পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম ক্রুসেডের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও
দীর্ঘ দুশো বছরব্যাপী সংঘটিত ক্রুসেডগুলিকে তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত করা হয়। যথা- ১০৯৯ খ্রিস্টাব্দ), প্রথম পর্যায় (১০৯৫- দ্বিতীয় পর্যায় (১১৪৪- ১১৯৩ খ্রিস্টাব্দ) এবং তৃতীয় পর্যায় (১১৯৩- ১২৯১ খ্রিস্টাব্দ)। চতুর্থ থেকে অষ্টম ক্রুসেড তৃতীয় পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত।
(1) পঞ্চম ক্রুসেড (১২১৭-১২২১ খ্রিস্টাব্দ)
মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে পোপ তৃতীয় ইনোসেন্ট ১২১৫ খ্রিস্টাব্দে ল্যাটেরান ধর্মসম্মেলন (Lateran Council) আহ্বান করেন, যেখানে জেরুজালেম উদ্ধারের জন্য অপর একটি ধর্মযুদ্ধ অর্থাৎ পঞ্চম ক্রুসেডের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। পোপের আহ্বানে সাড়া দিয়ে হাঙ্গেরির শাসক অ্যানডু (Andrew II)-র নেতৃত্বে হাঙ্গেরি, জার্মানি ও অস্ট্রিয়ার খ্রিস্টান জনতা জলপথে অভিযান শুরু করে (১২১৭ খ্রিস্টাব্দ)। জেরুজালেম যেহেতু তখনও পর্যন্ত মিশরীয় সুলতানের অধীনে ছিল, সেইজন্য ধর্মযোদ্ধারা প্রথমেই মিশর আক্রমণ করেন। তাঁরা বিখ্যাত বন্দর দামিয়েট্টা (Damietta) দখল করে নেয়। মিশরের সুলতান মালিক আল-কামিল (Malik al-Kamil) সমঝোতার প্রস্তাব দেন, এই বন্দর প্রত্যর্পণের বিনিময়ে জেরুজালেমের অধিকাংশ অঞ্চল খ্রিস্টানদের হাতে তুলে দিতে রাজি হন। কিন্তু ধর্মহীন ধর্মযোদ্ধার দল অকারণে অধিকৃত অঞ্চলে ধ্বংস ও হত্যাকাণ্ড চালালে, মিশরীয় বাহিনী প্রত্যাঘাত করতে বাধ্য হয় এবং ধর্মযোদ্ধারা পরাজিত হয়ে পিছু হটে। শেষপর্যন্ত মিশরের সঙ্গে ক্রুসেডারদের ৮ বছরের শান্তিচুক্তি স্থাপিত হয় (১২২১ খ্রিস্টাব্দ)।
(2) ঘষ্ঠ ক্রুসেড (১২২৮-১২২৯ খ্রিস্টাব্দ)
পঞ্চম ক্রুসেডের ব্যর্থতার ফলে পোপ তৃতীয় হনোরিয়াস (Pope Honorius III) পবিত্র রোমান সম্রাট দ্বিতীয় ফ্রেডরিখ (Frederick II)-কে পরবর্তী ক্রুসেডের দায়িত্বভার অর্পণ করেন (১২২৪ খ্রিস্টাব্দ)। এরপর সম্রাট ফ্রেডরিখের নেতৃত্বে ক্রুসেডাররা পবিত্র জেরুজালেম দখলের উদ্দেশ্যে ১২২৮ খ্রিস্টাব্দে অভিযান শুরু করেন। তিনি একক প্রয়াসে এবং পরম মিত্রতাসুলভ আচরণ দ্বারা মিশরের সুলতান আল-কামিলের সঙ্গে সমঝোতায় সফল হন। ১২২৯ খ্রিস্টাব্দে স্বাক্ষরিত জাফা সন্ধি-র ফলে ১০ বছরের জন্য জেরুজালেম, নাজারিথ (Nazareth) ও বেথলেহেম (Bethlehem) খ্রিস্টানদের দখলে আসে। কিন্তু নিরঙ্কুশ ক্ষমতা অর্জনে অভিলাষী পোপ নবম গ্রেগরি (Pope Gregory IX) এই চুক্তিকে খ্রিস্টান জগতের পক্ষে অবমাননাকর বলে নিন্দা করেন। ফলে ১২৪৪ খ্রিস্টাব্দে জেরুজালেমের উপর পুনরায় মুসলমানদের পূর্ণ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
(3) সপ্তম ক্রুসেড (১২৪৮-১২৫৪ খ্রিস্টাব্দ)
১২৪৪ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম বাহিনী কর্তৃক জেরুজালেম দখলের সংবাদ ইউরোপে পৌঁছোনোমাত্র পোপ চতুর্থ ইনোসেন্ট (Pope Innocent IV) এবং ধর্মভীরু ফরাসিরাজ নবম লুই (Louis IX) অত্যন্ত মর্মাহত হন। এর কিছুকাল পরে (১২৪৮ খ্রিস্টাব্দ) নবম লুই [তিনি সেন্ট লুই (Saint Louis) নামে অধিক পরিচিত] বিশুদ্ধ ধর্মীয় প্রেরণা থেকে সপ্তম ক্রুসেডে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন। সপ্তম ক্রুসেডে নেতৃত্বদানের জন্য এই ক্রুসেড নবম লুই-এর ক্রুসেড (Crusade of Louis IX) নামেও পরিচিত। সপ্তম ক্রুসেডের জন্য কোনও বিশেষ প্রচার বা প্রস্তুতি ছিল না। শেষপর্যন্ত নবম লুই মুসলিম বাহিনীর কাছে পরাজিত ও বন্দি হন। জেরুজালেমের উপর মুসলিম কর্তৃত্ব বজায় থাকে।
(4) অষ্টম ক্রুসেড (১২৭০ খ্রিস্টাব্দ)
১২৭০ খ্রিস্টাব্দে নবম লুই আবার ফরাসি বাহিনী-সহ জলপথে অভিযান পরিচালনায় উদ্যোগী হন। এবার তিনি মিশরের বদলে টিউনিশিয়া (Tunisia) আক্রমণ করেন। কিন্তু রোগ, ব্যাধি, মরুভূমির তাপে তাঁর বাহিনী ধ্বংস হয়ে যায়। সম্রাট নবম লুইও টিউনিশিয়ায় অসুস্থ হয়ে মারা যান। লুইয়ের মৃত্যুর পর তাঁর বাহিনীর অবশিষ্ট অংশ স্বদেশে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। জেরুজালেম মুসলিম অধিকারেই থেকে যায়। অষ্টম ক্রুসেডের অবসানের পরেও দুপক্ষের মধ্যে আরও ছোটো-বড়ো বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ চলেছিল- ১২৯১ খ্রিস্টাব্দের পর যার অবসান ঘটে। এই সময় থেকে জেরুজালেমে খ্রিস্টানদের বা ল্যাটিন রাজ্যের অস্তিত্বের লেশমাত্র অবশিষ্ট ছিল না।
আরও পড়ুন –
১। সামন্ততন্ত্র বলতে কী বোঝায়?
২। ইউরোপের সামন্ততন্ত্রের বৈশিষ্ট্যগুলি কী ছিল?
৩। ‘ফিফ’ ও ‘শিভালরি বলতে কী বোঝো?
৪। সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার পতনের কারণ সম্পর্কে লেখো।
৫। ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের ইতিবাচক প্রভাবগুলি কী ছিল?
৬। ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের নেতিবাচক প্রভাবগুলি কী ছিল?
৭। পোপতন্ত্রের বিকাশের কারণগুলি লেখো।
৮। ইউরোপে মধ্যযুগকে ‘অন্ধকার যুগ (Dark Age) বলা কতটা যুক্তিসঙ্গত?
১০। সেন্ট বেনেডিক্ট-এর সংস্কারসমূহ সম্পর্কে লেখো।
১২। টীকা লেখো- ক্লুনির সংস্কার আন্দোলন।
১৩। ওয়ার্মস-এর চুক্তির তাৎপর্য লেখো।
১৪। ক্রুসেড’ কী?
১৫। ক্রুসেডের ধর্মীয় কারণ আলোচনা করো।
১৬। ক্রুসেড সংগঠনে খ্রিস্টান চার্চের ভূমিকা কী ছিল?
১৭। ক্রুসেডের অর্থনৈতিক কারণ আলোচনা করো।
১৮। ক্রুসেডের সামাজিক কারণ আলোচনা করো।
১৯। সামন্ততান্ত্রিক শোষণ ক্রুসেডের অন্যতম কারণ ছিল- ব্যাখ্যা করো।
২০। সাধারণ মানুষ কেন দলে দলে ক্রুসেডে যোগ দিয়েছিল।
২১। ক্রুসেডের প্রত্যক্ষ কারণ উল্লেখ করো।
২২। টীকা লেখো – প্রথম ক্রুসেড।
২৩। টীকা লেখো – দ্বিতীয় ক্রুসেড।