জাতি ও জাতীয়তাবাদ প্রশ্ন উত্তর Class 11 Second Semester
১। জনসমাজ বলতে কী বোঝো?
জনসমাজ: একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে বসবাসকারী ঐক্যবদ্ধ জনসমষ্টিকেই জনসমাজ (People) আখ্যা দেওয়া যায়। ভাষা, সাহিত্য, রাজনীতি, আচার-আচরণ, ঐতিহ্য প্রভৃতি বিভিন্ন কারণে এরূপ ঐক্য দেখা যেতে পারে। ম্যাৎসিনি, লর্ড বায়রন, লিকক্ প্রমুখ চিন্তাবিদ উদ্ভবগত ঐক্যের উপর বিশেষ জোর দিয়েছেন। ঐক্যের উৎস যাই হোক একমাত্র এই উপাদানই একটি জনসমষ্টিকে জনসমাজে পরিণত করে। আবার জনসমাজই হল জাতীয় জনসমাজের পূর্ব রূপ।
২। অধ্যাপক বার্জেস প্রদত্ত জনসমাজের সংজ্ঞা লেখো।
বার্জেস এর অভিমত: অধ্যাপক বার্জেস-এর মতে, জনসমাজ হল সেই জনসমষ্টি যারা একই ভূখণ্ডে বসবাস করে এবং তাদের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, আচার-আচরণ একই ধরনের হয় এবং যাদের মধ্যে অধিকারবোধের অভাব-অভিযোগের ক্ষেত্রে ঐক্য লক্ষ্য করা যায়।
৩। রাজনৈতিক চেতনাবিহীন ঐক্যবদ্ধ জনসমষ্টিকে কী বলে? ম্যাকেঞ্জির মতে, জনসমাজ কী?
রাজনৈতিক চেতনাবিহীন ঐক্যবদ্ধ জনসমষ্টিকে জনসমাজ বলা হয়।
ম্যাকেঞ্জি র অভিমত: ম্যাকেঞ্জি-র মতে, কিছুসংখ্যক ব্যক্তি একইসঙ্গে বসবাস না করলেও তাদের মধ্যে ঐতিহ্যগত ও ভাবগত ঐক্য লক্ষ করা যায়, তাদেরকেই জনসমাজ বলা হয়। তবে তিনি তাঁর প্রদত্ত সংজ্ঞায় ধর্মগত ও উদ্ভবগত ঐক্যের কথা বলেননি।
৪। জনসমাজ কথাটিকে ইংরেজিতে কী বলা হয়? জনসমাজের উৎপত্তির ক্ষেত্রে উদ্ভবগত ঐক্যের উপর কারা জোর দিয়েছিল?
জনসমাজ কথাটিকে ইংরেজিতে people বলা হয়। জনসমাজ হল একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে বসবাসকারী এমন একটি জনসমষ্টি যাদের মধ্যে ভাষাগত, ধর্মগত, আচার-ব্যবহার প্রভৃতি ক্ষেত্রে ঐক্য পরিলক্ষিত হয়। ম্যাৎসিনি, লর্ড বায়রন, লিকক্ প্রমুখ চিন্তাবিদ জনসমাজের উৎপত্তির ক্ষেত্রে উদ্ভবগত ঐক্যের উপর জোর দিয়েছেন।
৫। জনসমাজের দুটি বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো।
জনসমাজের বৈশিষ্ট্য: জনসমাজের দুটি বৈশিষ্ট্য হল-
[1] বিষয়গত ও ভাবগত ঐক্য ছাড়াও জনসমাজ গড়ে উঠতে পারে। তবে ভূখণ্ডগত ঐক্য দরকার।
[2] জনগোষ্ঠী একই ধরনের জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হয় এবং তাদের মধ্যে ভাষা, ঐতিহ্য, প্রথা প্রভৃতি ক্ষেত্রে মিল থাকতে পারে।
৬। জিমার্নের মতে, জাতীয় জনসমাজ কী? জাতীয় জনসমাজ গঠনে বংশগত ঐক্য অপেক্ষা ভাষাগত ঐক্যকে কে অধিক গুরুত্ব প্রদান করেছেন?
জিমার্ন এর অভিমত: জিমার্নের মতে, জাতীয় জনসমাজ ধর্মের ন্যায় আত্মিক ধারণা, মনন, চিন্তার এক অবস্থা এবং অনুভূতি, চিন্তা ও জীবনধারনের এক স্বাভাবিক গতি।
জাতীয় জনসমাজ গঠনে বংশগত ঐক্য অপেক্ষা ভাষাগত ঐক্যকে র্যামসে ম্যুর অধিক গুরুত্ব প্রদান করেছে।
৭। জাতীয় জনসমাজ বলতে কী বোঝো? অথবা, জাতীয় জনসমাজের ধারণাটি প্রধানত কী?
জাতীয় জনসমাজ: জাতীয় জনসমাজ হল জনসমাজের একটি উন্নত স্তর। জাতীয় জনসমাজকে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। তবে এককথায় বলতে গেলে, জাতীয় জনসমাজ বলতে নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে বসবাসকারী রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন এমন একটি জনসমষ্টিকে বোঝায়, যাদের মধ্যে বংশগত, ভাষাগত, ধর্মগত, কৃষ্টিগত, ঐতিহ্যগত প্রভৃতি ক্ষেত্রে সমতা লক্ষ করা যায়, তাদেরকেই জাতীয় জনসমাজ বলা হয়।
৮। জনসমাজ কখন জাতীয় জনসমাজে রূপান্তরিত হয়? লর্ড ব্রাইস জাতীয় জনসমাজ বলতে কী বুঝিয়েছেন?
জনসমাজের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা জাগ্রত হলে জনসমাজ জাতীয় জনসমাজে রূপান্তরিত হয়।
লর্ড ব্রাইস এর অভিমত: রাষ্ট্রবিজ্ঞানী লর্ড ব্রাইসের মতে, জাতীয় জনসমাজ হল ভাষা, সাহিত্য, ভাবধারা, রীতিনীতি প্রভৃতির দ্বারা যুগ-যুগান্তরের বন্ধনে আবদ্ধ এমন একটি জনসমাজ যারা অনুরূপভাবে ঐক্যবদ্ধ অপরাপর জনসমষ্টি থেকে নিজেদের পৃথক বলে মনে করে।
৯। জাতীয় জনসমাজ সম্পর্কে জে এইচ রোজের সংজ্ঞাটি লেখো। জাতীয় জনসমাজের দুটি উপাদান উল্লেখ করো।
জে এইচ রোজ এর অভিমত: জে এইচ রোজের মতে ‘জাতীয় জনসমাজ হল জনসমাজ এবং জাতির মধ্যবর্তী স্তর।
জাতীয় জনসমাজের উপাদান: জাতীয় জনসমাজের দুটি উপাদান হল- বাহ্যিক উপাদান এবং ভাবগত উপাদান।
১০। রিসেন্ট পলিটিকাল থট’ (Recent Political Thought) গ্রন্থটি কার লেখা? কোকারের মতে, জাতীয় জনসমাজ কী?
‘রিসেন্ট পলিটিকাল থট’ গ্রন্থটির লেখক কোকার।
কোকার-এর মত: কোকারের মতে, জাতীয় জনসমাজের ভাবগত উপাদানটি ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি ফল।
১১। গার্নার প্রদত্ত জাতীয় জনসমাজের সংজ্ঞাটি লেখো।
জাতীয় জনসমাজ হল ‘জনসমাজ’ ও ‘জাতি’র মধ্যবর্তী এক পর্যায়; যেখানে রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন, ভাবগত ও ভাষাগত ঐক্য পরিলক্ষিত হয়।
গার্নার-এর অভিমত: গার্নারের মতে, ন্যাশনালিটি বা জাতীয় জনসমাজ শব্দটির সংজ্ঞা দেওয়া খুবই শক্ত। কারণ বিভিন্ন অর্থে এটিকে ব্যবহার করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও তাঁর মতে, কুলগত বা অন্যান্য ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ একটি জনসমষ্টি বা অংশকে জাতীয় জনসমাজ বলা হয়।
১২। জাতীয় জনসমাজের বাহ্যিক ও ভাবগত উপাদান কোগুলিকে বলা হয়? অথবা, জাতীয় জনসমাজের উপাদান কয়টি ও কী কী?
জাতীয় জনসমাজের দুটি উপাদান। যথা- বাহ্যিক উপাদান এবং ভাবগত উপাদান।
বাহ্যিক উপাদান: জাতীয় জনসমাজের বাহ্যিক উপাদানগুলি হল- ভাষাগত ঐক্য, ভৌগোলিক ঐক্য, ধর্মীয় ঐক্য, রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা এবং অর্থনৈতিক সমস্বার্থ।
ভাবগত উপাদান: অন্যদিকে জাতীয় জনসমাজের ভাবগত উপাদানগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- সুখ-দুঃখ, অভাব-অভিযোগ সম্পর্কে অভিন্ন ধারণা ও সমরাষ্ট্রনৈতিক চেতনা প্রভৃতি।
১৩। ভৌগোলিক ঐক্য কীভাবে জাতীয় জনসমাজ গঠনে সহায়তা করে?
ভৌগোলিক ঐক্য: একই ভৌগোলিক খণ্ডে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করার ফলে তাকে ঘিরে জনসমাজের মধ্যে গড়ে ওঠে একটি গভীর একাত্মবোধ। এই একাত্মবোধ মানুষকে স্বাদেশিকতাবোধে জাগ্রত করে। ভৌগোলিক ঐক্য মানুষের যোগাযোগ ও ভাবের আদানপ্রদানের ক্ষেত্রেও সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
তবে ব্যতিক্রম হিসেবে বলা যায়-১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে ইজরায়েল স্থায়ীভাবে রাষ্ট্র গঠনের পূর্বে ইহুদিরা সারা বিশ্বময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাস করত, কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা জাতীয় জনসমাজে পরিণত হয়েছিল।
১৪। জাতীয় জনসমাজ গঠনে বংশগত ঐক্যের একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করো।
বংশগত ঐক্য: জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের প্রশ্নে উদ্ভবগত (বংশগত) উপাদানের গুরুত্ব সব থেকে বেশি। জাতীয় জনসমাজ গঠনে বংশগত ঐক্য বা উদ্ভবগত ঐক্যের একটি দৃষ্টান্ত হল- জার্মান জাতি আর্য-বংশোদ্ভূত। সুতরাং বলা যায় যে, অন্যান্য জাতি অপেক্ষা জার্মান জাতি যে শ্রেষ্ঠ এই প্রচার করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে হিটলার জার্মান জাতিকে একটি ঐক্যবদ্ধ শক্তিশালী জাতিতে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
১৫। “জাতীয় জনসমাজের সীমারেখা রাষ্ট্রীয় সীমারেখার সমান হওয়া উচিৎ- কে বলেছেন? জন স্টুয়ার্ট মিল জাতীয় জনসমাজ বলতে কী বুঝিয়েছেন?
“জাতীয় জনসমাজের সীমারেখা রাষ্ট্রীয় সীমারেখার সমান হওয়া উচিত”- একথা বলেছেন জন স্টুয়ার্ট মিল।
জন স্টুয়ার্ট মিল-এর মত: রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জন স্টুয়ার্ট মিল রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন জনসমাজকে জাতীয় জনসমাজ বলে অভিহিত করেছেন।
১৬। জাতীয় জনসমাজ কথাটি কোন শব্দ থেকে এসেছে? বিশেষনিক অর্থে জাতীয় জনসমাজ বলতে কী বোঝায়?
জাতীয় জনসমাজ কথাটি এসেছে ইংরেজি শব্দ ন্যাশনালিটি (Nationality) থেকে।
বিশেষনিক অর্থে জাতীয় জনসমাজ: বিশেষনিক অর্থে জাতীয় জনসমাজ বলতে বোঝায় জাতীয়তা। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এই অর্থে ন্যাশনালিটি শব্দটি কোনো ব্যক্তি বা বস্তুর জাতীয় চরিত্র বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়।
১৭। ধর্মগত ঐক্য কীভাবে জাতীয় জনসমাজ গঠনে সহায়তা করে?
ধর্মগত ঐক্য: ধর্মগত ঐক্যকে জাতীয় জনসমাজের অন্যতম প্রধান উপাদানরূপে বিবেচনা করা হয়। একই ধর্মের মানুষদের মধ্যে সমজাতীয় ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান, ধর্মীয় উপাসনা পদ্ধতি ইত্যাদি প্রচলিত থাকায় গভীর একাত্মবোধের উদ্ভব হয়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে অখণ্ড ভারতবর্ষ থেকে ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজিত হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়।
১৮। জাতীয় জনসমাজ গঠনে ভাবগত উপাদানের গুরুত্বটি আলোচনা করো।
ভাবগত উপাদান: রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, জাতীয় জনসমাজ গঠনে ভাবগত উপাদানের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কোনো জনসমাজ যখন ভাবে যে তাদের সুখ-দুঃখ, ব্যথা-বেদনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, গৌরব-গ্লানি সব এক, তখন সেই জনসমাজের চেতনায় জাতীয়তাবোধের সঞ্চার ঘটে। এভাবে অতীতের স্মৃতি বিজড়িত ইতিহাস, ভবিষ্যতের স্বপ্ন, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সমন্বয় ইত্যাদির ফলে যে ঐক্য গড়ে ওঠে তা জাতি গঠনের সহায়ক উপাদানের কাজ করে।
১৯। লাতিন শব্দ ‘Natio’-র অর্থ কী? জাতি বলতে কী বোঝায়?
লাতিন শব্দ ‘Natio’-র অর্থ হল- একটি জাতির জন্ম বা উদ্ভব সংক্রান্ত ধারণা সূচিত করা। ব্যুৎপত্তিগত অর্থে জাতি হল এমন একটি জনসমাজ, যাদের একটি উদ্ভবগত ঐক্য লক্ষ করা যায়।
জাতি: লাতিন শব্দ নেশিও (Natio) থেকে নেশন (Nation) শব্দটির উদ্ভব ঘটেছে। তার বাংলা পরিভাষা হল জাতি। জাতীয় জনসমাজের মধ্যে যখন কোনো রাজনৈতিক চেতনা উদ্ভূত হয়, তখন সেই জাতীয় জনসমাজকে জাতি বলা হয়।
২০। স্তালিনের মতে জাতি কী? ইহুদিরা কবে একটি জাতিতে পরিণত হয়?
স্তালিন এর অভিমত: স্তালিনের মতে, জাতি হল ভাষা, বাসভূমি, অর্থনৈতিক জীবন ও বিশিষ্ট জাতীয় সংস্কৃতির রূপে অভিব্যক্ত মননভঙ্গি, এই কয়টি উপাদানের ঐক্য বা মিলনের ফলে ঐতিহাসিকভাবে গঠিত একটি স্থায়ী জনসমষ্টি।
ইহুদিরা ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে একটি জাতিতে পরিণত হয়।
২১। বংশগত কিংবা ভাষাগত ঐক্য নয়, বরং ভাবগত ঐক্যই জাতি সৃষ্টি করে-উক্তিটি কার? বেনী-র মতে, জাতি কী?
‘বংশগত কিংবা ভাষাগত ঐক্য নয়, বরং ভাবগত ঐক্যই জাতি সৃষ্টি করে’-উক্তিটি হল ফরাসি রাষ্ট্রবিদ রেনাঁর।
রেনাঁ র অভিমত: রেনাঁ-র মতে, জাতি বা নেশন হল একটি সজীব সত্তা, একটি মানব পদার্থ। তাঁর মতে, এই দুটি জিনিস এই পদার্থের অন্তঃপ্রকৃতি গঠন করেছে। স্বভাবত এই দুটি জিনিস বস্তুত একই। তার মধ্যে একটি অতীতে অবস্থিত আর একটি বর্তমানে। একটি হচ্ছে সর্বসাধারণের প্রাচীন স্মৃতিসম্পদ, অন্যটি হচ্ছে পরস্পরের সম্মতি, একত্রে বাস করার ইচ্ছা। অর্থাৎ যে অখণ্ড উত্তরাধিকার হস্তগত হয়েছে তাকে উপযুক্তভাবে রক্ষা করার ইচ্ছা (ভাবানুবাদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘নেশন কী’)।
২২। রবীন্দ্রনাথ জাতি বলতে কোন শব্দটি ব্যবহার করেছেন? রবীন্দ্রনাথের মতে জাতি কী?
রবীন্দ্রনাথ জাতি বলতে নেশন শব্দটি ব্যবহার করেছেন।
রবীন্দ্রনাথের অভিমত: রবীন্দ্রনাথ ‘নেশন কী’ এই নিবন্ধটি লিখতে গিয়ে বলেছেন, ‘স্বীকার করিতে হইবে, বাংলায় নেশন কথার প্রতিশব্দ নাই। নেশন ও ন্যাশনাল শব্দ বাংলায় চলিয়া গেলে অনেক অর্থদ্বৈধ- ভাবদ্বৈধের হাত এড়ানো যায়। এককথায় নেশন হল একটি সজীব সত্তা, একটি মানব পদার্থ।’ জাতি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ধারণা সম্পূর্ণ ভাবগত। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা জাতিকে মূলত রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার- বিশ্লেষণ করার পক্ষপাতী।
২৩। জাতির অপরিহার্য বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করো।
জাতির বৈশিষ্ট্য: যখন কোনো জনসমাজের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার গভীরতা দেখা যায়, তখন সেই জাতীয় জনসমাজ জাতিতে রূপান্তরিত হয়। জাতির বৈশিষ্ট্যগুলি হল-
- সাধারণ জাতিগত ভিত্তি।
- সাধারণ ধর্মগত ভিত্তি।
- সাধারণ বাসস্থান।
- সাধারণ ভাষা ও সংস্কৃতি।
- সাধারণ রাজনৈতিক চেতনা।
- জাতি হওয়ার আকাঙ্ক্ষা।
২৪। A Grammar of Politics’ গ্রন্থটি কার লেখা। জাতি কীসের মধ্য দিয়ে পূর্ণতা লাভ করে?
‘A Grammar of Politics’-গ্রন্থটি হ্যারল্ড ল্যাস্কি-র লেখা। জাতি রাষ্ট্র গঠনের মধ্য দিয়ে তার পূর্ণতা লাভ করে। জাতির প্রচেষ্টার ভিত্তিতেই যখন স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়, ঠিক তেমনি আবার জাতির পূর্ণতা লাভ করে রাষ্ট্রের মধ্যেই।
২৫। জাতি গঠনের পর্যায়গুলি আলোচনা করো?
কেন জাতি গঠনের পর্যায়: বস্তুতপক্ষে ‘জাতি’ হল সাধারণভাবে ‘জনসমাজের’ একটি চূড়ান্ত বিকশিত রূপ। এই জাতি গঠনের তিনটি পর্যায় রয়েছে, যথা-
- প্রথম পর্যায়টি হল জনসমাজ, মোটামুটিভাবে সমধর্মী জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত জনসমষ্টিকে জনসমাজ আখ্যা দেওয়া যায়।
- দ্বিতীয় পর্যায়টি হল জাতীয় জনসমাজ, জনসমাজের সঙ্গে গভীর স্বাতন্ত্র্যবোধ যুক্ত হলে জাতীয় জনসমাজ গঠিত হয়।
- তৃতীয় পর্যায়টি হল জাতি, জাতীয় জনসমাজের সঙ্গে একটি রাজনৈতিক সংগঠন যুক্ত হলে জাতির আবির্ভাব ঘটে।
২৬। সাধারণ ইতিহাস কীভাবে জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে?
জাতি গঠনে সাধারণ ইতিহাসের ভূমিকা: জাতি গঠনের ক্ষেত্রে সাধারণ ইতিহাস একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। ইতিহাস পাঠের মাধ্যমে জনগণ একটি জাতির পরিচয়, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য সম্পর্কে অবহিত হন, যা তাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদ তথা দেশপ্রেমের প্রসার ঘটায় এবং একটি জাতীয় জনসমাজকে জাতিতে পরিণত করতে সাহায্য করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মুক্তি আন্দোলন ভারতীয়দের মনে জাতীয়তাবোধের সঞ্চার ঘটায় ও তাদের জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হতে সাহায্য করে, যার ফলে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট ভারত একটি জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। একইভাবে আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার জাতি গঠনের ক্ষেত্রেও সাধারণ ইতিহাস একটি তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
২৭। জাতি সম্পর্কে মার্কসবাদীদের মতটি ব্যাখ্যা করো।
জাতি সম্পর্কে মার্কসবাদীদের অভিমত: যখন কোনো জনসমাজের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার গভীরতা দেখা যায়, তখন সেই জাতীয় জনসমাজ জাতিতে রূপান্তরিত হয়। মার্কসবাদীদের মতে, জাতির মূল বৈশিষ্ট্য হল জনগোষ্ঠীর স্থায়িত্ব, যা জাতীয় জনসমাজের থেকে বেশি স্থায়ীরূপে পরিচিত। আর এই স্থায়িত্বের মূলে রয়েছে গভীর অর্থনৈতিক উপাদান।
২৮। রাজনৈতিক সচেতনতা কি একটি জাতির প্রধান উপাদান?
রাজনৈতিক সচেতনতাই হল একটি জাতির প্রধান উপাদান। কারণ ঐক্যবদ্ধ একটি জনগোষ্ঠী যখন অন্যান্য জনগোষ্ঠী থেকে নিজেদের সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র মনে করে, তখন জাতীয় জনসমাজ গঠিত হয়। পরে জাতীয় জনসমাজের মধ্যে সুগভীর রাজনৈতিক চেতনার জন্ম হলে জাতীয় জনসমাজ জাতিতে রূপান্তরিত হয়।
২৯। ভারতকে কি একটি জাতি বলে অভিহিত করা যায়? অথবা, ভারত কি একটি জাতি?
জাতি হিসাবে ভারত: ভারতীয় সংবিধান অনুসারে, আমাদের প্রথম ও শেষ পরিচয় আমরা ভারতীয়। তবে ভারতীয় জাতিসত্তা নিয়ে নানা মহলে নানা অভিমত পরিলক্ষিত হয়। শক্, হুন, পাঠান, মুঘল, আর্য- অনার্য প্রভৃতি জাতির সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা ভারতে বংশগত, ভৌগোলিক, ভাষাগত, ধর্মগত এবং আত্মিক ঐক্যের অভাব পরিলক্ষিত হওয়া অনেকে ভারতকে জাতি বলে মনে করেন না। অন্যদিকে কিছু রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, জাতিগঠনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক ঐক্যবোধ। তাই ভাষা বা সংস্কৃতিগত পার্থক্য জাতিগঠনের পথে অন্তরায় হতে পারে না। সুদীর্ঘ প্রায় দুশো বছর জাতীয় আন্দোলন নানা পথে সংঘটিত হয়ে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট ভারত একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, যার মূল সুরটিই ছিল ঐক্যবোধ। সেইদিক থেকে বিচার করলে ভারতকে একটি জাতি বলা যায়।
৩০। জাতিগত বিন্যাসে রাষ্ট্রকে কয় ভাগে ভাগ করা হয় ও কী কী?
জাতিগত বিন্যাসে রাষ্ট্রের শ্রেণিবিভাগ: জাতি হল রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত, বহিঃশাসন থেকে মুক্ত অথবা মুক্তিকামী একটি জনসমাজ। জাতিগত বিন্যাসে রাষ্ট্রকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
- একজাতিক রাষ্ট্র। যেমন- সুইডেন এবং
- বহুজাতিক রাষ্ট্র। যেমন- ভারত।
৩১। একজাতিভিত্তিক রাষ্ট্র এবং বহুজাতিভিত্তিক রাষ্ট্র কাকে বলে?
একজাতিভিত্তিক রাষ্ট্র: যদি কোনো জাতির সীমানা তার রাষ্ট্রীয় সীমানার সমানুপাতিক হয়, তখন এ ধরনের রাষ্ট্রকে একজাতিভিত্তিক রাষ্ট্র বলা হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়- ইজরায়েল, জার্মানি একটি একজাতিভিত্তিক রাষ্ট্র।
বহুজাতিভিত্তিক রাষ্ট্র: একাধিক জাতি নিয়ে রাষ্ট্র গঠিত হলে, এইরূপ রাষ্ট্রকে বহুজাতিভিত্তিক বা বহুজাতিক রাষ্ট্র বলা হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়- ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বহুজাতিভিত্তিক রাষ্ট্র।
৩২। জাতি রাষ্ট্র কাকে বলে? কোন্ বিপ্লবের সময় জাতি রাষ্ট্রের ধারণার উদ্ভব ঘটে?
জাতিরাষ্ট্র: একই সংস্কৃতি ও একই ভাষার মানুষজন যখন একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের মধ্যে স্বাধীন ও সার্বভৌম ক্ষমতা নিয়ে বসবাস করে তখন তাকে জাতি রাষ্ট্র (Nationstate) বলা হয়।
ফরাসি বিপ্লবের সময় জাতি রাষ্ট্রের ধারণার উদ্ভব ঘটে।
৩৩। জাতি ও রাষ্ট্র কি সমার্থক যুক্তি দাও। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হায়েস এর মতে জাতি কী?
সরজাতি ও রাষ্ট্র সমার্থক কি না যুক্তি: জাতি ও রাষ্ট্র সমার্থক নয়। এর কারণ হল রাষ্ট্র সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। রাষ্ট্রের হাতে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা সরকারের মাধ্যমে প্রযুক্ত হয়। জাতি বলতে যা বোঝায় তার সার্বভৌম ক্ষমতা বা ক্ষমতা প্রয়োগের যন্ত্র সরকার নয়।
হায়েস-এর অভিমত: রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হায়েস-এর মতে, একটি ঐক্যবদ্ধ জাতীয় জনসমাজ স্বাধীনতা ও সার্বভৌমিকতা অর্জন করলে জাতি হিসাবে পরিগণিত হয়।
৩৪। জাতীয়তাবাদের অর্থ কী? জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞা দাও।
জাতীয়তাবাদের অর্থ: জাতীয়তাবাদ হল ঐক্যসাধনকারী আত্মিক ভাবগত ধারণা, একটি মানসিক অনুভূতি।
জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞা: যখন একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে বসবাসকারী জনসমষ্টি বংশ, ভাষা, সাহিত্য, ধর্ম, প্রথা, কৃষ্টি প্রভৃতির ভিত্তিতে নিজেদের মধ্যে একাত্মবোধ অনুভব করে তখনই তাকে জাতীয়তাবাদ বলে।
৩৫। জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে ল্যাস্কির বক্তব্যটি লেখো।
জাতীয়তাবাদ একটি অনুভূতি বিশেষ, এটি একটি ভাবগত বা মানসিক ধারণা। জাতীয়তাবাদকে জাতির স্বাজাত্যবোধের প্রেরণা, স্বাধীনতা ও ঐক্যবোধের প্রতীক হিসেবে অভিহিত করা হয়।
ল্যাস্কি-র অভিমত: ল্যাস্কি-র মতে, জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হল মানুষের সঙ্গ পাওয়ার প্রবৃত্তি এবং স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা। যখন রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করার বাসনা একটি জাতিকে সুদৃঢ়ভাবে ঐক্যবদ্ধ করে এবং স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠন করতে চায়, তখনই জাতীয়তাবাদের ভিত্তি রচিত হয়।
৩৬। জাতীয়তাবাদের মূল নীতিটি উল্লেখ করো। জাতীয়তাবাদের জনক কাকে বলে?
জাতীয়তাবাদের মূল নীতি: জাতীয়তাবাদের মূল নীতিটি হল- নিজে বাঁচো এবং অপরকে বাঁচতে দাও। এই নীতির মধ্য দিয়ে স্বাজাত্যবোধ, দেশপ্রেম এবং ঐক্যবোধমূলক স্বতন্ত্র জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন সম্ভব হয়।
জাতীয়তাবাদের জনক: ম্যাৎসিনিকে জাতীয়তাবাদের জনক বলা হয়।
৩৭। বাট্রন্ড রাসেল ও রোজা লুক্সেমবার্গ জাতীয়তাবাদের ব্যাখ্যা কীভাবে করেছেন?
রবার্ট্রান্ড রাসেল এর অভিমত: বার্ট্রান্ড রাসেল-এর মতে, জাতীয়তাবাদ এমন এক সাদৃশ্য ও ঐক্যের অনুভূতি, যা পরস্পরকে ভালবাসতে শেখায় (Nationalism is a sentiment of similarity and solidarity) I
রোজা লুক্সেমবার্গ এর অভিমত: রোজা লুক্সেমবার্গের মতে, জাতীয়তাবাদ এবং জাতীয় রাষ্ট্র হল এমন একটি শূন্য পাত্র, যার মধ্যে প্রতিটি যুগ ও প্রত্যেকটি দেশের শ্রেণিসম্পর্ক নিজেদের বৈশিষ্ট্য প্রদান করে।
৩৮। হান্স ভন জাতীয়তাবাদের মধ্যে কোন্ বিষয়টিকে লক্ষ করেন? স্পেগলার-এর মতে জাতীয়তাবাদ কী?
হান্স ভন এর মত: হান্স ভন জাতীয়তাবাদের মধ্যে ইতিহাসের বিশেষ পর্যায়ের নানা সামাজিক ও বৌদ্ধিক উপাদানকে লক্ষ করেন। তাঁর মতে, জাতীয়তাবাদ হল ‘A state of mind, an act of consciousness’.
স্পেগলার এর অভিমত: স্পেগলার মনে করেন, জাতীয়তাবাদ গড়ে তুলতে ভাবগত ঐক্য, বংশগত কিংবা ভাষাগত ঐক্যের তুলনায় অধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অর্থাৎ জাতীয়তাবাদ হল এমন একটি ধারণা, যা একটি নির্দিষ্ট রাষ্ট্রীয় ভূ-খণ্ডের অধীনে নির্দিষ্ট সংখ্যক জনসমষ্টিকে একত্রে বাসবাসের প্রেরণা জোগায়।
৩৯। জাতীয়তাবাদের সপক্ষে দুটি যুক্তি লেখো।
জাতীয়তাবাদের সপক্ষে দুটি যুক্তি হল-
একটি মহান আদর্শ: জাতীয়তাবাদকে জাতীয় জীবনের এক মহান আদর্শ ও একটি গভীর অনুপ্রেরণা হিসেবে অভিহিত করা হয়। জাতীয়তাবাদ সমগ্র জাতিকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে দেশের জন্য আত্মত্যাগ করতেও অনুপ্রেরণা জোগায়। প্রতিটি জাতি জাতীয়তাবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হলে সামগ্রিকভাবে সারা বিশ্বের মানবসভ্যতার দ্রুত সমৃদ্ধি ঘটতে পারে।
মুক্তির দিশারি: পরাধীন জাতিগুলির কাছে জাতীয়তাবাদ হল মুক্তির দিশারি। মুক্তিকামী দেশগুলির জন্য জাতীয়তাবাদ একটি আশীর্বাদস্বরূপ। একমাত্র জাতীয়তাবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে, পরাধীন জাতিগুলি মুক্তির জন্য আমরণ সংগ্রামে লিপ্ত হয়। ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে উৎখাত করার জন্য ভারতবাসীরা জাতীয়তাবাদী আদর্শে দীক্ষিত হয়েছিলেন। একইভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার প্রায় ১০০টির মতো দেশ পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচন করে মুক্তির আস্বাদ লাভ করে।
৪০। জাতীয়তাবাদের বিপক্ষে দুটি যুক্তি লেখো।
উত্তর জাতীয়তাবাদের বিপক্ষে দুটি যুক্তি হল-
① বিকৃত জাতীয়তাবাদের জন্ম দেয়: জাতীয়তাবাদ এক প্রবল জাত্যভিমানে আদর্শভ্রষ্ট হয়ে যখন শুধুমাত্র নিজের জাতিকে সর্বশ্রেষ্ঠ এবং অন্যদের অত্যন্ত নিকৃষ্ট বলে মনে করে, তখন বিকৃত বা উগ্র জাতীয়তাবাদের জন্ম হয়। বিকৃত জাতীয়তাবাদ এক অন্ধ আবেগ সৃষ্টি করে হিংসা ও ঘৃণার বাতাবরণ তৈরি করে, যার ফলে সভ্যতার সংকট ঘনিয়ে আসে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে হিটলার (Hitler)-এর জার্মানির দিকে দৃষ্টি ফেরালে বিষয়টি আমাদের কাছে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।
(2) গণতন্ত্র হত্যাকারী: বিকৃত জাতীয়তাবাদকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা গণতন্ত্রের হত্যাকারীরূপে আখ্যায়িত করেন। বিকৃত জাতীয়তাবাদের শাসনকালে কোনো বিরোধী কণ্ঠস্বরকে জীবিত রাখা হয় না। যাবতীয় বিরোধিতাকে কঠোর হস্তে দমন করা হয়। গণতান্ত্রিক অধিকার ও স্বাধীনতাকে হত্যা করা হয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ, আমরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালের নাৎসি জার্মানি ও ফ্যাসিবাদী ইতালির কথা উল্লেখ করতে পারি।
৪১। জাতীয়তাবাদের দুটি বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো।
জাতীয়তাবাদের দুটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল-
ভাবগত ঐক্যের সহায়ক: জাতীয়তাবাদের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা একে একটি ভাবগত বা মানসিক ঐক্যের ধারণা বলে বর্ণনা করেছেন। বার্নস-এর মতে, যৌথ স্মৃতি ও যৌথ আদর্শ জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে জাতি গঠনে সাহায্য করে। ফরাসি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রেনা ভাবগত ঐক্যকে অতীত স্মৃতি এবং ঐতিহ্য বজায় রাখার আকাঙ্ক্ষার উপরে নির্ভরশীল বলে অভিহিত করেছেন। অধ্যাপক গেটেল-এর মতে, জাতীয়তাবাদ হল একটি মানসিক অবস্থা, জীবনযাপনের, চিন্তাভাবনার ও অনুভূতির একটি পদ্ধতি বিশেষ (“Nationalism is a state of mind, a way of living, thinking and feeling.”) I
রাষ্ট্রের মুখ্য উপাদান: জোসেফ ফ্র্যাঙ্কেল-এর মতে, রাষ্ট্রের সৃষ্টি ও গঠনে জাতীয়তাবাদ হল একটি মুখ্য উপাদান। জাতীয়তাবাদ নতুন রাষ্ট্রী কাঠামো গঠনে উৎসাহ দেয়। আবার জাতীয়তাবাদ ও জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার একে অপরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার উপনিবেশগুলিতে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে এক অদম্য প্রেরণা জুগিয়েছে জাতীয়তাবাদ।
৪২। মার্কসীয় চিন্তাবিদদের মতে জাতীয়তাবাদের ধারণাটি ব্যাখ্যা করো।
মার্কসীয় চিন্তাবিদদের মতে জাতীয়তাবাদ: মার্কসীয় চিন্তাবিদদের মতে, জাতীয়তাবাদকে দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। এদের মধ্যে একটি হল বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদ, অন্যটি হল প্রলেতারীয় জাতীয়তাবাদ। মার্কসবাদীদের মতে, বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদ জাতিগত সংকীর্ণতা, বিদ্বেষ ও বিচ্ছিন্নতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। অন্যদিকে, প্রলেতারীয় জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতার সুমহান আদর্শ, বিশ্বশান্তি ও মানবসভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। লেলিন নিপীড়নকারী শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধে শোষিত ও নির্যাতিত জাতির গণতান্ত্রিক আন্দোলন হিসাবে জাতীয়তাবাদকে দেখেছেন।
৪৩। বিভিন্ন প্রকার জাতীয়তাবাদের নাম উল্লেখ করো?
জাতীয়তাবাদের প্রকারভেদ: জাতীয়তাবাদকে জাতির স্বাজাত্যবোধের প্রেরণা, স্বাধীনতা ও ঐক্যবোধের প্রতীক হিসেবে অভিহিত করা হয়। বিভিন্ন প্রকার জাতীয়তাবাদের নামগুলি হল- রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদ, সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ, নৃ-কুলগত জাতীয়তাবাদ, রাজতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদ এবং বৈপ্লবিক জাতীয়তাবাদ প্রভৃতি।
৪৪। জাতীয়তাবাদের দুটি গুরুত্ব লেখো।
জাতীয়তাবাদের গুরুত্ব: জাতীয়তাবাদের দুটি গুরুত্ব হল-
- প্রতিটি জাতির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও সত্তার পূর্ণ বিকাশ ঘটিয়ে সমগ্র মানবজাতির সভ্যতাকে জাতীয়তাবাদ সমৃদ্ধ করেছে।
- নাগরিকরা রাষ্ট্রকে নিজের বলে ভাবতে শেখে, ফলে তারা নিজস্ব রাষ্ট্রের প্রতি খুব সহজভাবে আনুগত্য প্রকাশ করে।
আরও পড়ুন – ছুটি গল্পের প্রশ্ন ও উত্তর