গান্ধিজির অহিংসা তত্ত্বটির মূল্যায়ন করো

গান্ধিজির অহিংসা তত্ত্বটির মূল্যায়ন করো

গান্ধিজির অহিংসা তত্ত্বটির মূল্যায়ন করো
গান্ধিজির অহিংসা তত্ত্বটির মূল্যায়ন করো

গান্ধিজির অহিংসা তত্ত্বটির সমালোচনাসমূহ

অহিংসা গান্ধিজির মতাদর্শের মূলনীতি হলেও তত্ত্বটি নানান দিক থেকে সমালোচিত হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-

[1] অতিমাত্রায় ধর্মীয় প্রকৃতির: গান্ধিজি তাঁর অহিংস তত্ত্বকে যেভাবে ধর্মীয় ভিত্তির উপরে প্রতিষ্ঠিত করে আধ্যাত্মিকতা আরোপ করেছিলেন, অনেকে তা মেনে নিতে পারেননি। কারণ সমাজে বসবাসকারী প্রত্যেক ব্যক্তি ধর্মানুরাগী বা আস্তিক নয়। তাছাড়া নিরীশ্বরবাদীরাও রয়েছেন। সমালোচকদের মতে, যাঁরা ধর্ম বা ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না তাঁদের কাছে গান্ধিজির অহিংসার তত্ত্ব মূল্যহীন।

[2] বাস্তব রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক: আধুনিক যুগের বাস্তব ক্ষমতাকেন্দ্রিক প্রেক্ষাপটে হবস ও ম্যাকিয়াভেলির ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের ধারণা অধিকতর প্রাসঙ্গিক। এমনকি বর্তমান যুগে সন্ত্রাসবাদের পৃথিবীতে অহিংস নীতির সাহায্যে রাষ্ট্রপরিচালনা কার্যত অসম্ভব। কাজেই বাস্তব রাজনীতিতে গান্ধিজির অহিংসা তত্ত্ব অপ্রাসঙ্গিক নয়।

[3] জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অচল: গান্ধিজি তাঁর অহিংস নীতিকে ব্যক্তিগত ক্ষেত্র থেকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে প্রয়োগের পক্ষপাতী ছিলেন। সমালোচকদের মতে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সবক্ষেত্রেই অহিংস নীতির প্রয়োগ সম্পূর্ণ ‘ইউটোপীয়’ বা কাল্পনিক ধারণা ছাড়া আর কিছুই নয়।

[4] স্ববিরোধিতা: গান্ধিজি একদিকে অহিংস নীতির পূর্ণ প্রয়োগের সপক্ষে সওয়াল করেন, অন্যদিকে নিজেই এর সাফল্য সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করেন। ফলে তাঁর অহিংস নীতি স্ববিরোধিতার দোষে দুষ্ট।

[5] পরিবর্তনের ধীর প্রক্রিয়া: অহিংস পদ্ধতিটি একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। যার ফলে এটি জরুরি পরিস্থিতিতে সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে ফলপ্রসূ হয় না।

[6] সীমিত ক্ষেত্রে প্রযোজ্য: সমালোচকরা মনে করেন, অহিংস আন্দোলন সর্বজনীন প্রযোজ্য নয়। কিছু কিছু সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক বা সামাজিক প্রেক্ষাপটে এই আন্দোলনকে সহিংসভাবে দমন করা হয়ে থাকে।

[7] ব্যক্তিগত বলিদান: অহিংস প্রতিরোধে অনেকসময় ব্যক্তিগত বলিদানের বিষয়টি যেমন কারাদণ্ড, শারীরিক নির্যাতন, এমনকি মৃত্যুদণ্ডও অন্তর্ভুক্ত। তাই সমালোচকরা যুক্তি দেন যে এটি ব্যক্তি ও ব্যক্তিপরিবারের উপর অযাচিতভাবে চাপিয়ে দেওয়া বোঝা।

[৪] নৈতিক আবেদন নির্ভর: অহিংসা পদ্ধতিতে অনুমান করা হয় যে, নিপীড়কদের নৈতিক আবেদন দ্বারা প্রভাবিত করা যেতে পারে। কিন্তু নিপীড়গণ এই নৈতিক বিবেচনার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ উদাসীন থাকেন।

[9] প্ররোচনা দান: অহিংস আন্দোলনের দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী অনেকসময় হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এমন সময় বাইরে থেকে বিরোধীদের কোনোরূপ প্ররোচনামূলক কথায় বা আচরণে তাদের আন্দোলন অহিংস রূপ ধারণ করে থাকে।

[10] জনগণের অংশগ্রহণ: অহিংস প্রতিরোধের কার্যকারিতা প্রায়শই বিপুল সংখ্যক জনগণের অংশগ্রহণের উপর নির্ভর করে থাকে। এই ধরনের গণঅংশগ্রহণ অনেকসময় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয় এবং দমনমূলক পরিবেশের সৃষ্টি করে থাকে।

[11] অর্থীনতিক ও সামাজিক ব্যাঘাত: ধর্মঘট, বয়কটের মতো অহিংস আন্দোলন পদ্ধতিতে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যাঘাত ঘটে থাকে।

[12] ভুল ব্যাখ্যা এবং অপব্যবহার: সমালোচকদের মতে, গান্ধিজির অহিংসার নীতিটি ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর দ্বারা ভুল ব্যাখ্যা ও অপব্যবহারের ফলে সংঘটিত আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্যটি প্রায়ই ব্যর্থতায় পরিণত হয়।

গুরুত্ব: এতদসত্ত্বেও অহিংসা নীতির প্রনেতা হিসেবে গান্ধিজির অবদান যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। গান্ধিজি ছিলেন অদম্য আশাবাদী। তাঁর কাছে, অহিংসার দ্বারাই অশুভ শক্তির দমন সম্ভব এবং ভালোবাসাই হল আত্মার শ্রেষ্ঠ রূপ। তিনি অহিংস নীতিকে তৎকালীন মানবসমাজের প্রয়োজনে এক কার্যকরী হাতিয়ার হিসেবে দেখেছেন। বিখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সি ই এম জোডের মতানুযায়ী, গান্ধিজি হলেন একজন নৈতিকতাবাদী প্রতিভা এবং তাঁর পদ্ধতি আগত নতুন প্রজন্মের মধ্যে বিদ্যমান থাকবে। তাই এই বিষয়ে মহাত্মার মহত্ত্ব ও কৃতিত্ব অস্বীকার করা যায় না।

আরও পড়ুন – রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রশ্ন উত্তর

একাদশ শ্রেণির কলা বিভাগের যে কোনো প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন। কোনো উত্তর না পেলে আমাদের কমেন্ট বক্সে জানান।

Leave a Comment