নিষ্কাম কর্মের সাধন কি আদৌ সম্ভব? সংক্ষেপে এই ধারণাটির মূল্যায়ন করো
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাকে অবলম্বন করে একাধিক চিন্তাবিদ এবং দার্শনিক তথা মনীষীগণ গবেষণাধর্মী বিশ্লেষণ করেছেন। এক্ষেত্রে কেউ কেউ নিষ্কাম কর্মতত্ত্ব বিষয়ে কিছু আপত্তি করে থাকেন।
প্রথমত অনেকের মতে নিষ্কাম কর্মের বিষয়টি মনোবিজ্ঞান এবং পাশ্চাত্য নীতিতত্ত্বের সাধারণ নিয়মের বিরোধী। নিষ্কাম কর্মানুযায়ী বলা যায় ফলের আকাঙ্ক্ষা না করেই মানুষকে কর্ম করতে হবে। কিন্তু মনোবিজ্ঞান এবং নীতিবিজ্ঞানের সাধারণ সূত্রে বলা হয়েছে যে, মানুষের প্রত্যেকটি কর্মের পশ্চাতে কোনো-না-কোনো উদ্দেশ্য নিহিত থাকে, যাকে কর্মপ্রেরণার উদ্দেশ্য বলা হয়। কাজেই নিষ্কাম কর্মে কোনো উদ্দেশ্য না থাকায় নিষ্কাম কর্মের তত্ত্বটি অর্থহীন, অসম্ভব এবং অবাস্তব প্রয়াসরূপে গণ্য।
দ্বিতীয়ত নিষ্কাম নীতিতত্ত্বে বলা হয়েছে যে ঈশ্বর হলেন আমাদের সকল প্রকার কর্মের নিয়ামক। আমরা কর্ম সম্পাদন করলেও কর্মফলের ওপর কোনো অধিকার আমাদের নেই। কিন্তু কর্ম করলে তার ফল তো থাকবেই।
কর্ম আছে, অথচ কর্মফল নেই- এই বিষয়টিকে যুক্তিবিজ্ঞানের দিক থেকে কখনোই সমর্থন করা যায় না।
তৃতীয়ত নিষ্কাম কর্মতত্ত্বে বলা হয় মানুষ কর্ম করে কিন্তু কর্ম করার পরিকল্পনা ঈশ্বরের, তিনি হলেন কর্ম-নিয়ামক। এখানে মানুষকে যেন ‘যন্ত্র’ এবং ঈশ্বরকে ‘যন্ত্রী’ রূপে বিবেচনা করা হয়েছে। কর্ম করবে মানুষ কিন্তু কর্মফল সমর্পিত হবে ঈশ্বরে। যদিও মানুষকে কখনোই যন্ত্রবৎ পর্যবেক্ষণ করা উচিত নয়, মানুষের স্বাধীন চিন্তাবৃত্তি আছে।
চতুর্থত আমাদের এই কর্মময় জগতে আমরা শুভের সঙ্গে অশুভের, মঙ্গলের সঙ্গে অমঙ্গলের, আনন্দের সঙ্গে নিরান্দের পর্যবেক্ষণ করি। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন ওঠে যে, জগতের সমস্ত কিছুই যদি ঈশ্বরের পরিকল্পনাপ্রসূত হয় তাহলে জগতের এরকম দৈন্যদশা আমরা দেখতে পাই কেন? এর কোনো সদুত্তর নিষ্কাম কর্মতত্ত্বে আমরা পাইনা।
পঞ্চমত নিষ্কাম কর্মের নীতিতত্ত্বে উল্লেখ আছে যে, কেবলমাত্র ‘স্থিতধী’ ব্যক্তিরাই শুধু নিষ্কামভাবে কর্মসম্পাদন করতে পারেন। ‘স্থিতধী ব্যক্তি’ অর্থাৎ যিনি সুখে আসক্ত নন, আবার দুঃখেও উদ্বিগ্ন নন, ভয়, ক্রোধ ইত্যাদি সকল রিপু থেকে তিনি মুক্ত, তিনি লাভ-অলাভের হিসেব করেন না। কিন্তু এইরকম স্থিতধী ব্যক্তি কি বাস্তবের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ? এমন ব্যক্তির দেখা মেলা বাস্তবে প্রায় অসম্ভব। তাই নিষ্কাম কর্মের কল্পনা এক অতিমাত্রিক কাল্পনিক মতবাদ ছাড়া আর কিছুই নয়।
পরিশেষে বলা যায়, নিষ্কাম কর্মের তত্ত্বটি এক দুরূহ আদর্শের কথা বলে। তবে এ কথাও ঠিক, উচ্চ আদর্শ বাস্তবায়িত করতে না পারলে তার মাহাত্ম্য ক্ষুণ্ণ হয় না। জাগতিক কর্ম এবং কর্মের আশানুরূপ ফল না লাভ করতে পারলে যে দুঃখ ও দুর্গতি সেগুলি পরিহারের জন্য মসৃণভাবে না হলেও অনাসক্তভাবে এবং ফলের আকাঙ্ক্ষা না করে আমাদের কর্ম সম্পাদনের অনুশীলন করতে হবে।
আরও পড়ুন – যুক্তিবিজ্ঞানের প্রকৃতি – অবরোহ এবং আরোহ