দ্বিজেন্দ্রলাল রায় প্রবন্ধ রচনা
ভূমিকা
কবি, নাট্যকার, গীতিকার, সুরকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের জন্ম কৃষ্ণনগরে ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দের ১৯শে জুলাই (৪ঠা শ্রাবণ ১২৭০ সাল)। পিতা কার্তিকেয়চন্দ্র রায় ও মাতা প্রসন্নময়ী দেবীর তিনি সপ্তম সন্তান ছিলেন।
শিল্পজীবন, সাহিত্যানুরাগ ও সঙ্গীত প্রতিভা
দ্বিজেন্দ্রলালের শিক্ষাজীবন শুরু কৃষ্ণনগর কলিজিয়েট স্কুল থেকে। সেখান থেকে তিনি ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পাশ করেন। এর পরে কৃষ্ণনগর কলেজ থেকে এফ. এ, হুগলি কলেজ থেকে বি.এ ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে, প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এম এ দ্বিতীয় বিভাগে ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে, এবং ১৮৮৪-৮৬ খ্রিস্টাব্দে বৃত্তি নিয়ে ইংল্যান্ডে সিসিস্টার কলেজ থেকে কৃষি বিদ্যায় উচ্চ শিক্ষা লাভ করেন। এরপরে এফ. আর. এস, এ. ই. এম আর এ. সি প্রভৃতি উপাধিলাভ করেন।
এই সময় তিনি পরিচিত হন পাশ্চাত্য সংগীতের সাথে। একইভাবে রবীন্দ্রনাথ তাঁর দাদাদের মধ্যে দ্বিতীয় সত্যেন্দ্রনাথের সাথে ২০ সেপ্টেম্বর ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে বিলেতে গেলেন আইন পড়তে এবং দেশে ফিরলেন পাশ্চাত্য সংগীত শিখে। পাশ্চাত্য সংগীতের ভাবধারায় তিনি লিখেন বাল্মীকির প্রতিভা নামে গীতি নাটক। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের নাটকেও পাশ্চাত্য সংগীতের প্রভাব দেখা যায়। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘আর্য গাথা’ (প্রথম ভাগ) প্রকাশিত হয় ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দের ৫ই মার্চ বিলেত যাত্রার আগে এবং বিলেত গিয়ে ইংরেজিতে লেখেন Lyrics of Ind নামক কাব্যগ্রন্থ।
বিলেতে দ্বিজেন্দ্রলালের সহপাঠী বঙ্গবাসী কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ গিরিশচন্দ্র বসু বলেছেন, “দ্বিজু একজন Embryo (কোরক) কবি-ইতিপূর্বে আর্যগাথা রচিয়া স্বদেশে কবিজগতে প্রবেশ লাভ করিয়াছেন।” তাঁর অন্যসব রচনা বিলেত থেকে ফিরে এসে শুরু করেন লিখতে।
দ্বিজেন্দ্রলালের পিতা কার্তিকেয় রায় ছিলেন কৃষ্ণনগরের রাজার দেওয়ান। তাঁর পরিবারে ছিল সংগীত চর্চার পরিবেশ। তাই দ্বিজেন্দ্রলালের সংগীতের প্রতি অনুরাগ ছেলেবেলা থেকে। রবীন্দ্রনাথ অজস্র গান রচনা করেছেন এবং সুরও দিয়েছেন যা রবীন্দ্রসংগীত নামে খ্যাত। দ্বিজেন্দ্রলালের ক্ষেত্রে ও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তিনিও রচনা করেছেন বহুগান, সুরও দিয়েছেন। বাংলা সংগীত জগতে দ্বিজেন্দ্রগীতি নতুন ধারার প্লাবন আনে।
চাকুরী জীবন
তিনি ছিলেন এক ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব। ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে ২৫শে ডিসেম্বর স্বদেশে ফিরে সরকারী চাকুরীতে যোগ দিয়ে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, ডেপুটি কালেকটরের দায়িত্ব পালন করলেও বার বার বিদেশী ইংরেজ-শাসন ও শোষণ তাঁকে বিদ্রোহী করে তুলে তাঁর স্বদেশপ্রেম, স্পষ্টবাদিতা ও নির্ভীকতা বিদেশী শাসককে অনেক সময় সন্ত্রস্ত করে তুলেছে। তাঁর সাতাশ বছর চাকুরী জীবনে তাঁকে প্রায় সতেরো বার বিভিন্ন প্রান্তে বদলি করে ও তাঁর মাথানত করতে পারেনি বিদেশী শাসক। বরঞ্চ যেখানে তিনি বদলি হয়ে গেছেন সেখানের মানুষের সুখ-দুঃখের অংশীদার হয়েছেন।
কুসংস্কার বিরোধী মানসিকতা ও সাহিত্য প্রতিভা
তিনি চেষ্টা করেছেন অস্পৃশতা, সমাজের গোঁড়ামির দেওয়াল ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ করতে। তিনি যখন স্বগৃহে বিলেত থেকে ফিরলেন তখন কালাপাণি পার হয়েছেন ব্রাহ্মণ সন্তান হয়ে এই অজুহাতে ব্রাহ্মণেরা প্রায়শ্চিত্ত করার ফতোয়া জারি করলেও তিনি তা অগ্রাহ্য করলেন। বিদ্যাসাগর ৪ অক্টোবর ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে লেজিসলেটিভ কাউন্সিল অব ইন্ডিয়ার কাছে বিধবা বিবাহ আইন প্রচলনের জন্য আবেদন করেন। Act xv of 1856 being on Act to remove all legal obstruck to the marriage of Hindu widows নামে বিধবা বিবাহ আইন পাশ হয় ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬ শে জুলাই।
তখনকার সময়ে বিধবা বিবাহকে সমাজের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি ভালো চোখে দেখেননি। দ্বিজেন্দ্রলাল যে তা সমর্থন করতেন না তার প্রমাণ পাওয়া যায়। ডঃ প্রতাপচন্দ্র মজুমদার বিধবা বিবাহ করলে সমাজে প্রায় একঘরে হয়ে পড়েন। দ্বিজেন্দ্রলাল সেই অবহেলিত বিধবার কন্যা সুরবালাদেবীকে বিবাহ করেন সমাজের অন্ধসংস্কারের বাধাকে অগ্রাহ্য করে শুধু তাই নয় সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিবাদ গর্জে উঠল ‘একঘরে’ রচনা প্রকাশ করে। (২ জানুয়ারি ১৮৮২ খ্রিঃ)। তিনি লিখলেন সমাজ বিভ্রাট ও কল্কি অবতার (১৮৯৫ খ্রিঃ), অষাঢ়ে (১৮৯৯ খ্রিঃ), পুনর্জন্ম (১৯১১ খ্রিঃ), আলেখ্য (১৯০৭ খ্রিঃ), ত্রিবেণী (১৯১২ খ্রিঃ) প্রভৃতি। হিন্দুধর্মের গোঁড়ামি, ভ্রান্ত ধারণাও সংস্কার, আচার-আচরণের বিরুদ্ধে তিনি কঠোর মনোভাবাপন্ন ছিলেন তার প্রমাণ, তাঁর বিদ্রূপাত্মক রচনা হাসির গান।
স্বদেশপ্রেম ও নাট্যপ্রতিভা
তিনি ভালোবাসতেন দেশকে, দেশের মাটিকে। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে প্রশাসনিক কারণে বড়লাট কার্জন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিকে দ্বিখন্ডিত করে দুটি প্রদেশ গড়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। ১৬ অক্টোবর বঙ্গভূমিকে দ্বিখন্ডিত করে যে দুটি প্রদেশ গঠন করা হয় তার পূর্বভাগে থাকে পূর্ববঙ্গ ও আসাম, রাজধানী হয় ঢাকা, অপরভাগে থাকে রাজশাহী, প্রেসিডেন্সি ও বর্ধমান বিভাগ, রাজধানী কলকাতা। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যয়ের নেতৃত্বে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন শুরু হয়।
রবীন্দ্রনাথ বাংলার মাটি বাংলার জল বাংলার বায়ু বাংলার মাটি পূণ্য হউক পূণ্য হউক হে ভগবান গান রচনা করে আন্দোলনে যোগ দেন। দ্বিজেন্দ্রলাল ও স্বদেশী আন্দোলনের উত্তপ্ত দিনগুলিতে শুধু স্বদেশি গান ও নাটক রচনা করেননি স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলনে যোগ দিলেন। তিনি ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ অক্টোবর অরন্ধন ও রাখিবন্ধনের দিনে সকালে এক দলের জন্য গান লিখলেন ও বিকেলে আন্দোলনকারীদের সাথে যোগ দিলেন জনগণকে গানের উন্মাদনায় দেশপ্রেমে মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করে।
‘বঙ্গ আমার জননী আমার, ধাত্রী আমার, আমার দেশ।’
‘তুমি কি মা সেই, তুমি কি মা সেই চিরগরিয়সী ধন্যা অয়ি মা।’
‘ধনধান্য পুষ্প ভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা’…।
‘একবার গাল ভরা মা-ডাকে, মা বলে ডাক, মা বলে ডাক, মা বলে ডাক।’
এরূপ গান রচনা করে দেশাত্মবোধক সংগীতের মাধ্যমে স্বদেশবাসীকে আহ্বান করলেন মাতৃমুক্তি আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে। তিনি দেশপ্রেম মন্ত্রে মানুষকে অনুপ্রাণিত করলেন রাণা প্রতাপ সিংহ (১৯০৫), দুর্গাদাস (১৯০৬), নূরজাহান (১৯০৮), মেবার পতন (১৯০৮), শাজাহান (১৯০৯), চন্দ্রগুপ্ত (১৯১১), সিংহল বিজয় (১৯১৫) প্রভৃতি নাটক লিখে চরিত্র চিত্রনে ও সংলাপে ইতিহাস কতটা গুরুত্ব পেয়েছে সে বিষয়ে সমালোচকগণ নানা মন্তব্য করতে পারেন, কিন্তু নাটকে যে দেশপ্রেমের গান রয়েছে তা মানুষের মনে যে স্বদেশপ্রেমের জোয়ার এনেছিল তা অসংশয়িত।
তাঁর নাটকের আর একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল আধ্যাত্মিকতা বর্জন পুরাণের চরিত্রগুলির বাস্তব রূপদান। গিরিশচন্দ্রের নাটকগুলিতে প্রচারিত হয়েছে কল্পিত দেব মাহাত্ম্য। দ্বিজেন্দ্রলাল বাস্তবে পরিক্ষিত সব ব্যক্তিত্বকে মহিমান্বিত করেছেন ভারতবর্ষের ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বগুলির মহিমায় নাটকে গুরুত্বসহকারে তুলে ধরার মাধ্যমে। তাঁর রচিত নাটকের চরিত্রগুলি চিত্রিত হয়েছে অসাম্প্রদায়িকতা ও মানবিকতা বোধের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রূপে। তিনি চেয়েছেন মনুষ্যত্বের আদর্শকে স্বীকৃতি দিয়ে জাতীয় চরিত্রের উন্মেষ ঘটাতে। এছাড়া তিনি আধ্যাত্মিকতা ও অলৌকিকতা বর্জন করে নাটকে এক বাস্তবমুখী নিদর্শন রেখেছেন। তাঁর নাটকের আর এক বৈশিষ্ট্য হল গদ্যময় সংলাপ ও ইউরোপীয় নাট্যরীতির মঞ্চসজ্জা। সবচেয়ে বড়কথা, নট ও নাট্যকার গিরিশ চন্দ্র ঘোষের প্রতিভা তুঙ্গে, যখন রবীন্দ্রনাথ থেকে ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ সফল নাট্যকার হিসাবে প্রতিষ্ঠিত, তখন কবি ও নাট্যকার হিসাবে দ্বিজেন্দ্রলাল নিজের প্রতিভাগুণে নিজের আসন করে নিয়েছিলেন।
উপসংহার
দ্বিজেন্দ্রলালের মাত্র বাইশ বছর বয়সে প্রয়াত হন তাঁর পিতা কার্তিকেয় চন্দ্র রায় ২ অক্টোবর ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে। তখন তিনি ছিলেন বিলেতে। তাঁর সহধর্মিনী সুরবালা দেবীর মৃত্যু হয় ২২ সেপ্টেম্বর ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে। মৃত্যুর নিষ্ঠুর আঘাত দ্বিজেন্দ্রলালের মনকে ব্যাথাতুর করে তোলে পরবর্তী জীবনে।
রবীন্দ্রনাথের সাথে দ্বিজেন্দ্রলালের যেমন সুসম্পর্ক ছিল তেমনি রবীন্দ্রনাথের ‘কড়ি ও কোমল’-এর প্যারেডি ‘আনন্দ বিদায়’ লিখে সম্পর্কের দূরত্বও সৃষ্টি করেছেন।
দ্বিজেন্দ্রলাল ভালোবাসতেন সোজা পথে মাথা উঁচু করে হাঁটতে, অন্যের প্রদর্শিত পথে হাঁটা তিনি পছন্দ করতেন না। তিনি ছিলেন নিজের পথপ্রদর্শক। নাটকে যেমন তিনি দেশপ্রেমের কথা তুলে ধরেছেন তেমনি তাঁর কবিতায় দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সংস্কৃতি, ঐক্য ও পরানুকরণকারীদের ব্যাঙ্গ-বিদ্রূপের মাধ্যমে দেশপ্রেম প্রচারের চেষ্টা করেছেন।
দ্বিজেন্দ্রলাল কর্মজীবন থেকে স্বেচ্ছা অবসর গ্রহণ করেন ২২ মার্চ ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর মহাপ্রয়াণ ঘটে সন্ন্যাস রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৭ মে ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে।
আরও পড়ুন – মহাত্মা গান্ধী প্রবন্ধ রচনা