গণতন্ত্র কাকে বলে? এর বিভিন্ন রূপগুলি আলোচনা করো
গণতন্ত্র
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বিভিন্নভাবে গণতন্ত্রের অর্থের ব্যাখ্যা করেছেন। গণতন্ত্র শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ Demos এবং Kratos থেকে। Demos-এর অর্থ জনগণ (People) এবং Kratos-র অর্থ কর্তৃত্ব বা শাসন বা ক্ষমতা (power or authority)। অতএব Democracy বা গণতন্ত্রের অর্থ হল জনগণের শাসন বা জনগণের কর্তৃত্ব।
সংজ্ঞা: বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। যথা-
- জন স্টুয়ার্ট মিল: জন স্টুয়ার্ট মিল গণতন্ত্র বলতে রাষ্ট্রে সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগে সকলের সমানাধিকারের স্বীকৃতিকে বুঝিয়েছেন।
- ডাইসি: ডাইসি বলেন, গণতন্ত্র তাকেই বলা যায়, যেখানে দেশের সরকার পরিচালনায় অধিকাংশ মানুষ যোগদান করে।
- সিলি: সিলির মতে, যে শাসনব্যবস্থায় সকলের অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে তা-ই গণতন্ত্র।
- ব্রাইস : ব্রাইস মনে করেন, যে শাসনব্যবস্থায় শাসন করার ক্ষমতা সমগ্র সমাজের হাতে ন্যস্ত থাকে, তাকেই গণতন্ত্র বলা যায়। তিনি বাস্তবে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনকেই গণতন্ত্র বলে অভিহিত করেছেন।
- সিডি বার্নস: সি ডি বার্নস মনে করেন যে, গণতন্ত্র একই ধরনের মানুষ নিয়ে গঠিত নয়। তাঁর মতে, প্রত্যেকেই সমাজের অবিচ্ছেদ্য ও অপরিহার্য অংশ। এদিক থেকে তারা সকলেই সমান। অতএব সমমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত সমাজই হল গণতন্ত্র।
- রুশো: রুশোর মতে, সাধারণ ইচ্ছার দ্বারা পরিচালিত সরকারই হল গণতন্ত্র।
গণতন্ত্রের বিভিন্ন রূপ
অধ্যাপক গার্নার সরকার গঠনের উপর ভিত্তি করে গণতন্ত্রকে দু-ভাগে ভাগ করেছেন, যথা-
[1] প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র : গণতন্ত্রের রূপগুলির মধ্যে আদি রূপ বা প্রাচীন রূপ হল প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র। যে শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রের সমস্ত নাগরিকরা প্রত্যক্ষভাবে মিলিত হয়ে দেশের শাসনকার্য পরিচালনা করে, তাকে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র (Direct Democacy) বলা হয়। বর্তমানে সুইটজারল্যান্ডের চারটি ক্যান্টন এবং অর্ধক্যান্টনে ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনমূলক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এইরূপ গণতন্ত্র দেখতে পাওয়া যায়। এই ধরনের শাসনব্যবস্থাকে অংশগ্রহণকারী গণতন্ত্র বা Participatory Democracy-ও বলা হয়।
[2] পরোক্ষ গণতন্ত্র : রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ব্যবস্থা হল গণতন্ত্র। এই গণতন্ত্রেরই অন্যতম রূপ হল পরোক্ষ গণতন্ত্র। পরোক্ষ গণতন্ত্র হল এমন একটি শাসন যেখানে জনগণ প্রত্যক্ষভাবে শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করে না। জনগণ নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কিছু ব্যক্তিকে নির্বাচিত করে। এই জনপ্রতিনিধিরাই দেশ শাসন করে। তাই পরোক্ষ গণতন্ত্রকে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র (Representative Democracy) বলা হয়। পরোক্ষ গণতন্ত্র দেখতে পাওয়া যায়-গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা প্রভৃতি রাষ্ট্রে। সরকার পরিচালনার দৃষ্টিকোণ থেকেও গণতন্ত্রকে দু-ভাগে ভাগ করা হয়, যথা-
[1] উদারনৈতিক বা বুর্জোয়া গণতন্ত্র: উনিশ শতকে উদারনীতিবাদ এবং গণতন্ত্র -এই দুটি ধারণার সংযুক্তিকরণের মাধ্যমে উদারনৈতিক গণতন্ত্রের (Bourgeois Democracy) উদ্ভব ঘটে। উদারনৈতিক গণতন্ত্র গ্রেট ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি দেশে দেখতে পাওয়া যায়।
[2] সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র: সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র (Socialist Democracy) গড়ে ওঠে। সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রকে সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য হিসেবে গণ্য করা হয়। সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র গণপ্রজাতন্ত্রী চিন, কিউবায় দেখতে পাওয়া যায়।
মূল্যায়ন: পরিশেষে বলা যায়, উপরোক্ত গণতন্ত্রের সংজ্ঞা ও বিভিন্ন রূপগুলির আলোচনা থেকে এই ধারণা স্পষ্ট যে, গণতন্ত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের শাসন। এখানে সংখ্যালঘিষ্ঠ জনগণ নিজ নিজ কৌশলে সংখ্যাগরিষ্ঠকে পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
আরও পড়ুন – জাতি ও জাতীয়তাবাদ প্রশ্ন উত্তর