নৈতিক মতবাদরূপে কর্তব্যবাদের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও
নৈতিক মতবাদরূপে কর্তব্যবাদ
ফলমুখী তথা উদ্দেশ্যমুখী নৈতিক মতবাদের একটি বিপরীত মতবাদরূপে ওঠে এসেছে কর্তব্যমুখী নৈতিক মতবাদ তথা কর্তব্যবাদ (Deontology)। ফলমুখী নৈতিক মতবাদে উল্লেখ করা হয়েছে যে, কর্ম বা কর্মনীতির নিজস্ব কোনো মূল্য নেই, তা হল পরত। স্বাভাবিকভাবেই তাই উল্লেখ করা যায় যে, এর বিপরীত মতবাদরূপে কর্তব্যবাদ অনুযায়ী দাবি করা হয় যে, কর্ম বা কর্মনীতির মূল্য হল স্বতঃ। অর্থাৎ বলা যায় যে, কর্তব্যবাদ অনুসারে কর্ম বা তার নীতিকে স্বতঃভাবে মূল্যবান বলা হয়।
কর্তব্যবাদ অনুসারে তাই দাবি করা হয় যে-কোনো কর্ম বা কর্মনীতিকে ‘যথোচিত’ বা ‘ঠিক’ বলা যায় যদি এবং কেবল যদি ওই কর্ম বা কর্মনীতিটি স্বতঃভাবে মূল্যবান হয়। এরূপ মতবাদে তাই কর্ম বা কর্মনীতিকে তার স্বতঃ বা নিজস্ব মূল্যের জন্যই যথার্থরূপে গণ্য করা হয়। এরূপ কর্ম বা কর্মনীতির কোনো পরতঃমূল্য নেই। কর্তব্যবাদীরা তাই দাবি করেন যে, উদ্দেশ্যবাদীদের অভিমতটি কখনোই গ্রহণীয় হতে পারে না। তাঁরা তাই উদ্দেশ্যবাদীদের দাবিকে অস্বীকার করেছেন এবং বলেছেন যে, ব্যক্তি বা সমাজের জন্য অকল্যাণের তুলনায় বেশি কল্যাণসাধন বা হিত উৎপাদন কখনোই নৈতিক আদর্শরূপে গণ্য হতে পারে না। অর্থাৎ এরূপ বিষয়টি কখনোই নৈতিকতা নির্ধারক মানদন্ডরূপে গণ্য হতে পারে না।
কর্তব্যবাদের অর্থগত বিশ্লেষণ
কর্তব্যবাদের ইংরেজি প্রতিশব্দ হল Deontology এবং এই শব্দটি গ্রিক Deon শব্দটি থেকে উদ্ভূত হয়েছে। এই Deon শব্দটির অর্থ হল-কর্তব্য। স্বাভাবিকভাবেই বলা যায় যে, Deonotology শব্দটির অর্থ হল-কর্তব্যমুখী বা কর্তব্যনির্ভর মতবাদ। কর্তব্যবাদ অনুসারে তাই দাবি করা যায় যে, কর্তব্য-এর যেহেতু একটা নিজস্ব মূল্য বা স্বতঃমূল্য আছে, যেহেতু তা স্বতঃভাবেই ভালো অথবা যথোচিতরূপে গণ্য হতে পারে। এর জন্য কোনো কর্ম বা কর্মনীতির ফলের ওপর নির্ভর করতে হয় না। কর্তব্যবাদীরা তাই দাবি করেন যে, এমন কিছু কর্ম বা কর্মনীতির সাক্ষাৎ পাওয়া যায়, যেগুলি যথোচিত বা ঠিকরূপে গণ্য, অথচ সেগুলি অমঙ্গল অপেক্ষা বেশি মঙ্গল-এর উৎপাদন করে না।
উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় যে, প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাকে রক্ষা করার বিষয়। প্রতিশ্রুতি দিয়ে সেই প্রতিশ্রুতিকে রক্ষা করতে গিয়ে যদি সমাজের অকল্যাণ অপেক্ষা বেশি কল্যাণসাধন নাও হয়, তথাপি বলা সংগত যে, এরূপ কর্মটি তার স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের জন্যই যথোচিতরূপে গণ্য। অর্থাৎ, বলা যায় যে, সৎকর্ম বা সৎকর্মনীতি স্বতঃভাবেই সৎ বা ভালোরূপে গণ্য। এরূপ বিষয়টির প্রতিপাদনের জন্য কোনো ফলাফলের ওপর নির্ভর করতে হয় না।
কর্তব্যের জন্য কর্তব্যসাধনে সৎকর্ম
আবার বলা যায় যে, কর্ম বা কর্মনীতির সততা যদি তার উদ্দেশ্য বা ফলাফলের ওপর নির্ভরশীল হয়, তাহলে অনেক সময় অনুচিত কর্ম বা কর্মনীতিকেও উচিত বা ন্যায়সম্মতরূপে গণ্য করতে হয়। যেমন-লুণ্ঠন করা অর্থের সাহায্যে দরিদ্র মানুষের সেবা করাকেও ন্যায়সম্মত বা যথোচিতরূপে গণ্য করতে হয়। কিন্তু তা কখনোই সম্ভব নয়। সে কারণেই বলা যায় যে, সৎকর্ম বা কর্মনীতিকে নিজগুণেই সৎ হতে হয়। আর সে কারণেই কর্তব্যবাদীরা কর্তব্যের জন্য কর্তব্যসাধন-কেই সৎ কর্ম বা সৎ কর্মনীতিরূপে উল্লেখ করেছেন।
দ্বিবিধরূপে কর্তব্যবাদ
নীতিবিজ্ঞানী ফ্রাঙ্কেনা (Frankena) তাঁর ‘Ethics’ নামক গ্রন্থে কর্তব্যের দুটি রূপের উল্লেখ করেছেন। কর্তব্যবাদের এই দুটি রূপের একটি হল-(i) কর্ম- কর্তব্যবাদ (Act-Deontological Theory) এবং অপরটি হল (ii) নিয়ম বা নীতি-কর্তব্যবাদ (Rule-Deontological Theory)। কর্ম-কর্তব্যবাদ অনুসারে দাবি করা হয় যে, সার্বিক নৈতিক নিয়ম বলে প্রকৃতপক্ষে কিছু নেই। আবার যদি তা থাকেও, তার কোনো প্রয়োগই দেখা যায় না। নৈতিকতার ক্ষেত্রে তাই বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতি অনুসারে আমাদের কর্মের নৈতিক বিচার করতে হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের চিন্তা করতে হয় যে, এই পরিস্থিতিতে আমাদের ঠিক কী করা উচিত। কর্ম-কর্তব্যবাদ তাই পরিস্থিতিমূলক নৈতিকতার (Situation Ethics) বিষয়টিকে উন্মোচিত করে। অপরদিকে, নিয়ম বা নীতি-কর্তব্যবাদ অনুসারে দাবি করা যায় যে, নৈতিক নিয়মগুলি হল সর্বজনীন এবং তা সমস্তক্ষেত্রেই একই সার্বিক নৈতিক নিয়মকে অনুসরণ করে।
আরও পড়ুন – ফলমুখী বা উদ্দেশ্যমুখী নৈতিক মতবাদের বিষয়টিকে সংক্ষেপে উল্লেখ করো
2 thoughts on “নৈতিক মতবাদরূপে কর্তব্যবাদের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও”