নেপালে বিধ্বংসী ভূমিকম্প প্রবন্ধ রচনা – আজকের পর্বে নেপালে বিধ্বংসী ভূমিকম্প প্রবন্ধ রচনা আলোচনা করা হল।
নেপালে বিধ্বংসী ভূমিকম্প প্রবন্ধ রচনা
নেপালে বিধ্বংসী ভূমিকম্প
ভূমিকা
সূর্য থেকে সৃষ্টি হয়েছে পৃথিবী। তাই সৃষ্টির প্রথম লগ্নে পৃথিবী ছিল জ্বলন্ত অগ্নিপিন্ড। পৃথিবী শীতল হতে হতে তার বাইরের অংশে পাথরের আস্তরণ সৃষ্টি হয় যেমন দুধ ঠান্ডা হলে সর পড়ে। কিন্তু তার অভ্যন্তরে আছে এখন ও জলন্ত লাভা। বাইরের চাপ ও ভেতরের তাপে সেই প্রস্তরের আবরণ বিশাল বিশাল খন্ডে ভেঙে কয়েকটি টুকরোর সৃষ্টি হয়। এক একটি খন্ড মহাদেশের ও বড়ো। এই খন্ডকে বলা হয় প্লেট। গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল (খ্রিস্টপূর্ব ৩৮৪-৩২২) বলেছিলেন, ভু- অভ্যন্তরে জমে থাকা গ্যাস বেরিয়ে আসার জন্য শিলাস্তরে বার বার আঘাত করলে ভূমিকম্প হয়।
ভূমিকম্পের প্রকৃত কারণ
আধুনিক ভূ-বিজ্ঞানীরা পরিক্ষার মাধ্যমে ভূমিকম্পের যে তিনটি কারণ জানতে পেরেছেন তা হল- ভূ-পৃষ্ঠজনিত, আগ্নেয়গিরিজনিত ও শিলাচ্যুতি জনিত। পাহাড়ি অঞ্চলে যখন ধস নামে তখন ভূ-পৃষ্ঠজনিত ভূমিকম্প সৃষ্টি হয়। আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের সময় বিপুল পরিমান শক্তি নির্গত হওয়ার ফলে ভূকম্পনের সৃষ্টি হয়। সবচেয়ে বেশী ব্যাপকতা সৃষ্টি হয় শিলাচ্যুতি জনিত ভূমম্পনের জন্য। পৃথিবীর অভ্যন্তরে রয়েছে গলিত লাভা। তার ওপর যে ভেসে আছে ভূত্বকের শিলাস্তর যা বিভিন্ন ধরণের চাপে শিলা স্তূপের একটি অংশ বিপরীত দিকে নড়াচড়া করতে থাকলে শিলাস্তূপের দেওয়ালে বিপুল বেগে আঘাত সৃষ্টি হতে থাকে ও শিলাস্তর ভেঙে পড়ে। একে বলে ফল্ট বা বিচ্যুতির ফলে ভূমিকম্প।
নেপালে ভূমিকম্প
ভারতের উত্তরে প্রতিবেশী দেশ নেপাল। মধ্য হিমালয়ের অন্তগর্ত নেপাল ২৬-২০ উত্তরে ৩০-১০ উত্তর অক্ষাংশে এবং ৮০-১৫ পূর্ব দ্রাঘিমার মধ্যে অবস্থিত। নেপালের উত্তর রয়েছে চিন এবং পূর্ব পশ্চিম ও দক্ষিণে রয়েছে ভারতের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য। ১৯৩৪ সালের দুপুরে নেপাল কেঁপে উঠেছিল এক ধ্বিংসী ভূমিকম্পে। রিকটার স্কেলে তার মাত্রা ছিল ৮.১। নেপাল নেপাল বিহার মিলিয়ে মারা গেছলেন কয়েক হাজার মানুষ। ২০১৫ সালের ২৫ এপ্রিল বিধ্বংসী ভূমিকম্পে আবার কেঁপে উঠল শুধু নেপাল নয়, পার্শ্ববর্তী অঞ্চল এবং সন্নিহিত রাষ্ট্র ও ভারতীয় সময় বেলা ১১টা ৪১ মিনিটে।
এই ভূমিকম্পের উৎসস্থল ছিল পোখরার লোফজাঙে যার রিকটার স্কেলে মাত্রা ছিল ৭.৯। মূল ভূমিকম্পের পরে বার বার আফটার শকে কাঁপতে থাকে নেপাল ও অন্যান্য অঞ্চল। এদিনের ভূমিকম্পে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নেপালের রাজধানী কাঠমুন্ডু সহ নেপালের বহুএলাকা। ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, চিনের, তিব্বত, পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরবঙ্গ, ওড়িশা, মুম্বাই, বিহার, প্রভৃতি স্থানে। ভূবিজ্ঞানীদের মতে হিমালয় পর্বতমালার নীচে ভারতীয় ও ইউরোপীয় প্লেট আছে। সেই প্লেটের ঠোকাঠুকিতে মাঝে মধ্যেই ভূমিকম্প হয়। তারমধ্যে কয়েকটি অঞ্চল ভূকম্পপ্রবন বলে চিহ্নিত। এদিন দুই প্লেটের সংঘাতে কেঁপে উঠেছিল পোখরা উপত্যকা।
নেপালে বিধ্বংসী ভূকম্পের উৎসস্থল ছিল মাটির এগারো কিলোমিটার নীচে। ভূকম্পের কেন্দ্রস্থল অগভীর হওয়ায় কম্পনের তীব্রতা ছিল অনেক বেশী এই ভূমিকম্পে শুধু ভারতবর্ষে অনেক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। কাঠমুন্ডুতে ইউনেস্কো স্বীকৃত ‘ওয়াল্ড হেরিটেজসাইট’ দরবার স্কোয়ার পুরো ধ্বংস হয়ে গেছে। ভেঙে গিয়েছে দুশো বছরের পুরানো ধলহরা মিনার। তবে পশুপতিনাথ মন্দিরের তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। উত্তরপ্রদেশ, উত্তরবঙ্গ, বিহারে অনেকে মৃত্যু মুখে পতিত হয়েছেন, ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়েছে। পোখরান লাফোজঙের অবস্থান কাঠমুন্ডু থেকে সত্তর কিলোমির দূরে। ভূগর্ভস্থ প্লেটগুলির ওপর যে মহাদেশ ও সাগর গুলি আছে তাদের সংযোগস্থলে কম্পনের মাত্রা বেশী।
ভূবিজ্ঞানীদের মতে ভারতীয় প্লেটটি ঢুকে যায় ইউরোপীয় প্লেটের নীচে। সেই প্রক্রিয়ায় যে বিপুল পরিমান শক্তি নির্গত হয় তার থেকে কেঁপে উঠে কাঠমুন্ডু থেকে দিল্লি এবং অন্যন্য অঞ্চল। কম্পন কোথাও স্থায়ী হয় এক মিনিট, কোথাও বা দুমিনিট, দুটি প্লেটের স্থান পরিবর্তনের ফলে যে শক্তি নির্গত হয় তা পারমানু বোমার থেকেও বেশী ছিল বিধ্বংসী। প্রথম দিনেই যোলবার আফটার শক হয়। পরপর দুদিন ভূকম্প কেন্দ্রীভূত হয়েছিল নেপালে, তৃতীয়দিন নেপাল ভারত সীমান্তে মিরিকের কোল ঘেঁষে। পাকিস্থানের খাইবার পাশে হিন্দু কুশ পাহাড়ে ও তৃতীয় ভূকম্পন অনুভূত হয়।
ভারতীয় ভূ পদার্থবিদদের মতে গত বেশ কয়েক বছর ধরে সমস্ত হিমালয় এলাকায় ভূগর্ভের স্থিতিশীলতা ধাক্কা খাচ্ছে। ফলে ভারতের টেকনোটিক প্লেট ও ইউরোপীয় প্লেটের জোড়ে বিভিন্ন ছোটো বড় চ্যুতি ও খোঁচে জমেছে অতিরিক্ত শক্তি। ভূবিজ্ঞানীদের মতে আফটারশক হয়েছে কমকরে পাঁচাত্তর বার। তাঁদের আরও অভিমত, এরফলে খোঁচ চ্যুতিতে নাড়া পড়ছে এবং সেখানের শক্তি বাইরে বেরিয়ে এসেছে। যারজন্য খোঁচগুলি স্থিতিশীল হবে।
ভূকম্প প্রভৃতি বিপর্যয়ে ছাত্র সমাজের কর্তব্য
যেকোনো সময় কোথাও কোনো কারণে বিপর্যয় ঘটলে ছাত্র ছাত্রীরা ও চুপকরে বাড়িতে বসে থাকতে পারেন না। তাঁদের ও নৈতিক দায়িত্ব আছে বিপন্ন মানুষ এর পাশে দাঁড়ানোর, যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় বাস করেন তাঁদের এগিয়ে আসতে হবে বিপন্ন মানুষের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে। যাঁরা দূরে আছেন তাঁদের ও ভাবতে হবে কি ভাবে তাঁদের সাহায্য করা যায়। যেমন আমার স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকাদের সাথে সমস্ত ছাত্র ছাত্রী বিভিন্ন ভাবে খাদ্য অর্থ প্রভৃতি সংগ্রহ করার উদ্যোগ নিয়েছিল।
যেভাবে নেপালে অজস্র মানুষ অসহায় হয়ে খোলা আকাশের তলায় আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাঁদের কাছে আমাদের এই সাহায্য হয়তো সামান্য। কিন্তু সংগৃহীত অর্থ, খাদ্য, প্রভৃতি পাঠানোর ব্যবস্থা করে বোঝাতে চেয়েছি যে তাঁদের বিপদে আমরা ও সমব্যাথী এবং এই বিপদের সময় আমরা রয়েছি তাঁদের সঙ্গে। শুধু বন্ধুদেশ ভারতবর্ষ নয় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ, বিভিন্ন সমাজসেবী প্রতিষ্ঠান, সহৃদয় ব্যাক্তি অসহায় মানুষের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন যা বিশ্ব মানবতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
ভূকম্প এর সংকেত
ভূ-বিজ্ঞানীদের মতে শিলাস্তরের যে বিশেষ স্থান থেকে কম্পন সৃষ্টি হয় তাকে বলা হয় ফোকাস বা কেন্দ্র। ফোকাস বরাবর ভূ-পৃষ্ঠের স্থানকে বলা হয় এপিস্টোর বা উপকেন্দ্র। তাঁরা তিন ধরণের তরঙ্গের কথা বলেছেন- প্রাইমারি বা পি ওয়েভ তরঙ্গ যা পৃথিবী পৃষ্ঠে সবার আগে পৌঁছায়। এরপরে সেকেন্ডারী বা এস ওয়েভ এবং সবশেষে পৌঁছায় লংওয়েভ বা দীর্ঘ তরঙ্গ। ভূমিকম্প সম্বন্ধে প্রথম গবেষণা করেন চিন (৭৮ খ্রিঃ-১৩৯ খ্রিঃ)। ২
০০৪ সালের ২৬ শে ডিসেম্বর ভূকম্পনের ফলে সুনামী সৃষ্টি হয়েছিল, ইন্দোনেশিয়ায় সুনামী ওয়ানিং সিস্টেম আছে। কয়েকটি দেশ এই নেটওয়ার্কের অন্তর্ভুক্ত। তবে আজও বিজ্ঞান যে সংকেত দিতে পারেনি তা ভূমিকম্প হওয়ার কয়েকদিন বা কয়েক ঘণ্টা আগে বেশ কিছু জীব জন্তুর আচরণের পরিবর্তন দেখা গেছে। যেমন টোকিওর পূর্বদিকের কয়েকটি অঞ্চলে ভূমিকম্পের সাত দিন আগে১৮৫৫ সালে হাঁস, মুরগী, ডিম পাড়া বন্ধ করে দিয়েছিল। ১৮৫৭ সালে ভূমিকম্পের কয়েকদিন আগে ইতালির জেনোয়া শহরে সমস্ত পায়রা উধাও হয়ে গেছল। সরীসৃপের মধ্যে ও ভূকম্পনের পূর্বাভাস অনুভব করার ক্ষমতা আছে, বিজ্ঞানীরা দেখেছেন ভূমিকম্পের আগে তাদের দল বেঁধে গর্তের বাইরে বেরিয়ে আসতে।
উপসংহার
ভূমিকম্পের প্রতিরোধের ক্ষমতা মানুষের নেই। এরুপ বিপর্যয় যে কোন সময় ঘটতে পারে। দেশের বিপর্যয় মোকাবিলা বিভাগকে সর্তক থাকতে হবে যে ভূমিকম্পের মতো কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটলে দ্রুত বিপর্যস্ত অঞ্চলের মানুষের কাছে গিয়ে যাতে তাঁদের উদ্ধার প্রভৃতি করা সম্ভব হয়।
আরও পড়ুন – মিড-ডে মিলের প্রয়োজনীয়তা প্রবন্ধ রচনা