়ুন – আগুন নাটকের বড়ো প্রশ্ন উত্তর