কাব্যসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের অবদান লেখো
সূচনা পর্ব, উন্মেষ পর্ব ও ঐশ্বর্য পর্ব
রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতা ও গানের মাধুর্যে কেবল বাঙালি নয়, বিশ্বমানবাত্মার গভীর বাণী উচ্চারণ করে বিশ্বমানবকে নবতম দীক্ষায় ও শিক্ষায় উপনীত করে গিয়েছেন। রবীন্দ্রকাব্যের সূচনা পর্বের অপরিণত কাব্যসমূহ হল- ‘কবিকাহিনী’ (১৮৭৮), ‘বনফুল’ (১৮৮০), ‘ভগ্নহৃদয়’ (১৮৮১)। ১৮৮২ সাল থেকে তাঁর কবিভাবনার উন্মেষ পর্বের সূত্রপাত। এই সময় ‘সন্ধ্যাসঙ্গীত’, ‘প্রভাত -সঙ্গীত’ (১৮৮৩), ‘ছবি ও গান’, ‘ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী’ (১৮৮৪), – ‘কড়ি ও কোমল’ (১৮৮৬) প্রকাশ পায়। এর পরবর্তী পর্বের কাব্যকৃতিত্বকে – ঐশ্বর্য পর্ব বলা যায়। এই পর্বে রচিত ‘মানসী’ (১৮৯০), ‘সোনার তরী’ (১৮৯৪), ‘চিত্রা’ (১৮৯৬), ‘চৈতালি’ (১৮৯৬) কাব্যে কবিচেতনার অভাবনীয় প্রকাশ মেলে।
অন্তর্বর্তী পর্ব, গীতাঞ্জলি পর্ব ও ‘বলাকা পর্ব
১৯০০ সালে প্রকাশ পায় রবীন্দ্রনাথের ‘কথা’, ‘কাহিনী’, ‘কল্পনা’ ও ‘ক্ষণিকা’ এবং ১৯০১ সালে ‘নৈবেদ্য’। এরপর তাঁর কাব্যকর্মে স্থান পেয়েছে আখ্যান, প্রাচীন ভারত ও তার ঐতিহ্য। ‘কথা’ কাব্য থেকে শুরু করে ‘স্মরণ’, ‘শিশু’, ‘খেয়া’, ‘উৎসর্গ’ প্রভৃতি অন্তর্বর্তী পর্বের কাব্য কবিচিত্তের নিরুদ্ধ ভাবনা নানাভাবে বন্ধনমুক্তির পথ অন্বেষণ করে। ‘গীতাঞ্জলি’, ‘গীতিমাল্য’, ‘গীতালি’ কাব্যে তাঁর অধ্যাত্মচেতনা বা ঈশ্বরের প্রতি আত্মনিবেদন রয়েছে যাকে বলা যেতে পারে ‘গীতাঞ্জলি পর্ব’। ১৯১৩ সালে ‘গীতাঞ্জলি’ ও অন্যান্য কাব্যের কয়েকটি কবিতার ইংরেজি অনুবাদ ‘Song Offerings’ -এর জন্য রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পান। কবিজীবনের এই পরিণতির মধ্যে রবীন্দ্রভাবনায় আসে গীতিরাগের অভিনিবেশ। এই পর্বের নাম ‘বলাকা পর্ব’ বা ‘গতিতত্ত্বের পর্ব’। এই পর্বে ‘বলাকা’ (১৯১৬), ‘পূরবী’ (১৯২৫), ‘মহুয়া’ (১৯২৯) রচিত। এই তিনটি কাব্যে জীবনগতির আদর্শ, বিশ্ববোধ ও স্পর্ধিত প্রত্যয়কে কবি বাণীবদ্ধ রূপ দেন; যা উত্তরকালের কবিচেতনাকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছে।
পুনশ্চ পর্ব’, ‘প্রান্তিক পর্ব’ ও ‘অন্ত্যপর্ব’
১৯৩২ থেকে ১৯৩৬ পর্যন্ত প্রকাশিত কাব্যগুলিকে ‘পুনশ্চ’ পর্বের কাব্য নামে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই পর্বের বিশিষ্ট কাব্য হল-‘পুনশ্চ’ (১৯৩২); ‘শেষ সপ্তক’, ‘বীথিকা’ (১৯৩৫); ‘পত্রপুট’, ‘শ্যামলী’ (১৯৩৬) ইত্যাদি। জীবনের শেষদিকে অসুস্থ রোগজর্জরিত কবি, জীবনের ভিন্ন মার্গে বিচরণের সুখ অন্বেষণ করেছেন। ‘প্রাস্তিক’ (১৯৩৮); ‘সেঁজুতি’ (১৯৩৮); ‘আকাশপ্রদীপ’, ‘নবজাতক’ (১৯৪০); ‘সানাই’ (১৯৪০); ‘রোগশয্যায়’ (১৯৪০); ‘আরোগ্য’ (১৯৪১); ‘জন্মদিনে’ (১৯৪১) ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থ প্রান্তিক পর্ব এবং অন্ত্যপর্বে রচিত হয়। কবির মৃত্যুর পর প্রকাশ পায় ‘ছড়া’ ও ‘শেষ লেখা’। রবীন্দ্রনাথ প্রথম থেকেই বলতে চেয়েছেন- ‘আমি তোমাদেরই লোক’। এজন্য তাঁর জীবনসায়াহ্নের কাব্যে ব্যষ্টিজীবন অপেক্ষা সমষ্টিজীবনের প্রতিই অপরিমেয় আগ্রহ অনুভূত হয়।
আরও পড়ুন – বই কেনা প্রবন্ধের প্রশ্ন উত্তর