নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জাতীয়তাবাদ সম্পর্কিত ধারণা আলোচনা করো
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জাতীয়তাবাদ সম্পর্কিত ধারণা
নেতাজির মধ্যে ছাত্রজীবনে যে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল, পরবর্তীকালে কর্মজীবনে তা রূপান্তরিত হয় সংগ্রামী জাতীয়তাবাদে। সারা জীবনজুড়ে নেতাজির ধ্যান-জ্ঞান ছিল একটাই, তা হল পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্তি। জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে তাঁর অভিমত উঠে এসেছিল কলকাতায় দেওয়া এক বক্তৃতায়। তিনি বলেছিলেন, “পরাধীন দেশে যদি কোনো ‘ism’ (মতবাদ) সর্বান্তকরণে গ্রহণ করতে হয়, তবে তা হল ‘Nationalism’ (জাতীয়তাবাদ)”। নেতাজির জাতীয়তাবাদের উল্লেখযোগ্য দিকগুলি হল-
[1] অতীত ঐতিহ্যের গৌরবানুভূতি: নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জাতীয়তাবাদের প্রধান একটি উপাদান হল অতীত ঐতিহ্যের গৌরবের অনুভূতি। নেতাজি উপলব্ধি করেছিলেন, ব্রিটিশ শাসিত ভারতে ভারতবাসীরা নিজেদের গৌরবোজ্জ্বল অতীত ঐতিহ্যের কথা ভুলতে বসেছে। তিনি বলতেন, “এই বিস্মৃতি আমাদের অধঃপতনের মূল।” এজন্য নেতাজি চেয়েছিলেন অতীত ঐতিহ্যের পুনর্জাগরণ। নেতাজি বিশ্বাস করতেন, অতীত ঐতিহ্যের গৌরবের অনুভূতি ভারতীয়দের আত্মশক্তিতে বিশ্বাসী করে তুলবে। এই আত্মবিশ্বাস পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্তি দিতে সাহায্য করবে।
[2] হীনমন্যতাবোধের বিলুপ্তি: সুভাষচন্দ্রের জাতীয়তাবাদী ধ্যানধারণায় হীনমন্যতাবোধের কোনো স্থান ছিল না। বেশিরভাগ ভারতীয়দের মনে এই ধারণা বদ্ধমূল ছিল যে, ‘ইউরোপীয় জাতিগুলি অধিকতর উন্নত’। এই হীনমন্যতাবোধের ফলে দীর্ঘদিন যাবৎ ভারতীয়দের পরাধীনতার গ্লানি সহ্য করতে হয়েছে। সবার আগে এই হীনমন্যতাবোধ কাটিয়ে ওঠার বিষয়টিকে জাতীয়তাবাদ গড়ে তোলার একটি বড়ো কাজ বলে নেতাজি মনে করতেন।
[3] জাতীয় ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ: ভারতের জাতীয় ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নেতাজির জাতীয়তাবাদের অন্যতম একটি দিক। ভারতীয়রা যে এক সুমহান ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী এ কথা বারে বারে মনে করিয়ে দিয়েছেন সুভাষচন্দ্র। তাঁর লেখা ‘The Indian Struggle’ গ্রন্থে নেতাজি সেই সুমহান ঐতিহ্যের পরিচয় দিতে গিয়ে জানিয়েছেন, “ভারতীয় জাতি একাধিকবার মরেছে-কিন্তু মৃত্যুর পর পুনর্জীবন লাভ করেছে। তার কারণ এই যে, ভারতের অস্তিত্বের সার্থকতা ছিল এবং এখনও আছে। ভারতের একটা বাণী আছে যেটা জগৎসভায় শোনাতে হবে। ভারতের শিক্ষার মধ্যে এমন কিছু আছে যা বিশ্বমানবের পক্ষে অতি প্রয়োজনীয় এবং যা গ্রহণ না করলে বিশ্বসভ্যতার প্রকৃত উন্মেষ হবে না।”
[4] অদম্য ও অপ্রতিহত জাতীয়তাবোধ: নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের মনে এক অদম্য ও অপ্রতিহত জাতীয়বোধ সঞ্চারিত করেছিলেন। জার্মানিতে গিয়ে তিনি যে আজাদ হিন্দ বাহিনী ও আজাদ হিন্দ সরকার গঠন করেছিলেন, তা তাঁর জ্বলন্ড জাতীয়তাবাদী চেতনার স্বাক্ষর বহন করে।
[5] প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ: নেতাজি সুভাষচন্দ্রের জাতীয়তাবাদ ছিল প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ। এই জাতীয়তাবাদের মধ্যে কোনো সম্প্রদায়গত সংকীর্ণতার স্থান ছিল না। প্রাদেশিকতার স্পর্শও তার মধ্যে পাওয়া যায় না। দেশবাসীর উদ্দেশ্যে তিনি সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে ওঠার যে আহ্বান জানিয়েছিলেন তার মূল কথা ছিল, আমাদের অতীতের দিকে তাকাতে হবে, তার মধ্যে হিন্দু-মুসলমানের কোনো ব্যাপার নেই, এ হল বহু সংস্কৃতির মিলনের ফল।
মন্তব্য: ভারতীয় জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে নেতাজির এক নিজস্ব ধারণা ছিল। তাঁর ‘The Indian Struggle’ গ্রন্থে এই ধারণার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে নেতাজি বলেছিলেন, “ভারতীয় জাতীয়তাবাদ সংকীর্ণ, স্বার্থপর ও আক্রমণাত্মক নয়। এই জাতীয়তাবাদ মানবজাতির সর্বোৎকৃষ্ট আদর্শ সত্যম শিবম্ ও সুন্দরমের দ্বারা অনুপ্রাণিত। ভারতীয় জাতীয়তাবাদ আমাদের মধ্যে সত্যবাদিতা, সততা, পৌরুষত্ব এবং সেবা ও ত্যাগের ভাবধারাকে সঞ্চারিত করেছে।”
আরও পড়ুন – রাজনৈতিক তত্ত্বের মূল ধারণাসমূহ ২ নম্বরের প্রশ্ন ও উত্তর