গণতন্ত্রের বিকাশ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো

গণতন্ত্রের বিকাশ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো

গণতন্ত্রের বিকাশ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো
গণতন্ত্রের বিকাশ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো

গণতন্ত্রের বিকাশ

বর্তমানে ‘গণতন্ত্র’ হল রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বহু আলোচিত একটি বিষয়। তবে এটি কোনো আধুনিক ধারণা নয়। ক্রমাগত যুগ বিকাশের মধ্য দিয়ে নিত্য নতুন ধ্যানধারণা গণতন্ত্রের আলোচনাকে সমৃদ্ধ করেছে। বিভিন্ন সমাজব্যবস্থায় গণতন্ত্রের ধারণা বিভিন্ন রকম অর্থে ব্যক্ত করা হয়েছে। প্রাচীন রোমে ও গ্রিসে ভিন্ন অর্থে গণতন্ত্র শব্দটির প্রচলন ছিল। তবে মধ্যযুগে ইংল্যান্ডের মহাসনদ (ম্যাগনা কার্টা, ১২১৫ খ্রি.), গৌরবময় বিপ্লব (১৬৮৮ খ্রি.), আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম (১৭৭৫- ১৭৮৩ খ্রি.), ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯ খ্রি.), পরবর্তীকালে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ (Individualism), হিতবাদ ও উদারনৈতিক চিন্তাধারা (Liberalism) প্রভৃতি তত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে উদারনৈতিক গণতন্ত্র (Liberal Democracy)-এর ধারণার বিকাশ ঘটে।

প্রাচীন গ্রিস ও রোমে গণতন্ত্র: প্রাচীন গ্রিস ও রোমের নগররাষ্ট্রে বিশুদ্ধ গণতন্ত্রের পীঠস্থান ছিল বলে মনে করা হয়। প্রাচীন গ্রিসের এথেন্স নগরীতে সর্বপ্রথম গণতন্ত্র বিষয়ক চর্চা শুরু হয়। গ্রিক ঐতিহাসিক থুকিডিডিস তাঁর পেলোপনেসীয় যুদ্ধের ইতিহাসে গণতন্ত্রের উল্লেখ করেছিলেন। গ্রিক দার্শনিক হেরোডোটাস খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে গণতন্ত্রের আলোচনায় ‘বহুজনের শাসন’ ও ‘সমান অধিকার’-এর কথা বলেছিলেন। এই সময় ক্লিওন নামক এক গ্রিক পণ্ডিতও গণতন্ত্রকে জনগণের দ্বারা, জনগণের শাসন বলে উল্লেখ করেছিলেন। আবার, স্টোয়িক দার্শনিকরা গ্রিক জনগণের মধ্যে আইনের প্রতি আনুগত্য, ব্যক্তি মানুষের দায়িত্ব, মানুষের স্বাভাবিক সাম্য ইত্যাদি ধারণাগুলি ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন। গ্রিক দার্শনিক পেরিক্লিস এথেন্সের গণতন্ত্রকে আদর্শ গণতন্ত্র বলে মনে করতেন। কিন্তু, এখানে গণতন্ত্র খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ফলে এই সম্পর্কিত ধারণার আর বিকাশ ঘটেনি। তবে প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, গ্রিক দার্শনিক প্লেটো বা অ্যারিস্টটল-এর মতে, ‘গণতন্ত্র’ পলিটির বিকৃত রূপ হলেও বর্তমানে জনতার শাসনব্যবস্থা বা জনতাতন্ত্র (Mobocracy)-ই গণতন্ত্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

অপরদিকে, প্রাচীনকালে রোম ছিল রাজতন্ত্র। পরবর্তীকালে, রাজতন্ত্রের অবসানের মধ্য দিয়ে প্যাট্রিসিয়ানরা (Patricians) ক্ষমতা দখল করলে প্লেবিয়ানদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ সৃষ্টি হয়। এর ফলস্বরূপ একসময় উভয়ের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সেখানকার শাসনব্যবস্থা অভিজাতন্ত্র, রাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের এক সংমিশ্রিত রূপ ধারণ করে।

অষ্টাদশ শতাব্দী ও তার পরবর্তীকালে গণতন্ত্র: অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে গণতন্ত্র নিয়ে নতুন চিন্তাভাবনার সূচনা ঘটে। আর বিংশ শতাব্দীর গোঁড়ার দিকেই এই আলোচনা বিশ্বজগতে গভীর আলোড়ন সৃষ্টি করে বিশেষ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সমাজজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যদি সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন সেই সাম্যভিত্তিক সমাজকেই গণতান্ত্রিক সমাজ বলা হয়। এই ধরনের সমাজে সমাজস্থ সকল ব্যক্তিই সমমর্যাদাসম্পন্ন হয়ে থাকে। এই কারণে জনগণই একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে চূড়ান্ত সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী।

আধুনিককালের গণতন্ত্র: বর্তমানে গণতন্ত্রকে ‘জনমত কর্তৃক পরিচালিত শাসনব্যবস্থা’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। কারণ এর মাধ্যমেই জনসাধারণের আশা-আকাঙ্ক্ষা, মতামত, ইচ্ছা-অনিচ্ছা প্রভৃতির প্রকাশ ঘটে। জনমতবিরোধী কোনো আইন পাস হওয়ার অর্থ হল প্রতিকূল জনমতের সম্মুখীন হওয়া, যার ফলস্বরূপ পরবর্তী নির্বাচনে ক্ষমতাসীন সরকারের পরাজয় নিশ্চিত হয়ে ওঠে। তাই গণতন্ত্রে জনমতের উপর অধিক গুরুত্ব প্রদান করা হয়।

আবার, কিছু কিছু ক্ষেত্রে গণতন্ত্রকে ‘শাসিতশ্রেণির সম্মতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত শাসন’ বলেও অ্যাখ্যায়িত করা হয়। এই ধরনের শাসনব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সরকার গঠন ও পরিচালনা করে এবং সংখ্যালঘু দল সরকারি কার্যকলাপ, নীতিসমূহ ইত্যাদির সমালোচনার মাধ্যমে সরকারকে সংযত রাখে। এ প্রসঙ্গে বার্কার তাই মন্তব্য করেছিলেন, “… a system of government by discussion.” অর্থাৎ, গণতন্ত্র হল আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে পরিচালিত একটি শাসনব্যবস্থা।

মাকর্সবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে গণতন্ত্র: মার্কসবাদী তাত্ত্বিকরা মনে করেন যে, একটি ধনবৈষম্যমূলক সমাজে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা অসম্ভব। সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র জনসাধারণ এরূপ ব্যবস্থায় কখনই রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করতে পারে না। ফলে এরূপ গণতন্ত্রে শাসনক্ষমতা মুষ্টিমেয় বাছাই করা কিছু ব্যক্তির হাতে কুক্ষিগত হয়। এঁনারা মনে করেন, গণতন্ত্রের প্রকৃত বা আদর্শ রূপ তখনই গড়ে উঠবে, যখন একটি সমাজে কেবলমাত্র রাজনৈতিক সাম্য নয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রেও সাম্য, সমানাধিকার ইত্যাদি প্রতিষ্ঠিত হবে। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ল্যাস্কি মন্তব্য করেছিলেন যে, “অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে গণতন্ত্র ছাড়া রাজনৈতিক গণতন্ত্র অর্থহীন।”

আরও পড়ুন – জাতি ও জাতীয়তাবাদ প্রশ্ন উত্তর

একাদশ শ্রেণির কলা বিভাগের যে কোনো প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন। কোনো উত্তর না পেলে আমাদের কমেন্ট বক্সে জানান।

Leave a Comment