গীতায় বর্ণিত নিষ্কাম কর্মতত্ত্ব ব্যাখ্যা করো
নিষ্কাম কর্মতত্ত্ব
যুদ্ধক্ষেত্রে অর্জুন আত্মীয়স্বজনদের হত্যা ও যুদ্ধের ভয়াবহতা কল্পনা করে দিশেহারা হয়ে শ্রীকৃষ্ণকে অনুরোধ করলেন তাঁকে সঠিক পথের নির্দেশ দিতে। অর্জুনের এই নৈতিক সমস্যার সমাধানের জন্য ও মোহ দূর করার উদ্দেশ্যে শ্রীকৃষ্ণ নিষ্কাম কর্মতত্ত্বের যে উপদেশ দেন তা নিম্নে আলোচিত হল-
নিষ্কাম কর্ম
গীতায় যেসকল কর্মের কথা বলা হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হল সকাম কর্ম ও নিষ্কাম কর্ম। সকাম কর্ম হল কামনাজাত কর্ম এবং কামনা হল কর্মান্তে কর্মফল লাভের আকাঙ্ক্ষা। ফললাভের প্রতি আকাঙ্ক্ষা থাকার কারণে কর্মকর্তাকে সুখ, দুঃখ ভোগ করতে হয়। কারণ কর্মের প্রত্যাশিত ফল পেলে কর্মকর্তার সুখ বা আনন্দ হয়। আর তা না পেলে দুঃখ বা বেদনা উৎপন্ন হয়। কিন্তু নিষ্কাম কর্মের সঙ্গে কোনো ফলাকাঙ্ক্ষা বা কামনা-বাসনা যুক্ত থাকে না। এই কারণে তা সুখ-দুঃখাদি উৎপন্ন করে না।
নিষ্কাম কর্মের সূত্রাবলি
গীতায় নিষ্কাম কর্ম প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ফলাকাঙ্ক্ষারহিত হয়ে আমরা তখনই কাজ করতে পারি যখন আমরা আমাদের কর্মকে ঈশ্বরে সমর্পণ করি। কর্তৃত্বের অভিমান না থাকলে কর্মফলে আসক্তি চলে যায় এবং নিষ্কাম কর্ম করা সম্ভব হয়। গীতায় নিষ্কাম কর্মের ব্যাখ্যায় যে সূত্রগুলি পাওয়া যায়, তা হল- (ক) শুধু কর্মেই তোমার অধিকার আছে, (খ) কর্মফলে তোমার কোনো অধিকার নেই, (গ) কর্মফলের আকাঙ্ক্ষা যেন কোনো কর্মের প্রবর্তক না হয় এবং (ঘ) কর্মহীনতায় যেন আসক্তি না থাকে।
নিষ্কাম কর্মকৌশল
গীতায় নিষ্কাম কর্মের উপস্থাপনা প্রসঙ্গে দুই প্রকার কর্মকৌশলের কথা বলা হয়েছে। সেগুলি হল-
নিরবচ্ছিন্ন কর্মের অপরিহার্যতা: কেউই ক্ষণকালমাত্র কাজ না করে থাকতে পারে না। নিঃশেষে কর্ম ত্যাগ করা অসম্ভব, কারণ তাতে জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়। গীতায় কর্মহীনতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়নি। তা ছাড়া মানুষের পক্ষে কর্ম ত্যাগ করা সম্ভব নয়।
কর্মফলে আসক্তিত্যাগ: গীতায় অপর একটি কর্ম কৌশলের কথা বলাহয়েছে, তা হল কর্মফলে আসক্তি ত্যাগ। এই আসক্তির কারণ হিসেবে বলা যায় যে মানুষ নিজেকে কর্মের সঙ্গে একাত্ম করে ফেলে এবং তার ফলেই দুঃখবোধ জন্মায়। যে কর্মপ্রণালী মানুষকে সর্বপ্রকার কর্মফলকে ত্যাগ করতে সাহায্য করে তাই হল কর্মযোগ বা নিষ্কাম কর্ম।
নিষ্কাম কর্মের লক্ষণ
গীতায় নিষ্কাম কর্ম বিষয়ে যে লক্ষণের কথা বলা হয়েছে তা নিম্নরূপ-
দ্বন্দ্বাতীত হওয়া: নিষ্কাম কর্মের লক্ষণ হল দ্বন্দ্বাতীত হওয়া। দ্বন্দ্বাতীত হওয়ার অর্থ হল কর্ম করার ক্ষেত্রে সমস্ত দ্বন্দ্ব অতিক্রম করতে হবে, সমস্ত প্রকার আসক্তি ত্যাগ করতে হবে এবং অহংবোধ ও মমত্ববোধ পরিত্যাগ করতে হবে।
আসক্তি ত্যাগ: নিষ্কাম কর্মের আর একটি লক্ষণ হল আসক্তি ত্যাগ। গীতায় বর্ণনা করা হয়েছে যে, নিষ্কাম কর্মযোগী কর্ম করেন আসক্তি ত্যাগ করে আত্মশুদ্ধির জন্য। আসক্তি ত্যাগের ফলে তিনি বন্ধনমুক্ত হন। যদিও গীতায় নিঃশেষে কর্মত্যাগ করার কথা বলা হয়নি। কারণ তার ফলে জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়। তাই কর্মত্যাগের পরিবর্তে কামনা ত্যাগের কথা বলা হয়েছে। শুধুমাত্র কামনা ত্যাগ নয়, কামনা ত্যাগপূর্বক কর্তব্যকর্মের অনুষ্ঠান করাকেই গীতায় ধর্ম বলে উল্লেখ করা হয়েছে, এ প্রসঙ্গে গীতায় বলা হয়েছে-
"কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেযু কদাচন। মা কর্মফলহেতুর্ভূমা তে সঙ্গোহত্ত্বকর্মণি।।” (২/৪৭)
এর অর্থ হল, ‘কর্মে মাত্র তোমার অধিকার আছে, ফলে তোমার অধিকার নেই; কর্মফলের হেতু হয়ো না, অকর্মেও যেন তোমার আসক্তি না থাকে’।
কর্তৃত্বাভিমানত্যাগ: নিষ্কাম কর্মের জন্য প্রয়োজন কর্তৃত্বাভিমানত্যাগ। ‘আমাকে’ এই প্রকার কর্মের এই ফল পেতে হবে-এটাই হল কর্তৃত্বাভিমান। ‘আমি কর্তা’, ‘আমি ভোক্তা’-এই প্রকার কর্তৃত্বাভিমান থাকলে নিষ্কাম কর্ম করা সম্ভব নয়।
যোগস্থ হওয়া: গীতায় নিষ্কাম কর্মের লক্ষণ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, নিষ্কাম কর্মী যোগস্থ হয়ে সকল কাজ সম্পাদন করে থাকেন। কামনা-বাসনা, কর্তৃত্বাভিমান পরিত্যাগ করে নিজ বুদ্ধিকে ঈশ্বরে সমর্পণ করে একনিষ্ঠ চিত্তে ঈশ্বরের কর্ম সম্পাদন করতে হবে, এমন অবস্থাই হল যোগস্থ হওয়া। গীতায় এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে-
"যোগস্থঃ কুরু কর্মাণি সঙ্গং ত্যত্ত্বা ধনঞ্জয়। সিদ্ধ্যসিদ্ধ্যোঃ সমো ভূত্বা সমত্বং যোগ উচ্যতে।।” (২/৪৮)
এখানে ‘যোগস্থ’ কথাটির একাধিক অর্থ করা হয়ে থাকে। সেগুলি হল- (ক) কেবলমাত্র ঈশ্বরার্থে বা ঈশ্বরের প্রতি কর্ম করা, (খ) নিষ্কাম কর্মযোগে স্থিত হয়ে কর্ম করা এবং (গ) সমত্ববুদ্ধিযুক্ত হয়ে কর্ম করা।
ভগবৎপ্রীতির নিমিত্তে কর্ম: কর্ম মাত্রেরই একটি উদ্দেশ্য থাকে এবং সেই উদ্দেশ্যের দ্বারা প্রেরিত হয়ে সাধক কর্ম করে। এই উদ্দেশ্য দুই প্রকারের- (ক) নিজের ইচ্ছা বা কামনার পূরণ এবং (খ) নিজের ইচ্ছাকে বর্জন করে ঈশ্বরের আদেশ পালন। নিষ্কাম কর্মী ঈশ্বরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এবং নিজের ইচ্ছাকে ভগবৎ ইচ্ছার সঙ্গে একীভূত করে ভগবানের প্রীতির নিমিত্ত কর্ম করে থাকে। আর এর নামই বুদ্ধিযোগ। এই যোগ সংঘটিত না হলে নিষ্কাম কর্ম করা অসম্ভব। এইজন্য বলা হয়েছে “যোগস্থঃ কুরু কর্মাণি”। এটিই হল নিষ্কাম কর্মযোগের মূলকথা।
যজ্ঞার্থ কর্ম: গীতায় নিষ্কাম কর্মকে বলা হয়েছে যজ্ঞার্থ কর্ম। যজ্ঞরূপ যে কর্ম করা হয় সেই কর্মের ফল কোনো বন্ধন সৃষ্টি করে না। যদি কোনো কর্ম উদ্দেশ্য পূরণে বা সিদ্ধির জন্য করা হয় তবে সেই কর্মকে ভোগার্থ কর্ম বলা হয়। কিন্তু যদি ত্যাগের জন্য কোনো কর্ম করা হয় তবে সেই কর্ম হল যজ্ঞার্থ কর্ম।
ত্রিগুণরহিত কর্ম: গীতায় শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে নিষ্কাম কর্ম প্রসঙ্গে ত্রিগুণরহিত ও নিত্যসত্ত্বস্থ ও যোগক্ষেমরহিত হয়ে কর্ম করার উপদেশ দিয়েছেন। জাগতিক সবকিছু, মানুষের সমুদয় কর্ম ও কর্মফল, মানব মনের সকল প্রকার চিন্তাভাবনা ইত্যাদি হল সত্ত্ব, রজো ও তমো- এই ত্রিগুণের কার্য। ত্রিগুণাত্মক কর্মের ফলে মোক্ষলাভ হয় না, কারণ তা আত্মাকে নিরন্তর সংসারচক্রে আবর্তিত করে। একারণে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে যথার্থ আত্মজ্ঞান লাভ করে নিস্ত্রৈগুণ্য হওয়ার উপদেশ দিয়েছেন।
‘নিত্যসত্ত্বস্থ’ শব্দটির অর্থ হল সর্বদা সত্ত্বগুণে অবস্থিত থাকা। সত্ত্বগুণের দ্বারা রজো ও তমোগুণকে পরাভূত করলে ত্রৈগুণ্য বিরোধের অবসান হয় এবং তখন আত্মার স্বরূপকে উপলব্ধি করা যায়। আত্মার এই অবস্থাকে বলা নিস্ত্রৈগুণ্য অবস্থা।
শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে আত্মজ্ঞান লাভ করে ‘যোগক্ষেমরহিত’ বা নির্যোগক্ষেম হওয়ার জন্য উপদেশ দিয়েছেন। অলব্ধ বস্তুর লাভকে ‘যোগ’ এবং লব্ধ বস্তুর সংরক্ষণকে বলে ‘ক্ষেম’। কিন্তু কাম্যবস্তু লাভ ও তাকে সংরক্ষণ করা আত্মজ্ঞানীর লক্ষ্য নয়। কারণ, তিনি জানেন যে, পুরুষ বা আত্মা স্বরূপত নির্লিপ্ত। অতএব পাওয়া না পাওয়ার হিসেব না করে কর্মফলের বাসনাকে সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করে আত্মস্থ হয়ে নিষ্কাম কর্ম করার উপদেশ শ্রীকৃষ্ণ দিয়েছেন।
এভাবেই আত্মজ্ঞানের সঙ্গে যে কর্ম করার উপদেশ শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে দিয়েছেন তাই হল গীতায় বর্ণিত নিষ্কাম কর্মতত্ত্ব।
আরও পড়ুন – যুক্তিবিজ্ঞানের প্রকৃতি – অবরোহ এবং আরোহ