জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর চিন্তাধারা ব্যক্ত করো
অথবা, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে কি আধুনিক জাতীয়তাবাদের পথিকৃৎ বলা হয়
অথবা, ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জন্মদাতা হিসেবে নেতাজির ভূমিকা কী ছিল
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জাতীয়তাবাদের ধারণা
নেতাজির মধ্যে ছাত্রজীবনে যে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল, পরবর্তীকালে কর্মজীবনে তা রূপান্তরিত হয় সংগ্রামী জাতীয়তাবাদে। যদিও তাঁর জাতীয়তাবাদী তত্ত্বে উগ্র জাত্যভিমানের কোনো জায়গা ছিল না। বরং তাঁর ভারত সম্পর্কিত ভাবনা পূর্ণতা পেয়েছে বিশ্বমানবতাবোধের মাধ্যমে। নেতাজির জাতীয়তাবাদের উল্লেখযোগ্য দিকগুলি হল-
[1] অতীত ঐতিহ্যের গৌরবের অনুভূতি: নেতাজি উপলব্ধি করেছিলেন, ব্রিটিশ শাসিত ভারতে ভারতবাসীরা নিজেদের গৌরবোজ্জ্বল অতীত ঐতিহ্যের কথা ভুলতে বসেছে। তাই অতীত ঐতিহ্যের পুনর্জাগরণ প্রয়োজন। এ জন্য তিনি শিক্ষাগত সংস্কারের মাধ্যমে ভারতীয়দের মধ্যে অতীত ঐতিহ্যের গৌরবের অনুভূতি সৃষ্টির কথা বলেন।
[2] হীনমন্যতাবোধের বিলুপ্তি: সুভাষচন্দ্রের জাতীয়তাবাদী ধ্যানধারণার হীনমন্যতাবোধের কোনো স্থান ছিল না। ভারতীয়দের মনে বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে, ‘ইউরোপীয় জাতিগুলি অধিকতর উন্নত।’ যে-কারণে ভারতীয়দের পরাধীনতার গ্লানি সহ্য করতে হয়েছে। তাই সবার আগে হীনমন্যতাবোধ কাটিয়ে ওঠার বিষয়টিকে তিনি গুরুত্ব দিয়েছিলেন।
[3] জাতীয় ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ: ভারতের জাতীয় ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নেতাজির জাতীয়তাবাদের অন্যতম একটি দিক। তাঁর লেখা ‘The Indian Struggle’ গ্রন্থে নেতাজি ভারতের সুমহান ঐতিহ্যের পরিচয় দিয়েছিলেন। ভারতীয় জাতি একাধিকবার মরেছে-কিন্তু মৃত্যুর পর পুনর্জীবন লাভ করেছে। কারণ ভারতের অস্তিত্বের সার্থকতা ছিল এবং এখনও আছে। ভারতের একটি বাণী আছে যেটা জগতসভায় শোনাতে হবে, ভারতের শিক্ষার মধ্যে এমন কিছু আছে যা বিশ্বমানের পক্ষে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং তা গ্রহণ না করলে বিশ্বসভ্যতার প্রকৃত উন্মেষ ঘটবে না।
[4] অদম্য ও অপ্রতিহত জাতীয়তাবোধ: নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে তিনি বৈপ্লবিক পদ্ধতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি ইউরোপ ও এশিয়ার বিপ্লবী আন্দোলন দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়ে মনে করতেন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকে উৎখাত করার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের প্রয়োজন। আজাদ হিন্দ বাহিনী ও আজাদ হিন্দ সরকার তাঁর জ্বলন্ত জাতীয়তাবাদী চেতনার স্বাক্ষর বহন করে।
[5] অখন্ড জাতীয়তাবাদ: সুভাষচন্দ্র বসু ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার (পূর্ণস্বরাজ) পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সঙ্গে কোনোরকম আপোস করেননি।
তবে তিনি মহাত্মা গান্ধির মতো অহিংস পথে নয় বরং প্রকৃত জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটাতে ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে সক্রিয় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।
[6] প্রগতিশীল এবং অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ: নেতাজির জাতীয়তাবাদ ছিল প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ। দেশবাসীর উদ্দেশ্যে তিনি সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে উঠে একতার ধারণাকে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি সকলকে বুঝিয়েছিলেন, স্বাধীনতার জন্য সামাজিক-ধর্মীয় পটভূমি নির্বিশেষে এক সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন।
[7] বিপ্লবী জাতীয়তাবাদের পক্ষে সামরিক জোট : নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য সামরিক ও কৌশলগত সমর্থন ও সহযোগিতা পেতে নাৎসি জার্মানি, জাপান-সহ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অক্ষশক্তির সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি মূলত ভারতীয় সেনাবাহিনী গঠন করে তাকে জার্মান সেনাবাহিনীর অনুগামী করে মধ্য এশিয়া দিয়ে উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে ব্রিটিশ শক্তিকে আক্রমণের পরিকল্পনা করেন।
পরবর্তীকালে জাপানের আহবানে প্রথমে সিঙ্গাপুরে এবং তারপরে সুমাত্রা যান। এরপর জাপান গিয়ে বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর সঙ্গে দেখা করে আন্দোলন সম্পর্কে নতুন দিশা পান।
জাপানের প্রধানমন্ত্রী তোজোর কাছে তিনি প্রভৃত সহযোগিতা পেয়েছিলেন। এভাবে নেতাজি বুদ্ধিদীপ্ততার সঙ্গে সামরিক জোট তৈরি করেছিলেন।
[৪] সমাজতান্ত্রিক জাতীয়তাবোধ: জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে সুভাষচন্দ্র বসুর সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা মার্কসবাদ এবং সোভিয়েত মডেল-সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। তিনি অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অর্থনীতিতে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ, শিল্পায়ন পরিকল্পিত অর্থনীতি এবং সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কল্যাণের পক্ষে সমর্থন জানান।
[9] সশস্ত্র জাতীয়তাবাদ: জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে নেতাজির চিন্তাধারা ছিল বিপ্লবাত্মক যা সশস্ত্র প্রতিরোধ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ঐক্য এবং আর্থ-সামাজিক ন্যায়বিচারের মিশ্রণ দ্বারা আবর্তিত হয়েছিল।
মূল্যায়ন
উক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গে নেতাজির ভূমিকা প্রসঙ্গে বলা যায়-
- মানবকল্যাণের তত্ত্ব : নেতাজির স্বদেশ চেতনা তথা জাতীয়তাবাদের তত্ত্বটি মানবকল্যাণের একটি নতুন দিক উন্মোচন করেছে। যেখানে তিনি জনগণের ক্ষমতায়ণ, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য এবং ঔপনিবেশিক পরাধীনতা থেকে জাতিকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন।
- বিকল্প আদর্শ: জাতীয়তাবাদের প্রতি নেতাজির দৃষ্টিভঙ্গি ছিল মহাত্মা গান্ধির অহিংসা ও সত্যাগ্রহ এবং জওহরলাল নেহরুর সমাজতন্ত্রের থেকে আলাদা। কারণ নেতাজি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম আরও তীব্রতর করার কথা বলেছিলেন।
- আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি: নেতাজির জাতীয়তাবাদ শুধুমাত্র ভারতবর্ষে সীমাবদ্ধ ছিল না বরং তা বিভিন্ন দেশ-বিদেশেও বিস্তার লাভ করেছিল। বিশ্বব্যাপী নিপীড়িত জনগণের সঙ্গে একাত্মবোধে আবদ্ধ হয়েছিল এই তত্ত্ব। তিনি ভারতকে ব্রিটিশের দখল মুক্ত করতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অক্ষশক্তির সাহায্যে সম্পর্ক তৈরি করেছিলেন।
ভারতের জাতীয় স্বাধীনতা অন্বেষণে সুভাষচন্দ্র বসু সাহস, সংকল্প এবং ত্যাগের পরিচয় দিয়েছেন। আপোসহীন আন্দোলনের ভূমিকায় তাঁর আত্মত্যাগ সমস্ত কিছুকে ছাড়িয়ে গেছে। যা উত্তরাধীকার সূত্রে আগামী প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করে চলেছে। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জাতীয়তাবাদ ঔপনিবেশিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে এবং বৃহত্তর ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্যে স্মারক হিসেবে প্রাসঙ্গিক থেকে যাবে।
আরও পড়ুন – রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রশ্ন উত্তর