ন্যায়ের বিভিন্ন রূপ ব্যাখ্যা করো

ন্যায়ের বিভিন্ন রূপ ব্যাখ্যা করো

ন্যায়ের বিভিন্ন রূপ ব্যাখ্যা করো
ন্যায়ের বিভিন্ন রূপ ব্যাখ্যা করো

ন্যায়ের বিভিন্ন রূপ

প্রাচীন গ্রিসে দার্শনিকদের রচনায় প্রথম ন্যায়ের ধারণার সন্ধান পাওয়া যায়। প্লেটোর ‘The Republic’ গ্রন্থে ন্যায়ের উল্লেখ রয়েছে। আধ্যাত্মিক বা অধিবিদ্যামূলক দৃষ্টিকোণ থেকে প্লেটো ন্যায়বিচারকে ব্যাখ্যা করেছেন। রোমান আইনবিদরা রাষ্ট্রীয় আইনকে চূড়ান্ত ন্যায়ের অংশ বলে মনে করতেন। গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণার বিকাশের ফলে ন্যায়-সম্পর্কিত ধারণার বদল ঘটেছে। আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজে ন্যায়ের ধারণা ব্যক্তিজীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে ব্যাপ্তি লাভ করেছে। তবে কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে ন্যায়ের রূপ খুব স্পষ্ট। সেইসব ক্ষেত্র অনুযায়ী ন্যায়কে চার ভাগে ভাগ করা হয়, যেমন- [1] সামাজিক, [2] রাজনৈতিক, [3] অর্থনৈতিক এবং [4] আইনগত ন্যায়।

[1] সামাজিক ন্যায়: সামাজিক ন্যায়ের ধারণা অনুসারে, জনগণের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণসাধনের উদ্দেশ্যে একটি ন্যায়সংগত সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। সামাজিক ন্যায়ের মাধ্যমে ব্যক্তিমানুষের স্বার্থের সঙ্গে সর্বসাধারণের স্বার্থের সমন্বয় ঘটানোর চেষ্টা করা হয়। প্রতিটি সমাজব্যবস্থাতেই ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের পূর্ণাঙ্গ বিকাশের জন্য ন্যূনতম সামাজিক সুযোগসুবিধার মধ্যে সংগতিবিধান করা প্রয়োজন। এই ধরনের সুযোগসুবিধা উপভোগের ক্ষেত্রে সমস্ত মানুষের সমান অধিকারের কথা সামাজিক ন্যায়ে বলা হয়। বস্তুত সামাজিক সাম্যের সঙ্গে সামাজিক ন্যায়ের ধারণাটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এ কথা অনস্বীকার্য যে, বৈষম্যমূলক সমাজে কখনও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে আইনের দৃষ্টিতে সাম্য, আইনের দ্বারা সমভাবে সংরক্ষণ, বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতা প্রভৃতি ধারণা সামাজিক ন্যায়ের অন্তর্ভুক্ত।

[2] রাজনৈতিক ন্যায়: রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, রাজনৈতিক ন্যায়ের একটি স্বতন্ত্র গুরুত্ব রয়েছে। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের মানবাধিকার-সংক্রান্ত ঘোষণায় (1948 খ্রিস্টাব্দ) রাজনৈতিক ন্যায় ও সাম্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সাধারণভাবে রাজনৈতিক ন্যায় বলতে দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় জনগণের সার্বিক অংশগ্রহণকে বোঝায়। এক্ষেত্রে দৃষ্টান্তস্বরূপ সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের কথা উল্লেখ করা যায়। উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে রাজনৈতিক ন্যায়ের অর্থ হল নির্বাচিত করা ও নির্বাচিত হওয়ার অধিকারের সমতা, সরকারি পদ ও সরকারি চাকরি লাভের ক্ষেত্রে সমতা প্রভৃতি। রাজনৈতিক ন্যায়ের ধারণা অনুযায়ী রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস হল জনগণ। রাজনৈতিক ন্যায় জনগণের সার্বভৌমিকতার তত্ত্বকে তুলে ধরে। রাজনৈতিক ন্যায় রাষ্ট্রের মধ্যে রাজনৈতিক সাম্যের আদর্শকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়।

[3] অর্থনৈতিক ন্যায়: সামাজিক ন্যায়ের মতো অর্থনৈতিক ন্যায়ও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। অর্থনৈতিক ন্যায় ছাড়া সামাজিক ন্যায়প্রতিষ্ঠা অর্থহীন। * অর্থনৈতিক ন্যায়ের ধারণা প্রসঙ্গে মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি এবং উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিস্তর প্রভেদ রয়েছে। উদারনীতিবিদরা অর্থনৈতিক ন্যায় বলতে রাষ্ট্র কর্তৃক জনকল্যাণমূলক কার্যক্রম রূপায়ণ, গতিশীল কর-ব্যবস্থার মাধ্যমে ধনবৈষম্য হ্রাস, উন্মুক্ত বাজার অর্থনীতি, অবাধ প্রতিযোগিতা প্রভৃতিকে বুঝিয়েছেন। অন্যদিকে, মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে, অর্থনৈতিক ন্যায় বলতে সমস্ত রকম ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও মালিকানার বিলোপ ঘটিয়ে উৎপাদনের উপকরণের ওপর সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠাকে বোঝায়। অর্থাৎ অর্থনৈতিক ন্যায় প্রসঙ্গে মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি কায়েমের কথা বলা হয়। মার্কসের মতে, শ্রেণিহীন ও শোষণহীন সমাজ ছাড়া অর্থনৈতিক ন্যায় সম্ভব নয়।

[4] আইনগত ন্যায়: আইনগত ন্যায় দেশের আইন প্রণয়নের কাঠামো ও বিচারব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত। আইনগত ন্যায়ের ধারণা অনুসারে, দেশের জন্য যুক্তিসংগত আইন প্রণয়নের প্রয়োজন। অযৌক্তিক আইন প্রণীত হলে তা দেশের আইনগত ন্যায়ের পক্ষে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এ ছাড়া আইনগত ন্যায় অনুযায়ী সকলের জন্য সমান আইন প্রণয়ন করা উচিত। আইনের দ্বারা সমভাবে সংরক্ষিত হওয়ার অধিকার প্রতিটি নাগরিকের থাকবে। আইনগত ন্যায়ের ধারণা অনুসারে আইন প্রণয়ন পদ্ধতি ন্যায়সংগত হওয়া প্রয়োজন। অন্যায়, অযৌক্তিক বা জনবিরোধী আইন প্রণীত হলে জনগণ তার প্রতিবাদ করবে। আইনগত ন্যায় একটি স্বাধীন, নির্ভীক ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা বলে। আইনসভা কর্তৃক প্রণীত আইনের যৌক্তিকতা বিচার করার জন্য বিচার বিভাগের হাতে বিচারবিভাগীয় সমীক্ষার ক্ষমতা থাকা প্রয়োজন। আইনগত ন্যায় অনুযায়ী, আইনের অনুশাসন দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় একান্ত অপরিহার্য।

আরও পড়ুন – রাজনৈতিক তত্ত্বের মূল ধারণাসমূহ ২ নম্বরের প্রশ্ন ও উত্তর

একাদশ শ্রেণির কলা বিভাগের যে কোনো প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন। কোনো উত্তর না পেলে আমাদের কমেন্ট বক্সে জানান।

Leave a Comment