তোমার বিদ্যালয় জীবন রচনা
ভূমিকা
বিদ্যালয়কে বলা হয় বিদ্যামন্দির। মন্দির যেমন সকলের কাছে পবিত্র স্থান, পূণ্য অর্জন করার জন্য সেখানে মানুষ যায় তেমনি শৈশবে শিশুরা নির্দিষ্ট বয়সে বিদ্যালয় বা বিদ্যামন্দিরে হাজির হয় শিক্ষালাভের জন্য ছাত্রহিসাবে। তবে ব্যাপক অর্থে দেখলে মানুষের সমস্ত জীবনই ছাত্রজীবন। আমরা প্রায়ই বলে থাকি- ‘যতদিন বাঁচি ততদিন শিখি।’ প্রতিনিয়ত নতুন কিছু শিখতে যে অসমর্থ তার বাঁচা শুধুই প্রাত্যাহিকতার আবর্তন-মাত্র। বাইরের অনুক্ষণকে অন্তরের সম্পদে পরিণত করতে হবে, দৃষ্টিকে চতুদিকে না প্রসারিত করে জ্ঞানর্জন করতে পারলে অভিজ্ঞতার সঞ্চয়ে দৈন্য দেখা দিতে পারে।
মানুষের জ্ঞানের রাজ্যটি প্রত্যহ বিস্তৃত হচ্ছে,সাথে সাথে তা বিচিত্রমুখী হয়ে উঠছে তার জটিলতা ক্রমশ বাড়ছে। স্কুল থেকে শুরু করে শিক্ষার্থীর মতো সারা জীবন অধ্যয়নকরেও বিচিত্র জ্ঞানবিদ্যার কিনারা খুঁজে পাওয়া অসম্ভব বললেই ভুল বলা হবে না। উচ্চস্তরের পন্ডিত ও জ্ঞানসাধকদের তাই এই বহুমুখী বিদ্যার কোনো না কোনো শাখা বেছে নিতে হচ্ছে। বর্তমানে পন্ডিতেরা ও বলে থাকেন, জ্ঞান-সমুদ্রের কূলে তাঁরা উপল সংগ্রহে নিরত রয়েছেন। একথা তাঁদের বিনয় মাত্র নয়-জ্ঞানের অসীমতার দ্যোতক। এরূপ পরিস্থিতিতে কে বলতে পারে যে, ছাত্রজীবনের শেষ আছে, তারপরে আর কিছু শেখার আবশ্যকতা নেই।
এছাড়া তো আছে জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শিক্ষালাভ। তাই কেবলমাত্র জড়চিত্ত ব্যক্তিরাই এই বলে আত্মসন্তুষ্টি লাভ করতে পারে যে, শিক্ষা জীবন তথা ছাত্রজীবন অতিক্রম করে এসেছেন। তাই ব্যাপক অর্থে -সমস্ত জীবন ধরেই আমরা ছাত্র। তবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় প্রত্যেক ছাত্রের যেদিন থেকে তার বিদ্যালয় জীবন শুরু হয়।
বিদ্যালয় জীবনের শুরু
কিন্তু বলা নিষ্প্রয়োজন ছাত্র -কথাটিকেই এই বিস্তৃত অর্থে আমরা সচরাচর ব্যবহার করি না-ছাত্রজীবন বলতে জীবনের একটি নির্দিষ্ট কালখন্ডকেই বুঝি। জীবনের প্রারম্ভমুখের কিছু বছর সবদেশে সবকালে শিক্ষাগ্রহণের উপযুক্ত সময় বলে বিবেচিত হয়ে আসছে। শৈশবে-কৈশোরে- যৌবনের কাঁচা বয়সে সকলের মন থাকে সতেজ, গ্রহণক্ষমতার প্রাচুর্য, সাংসারিকতার জটিল আবর্ত থেকে দূরে তার অবস্থান, কর্মজীবনের দায়-দায়িত্ব তাকে স্পর্শ করতে পারেনা, ভারমুক্ত অবস্থায় একাগ্রচিত্তে অধ্যয়ন বা বিদ্যানুশীলনই তার ছাত্রজীবনের প্রধান কর্তব্য। পূর্ণাঙ্গ মানুষ জীবনব্যপী অধ্যয়ন, বিদ্যাচর্চাও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মধ্যদিয়ে যে শিক্ষা গ্রহণ করে তার সাথে এই সূচিহ্নিত ছাত্রজীবনে শিক্ষার্জনের ভাবগত ও পদ্ধতিগত পার্থক্য বিস্তর। তাই জীবনের প্রথমাংশে শিক্ষাগ্রহণকে আবশ্যিক বলে মনে করা হয়, ভবিষ্যৎ জীবনের প্রস্তুতি হিসেবে তাকে দেখা হয়।
আমার ছাত্রজীবনের শুরু
তখন খুব ছোটো ছিলাম। মা, বাবা, ঠাকুরমা, ঠাকুরদাদার কোলে বসে মজার মজার গল্প শুনতাম, আধোভাষায় ছড়া বলার চেষ্টা করতাম। পারিপার্শ্বিক প্রকৃতি সবকিছুকে দেখে মনে হত বিস্ময়। সবকিছুকে জানার- শেখার জন্য মন ব্যাকুল হত। দাদা-দিদিরা স্কুলে যেত বই-এর ব্যাগ পিঠে চাপিয়ে, সাথে দেওয়া হত টিফিনের জন্য ভালো ভালো খাবার। আমি বার বার মাকে বলতাম-কবে স্কুলে যাব?
একদিন এসে গেল সেই পরম মুহূর্ত। বাবা ও মা সাথে করে নিয়ে চললেন স্কুলে। আমার জন্ম গ্রামে। এখনকার মতো স্কুল গাড়ির ব্যবস্থা ছিল না, শহরের ছাত্র-ছাত্রীদের মতো দামী খাবার টিফিনের জন্য দেওয়া হতনা। মার হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে স্কুলে গেছলাম। জীবনে প্রথম ঘরের বাইরে পা রাখা। পথের দু-ধারের গাছপালা, খাল-বিল, সুদূর মাঠ, দূরের বনানী যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে কাছে। আকাশ যেখানে দিগন্ত রেখায় নেমে এসে গাছপালা গ্রামগঞ্জের সাথে গল্পে ব্যস্ত, মন ছুটে যেত সেখানে। যদিও আমার কচি কচি পায়ের ক্ষমতা ছিল না সেখানে পৌঁছানোর।
স্কুলের প্রথম দিনটির কথা আজও মনে পড়ে। আমার বয়সের শিশুরা এসেছে স্কুলে। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের দেখে মনে হত বেশ গম্ভীর-ঠিক হিমালয়ের মতো। মনে ভয় মিশ্রিত আনন্দ-দাদা-দিদিদের মতো স্কুলে আসার অনুভূতি। স্কুলে আমরা বালক-বালিকা একসাথে পড়াশোনা করতাম, কো-এডুকেশন স্কুল। আমার ক্লাসের সবাই হয়ে গেল বন্ধু, তবে বিশেষ কারও প্রতি বন্ধুত্বের বাড়াবাড়ি ছিলনা যে তেমন নয়। শিক্ষক-শিক্ষিকা যেন খুবই আপনজন, তাঁরা যা বলতেন, যা নির্দেশ করতেন, সবই মনে হত যেন বেদবাক্য, অক্ষরে অক্ষরে পালন করার চেষ্টা করতাম। তবে মাঝে মাঝে স্কুলের চার দেওয়াল যেন আমার সামনে কারাগারের দুর্ভেদ্য প্রাচীর মনে হত।
স্কুলের জানলার ফাঁক দিয়ে মন ছুটে যেত যেখানে রঙিন ঘুড়ি আকাশ দখল করেছে। প্রজাপতি, শালিক কত বিচিত্র পাখি স্বাধীনভাবে বিচরণ করছে, তাদের সাথী হয়ে তাদের মাঝে হারিয়ে যেত আমার মন দুপুরে, বিকেল হলে ছুটি। ছুটির ঘন্টা স্কুলে পড়লে ক্লাস থেকে বাইরে চলে আসার স্মৃতি আজও আমার মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে আছে। দুষ্টুমি যে করতাম না এমন নয়। পড়াশোনা যারা ভালো করত শিক্ষক-শিক্ষিকার ভালোবাসা যেন তাদের প্রতি বেশী ছিল। তাই ক্লাসে পরীক্ষায় কে প্রথম কে দ্বিতীয় হবে তাই নিয়ে বন্ধুদের সাথে ছিল চোরা-প্রতিযোগিতা, বিভিন্ন বিষয়ে পরীক্ষার জন্য গোপন প্রস্তুতি। পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করলে বাড়ির সকলের ভালোবাসা ও আদরে আমিও হারিয়ে যেতাম আনন্দে সাগরে।
সিঁড়ির ধাপের মতো একটার পর একটা ক্লাস ডিঙিয়ে পরের ক্লাসে পৌঁছানো। অবশেষে পৌঁছালাম প্রাথমিক স্কুলের শেষ ধাপে, জীবনের প্রথম স্কুলের শেষপরীক্ষা। সকলে বলাবলি করছেন, পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট না করতে পারলে পরবর্তী কোনো ভালো স্কুলে ভর্তির সুযোগ পাওয়া যাবে না। স্কুলের শেষ দিনের বিদায় সভা। আমরা তখন এই স্কুলের ওপর ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রী। নীচের ক্লাশের ছাত্র-ছাত্রীরা দাদা-দিদি বলে সম্বোধন করে। মনে মনে ভাবছি এখন অনেক বড়ো হয়ে গেছি। স্কুলের বিদায় সভা ছিল যেন দুঃখের কালোরাত। স্কুলের প্রতিটি জানলা-দরজা, ইটপাথর কড়ি বর্গা, ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকার সাথে প্রাণের সম্পক, হৃদয়ের সখ্যতা, মনের অনেক গভীর পর্যন্ত সম্পর্ক-শেকড় ছড়িয়ে দিয়েছে।
নতুন স্কুলে নতুন করে পা রাখার কল্পনা, নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার ইচ্ছা, অপর দিকে বিগত বছরগুলোর সম্পর্কের ছেদের টানা-পোড়েনে আমার মন তখন বিধবস্ত। প্রধান শিক্ষক নির্দেশ করলেন কিছু বলতে। সবার মুখ যেন বাগরূদ্ধতার বাণের আঘাতে স্তব্ধ, চক্ষু জলে টলটলায়মান, ছাত্র-ছাত্রী শিক্ষক-শিক্ষিকারও। আমি তখন ছন্দ মিলিয়ে লিখতে পারতাম। লিখে শুনালাম, ‘জীবনের স্বপ্নে রঙিন শিক্ষক বন্ধু স্কুল-বাড়ি, যতই আসুক বাধা-বিপদ আমি কি আর ভুলতে পারি।’ সভাগৃহ করতালিতে ভরে গেছল। ভবিষৎ জীবনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার ও জ্ঞান আহরণের স্বপ্নে বিভোর হয়ে আবার হাজির হলাম নতুন স্কুলপ্রাঙ্গণে।
জীবনের প্রথম স্কুলের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান এখন আমার পাথেয়। সম্পূর্ণ আলাদা পরিবেশ। ওপর ক্লাশের দাদা-দিদিদের দেখলে মনে হত তারা কত জেনেছে-শিখেছে, শিক্ষক-শিক্ষিকা যেন জ্ঞান-সমুদ্রের অগাধ জলরাশি। সকল ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে প্রথম মুখোমুখি হওয়া নবীন বরণ উৎসবে, আমরা নতুন অতিথি, স্কুল-তরণীর নাবিক উঁচু ক্লাসের দাদা-দিদিরা, হাতে রাখি বেঁধে, কপালে চন্দনের ফোঁটা ফুল দিয়ে বরণ করা সেতো অকল্পনীয় এক স্মৃতি! শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অকৃত্রিম স্নেহভরা সম্ভায়ণে তাঁদের বক্তব্য আজও মনের মণিকোঠায় অমর হয়ে আছে কল্পনার ফলকে খোদিত হয়ে।
স্কুল-জীবনের বছরগুলো যেন দ্রুত লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গেল একটার পর একটা ক্লাসকে পেছনে ফেলে। স্কুল-জীবনের সূর্যোদয় প্রাথমিক স্কুলে, সেই সূর্য যেন অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছে। আজ বিদায়ের পালা দীর্ঘ বছরের সুখ-দুঃখের সাথী স্কুলের বন্ধুদের ছেড়ে, জ্ঞানের-আলোকের দিশারী শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ছেড়ে চলে যাওয়ার করুণ-বিধূর মূর্ছতের সাক্ষী হয়ে থাকল স্কুলের বিদায় সভা।
উপসংহার
ছাত্রজীবনের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এর ওপরেই তো প্রতিটি মানুষের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে। জীবন হল বিশাল সংগ্রাম ক্ষেত্র। জয়ী হতে হলে যে সমস্ত আয়ুধ সংগ্রহের প্রয়োজন তা ছাত্রাবস্থাতেই সংগ্রহ করতে হয়। জীবন-যুদ্ধের এই আয়ুধ হল বিদ্যা, অনুশীলিত বুদ্ধি, সংযম শাসিত চরিত্রবল, আত্মচেতনাবোধ, একাগ্রতা প্রভৃতি। স্কুলজীবনের শেষপ্রান্তে এসে এইসব আয়ুধ সংগ্রহ করে দুস্তর জীবন-সমুদ্র অতিক্রম করার শক্তি সঞ্চয়ে আমি এখন ব্যস্ত।
আরও পড়ুন – একটি ছুটির দিন রচনা