কর্মের প্রকারভেদ আলোচনা করো
কর্মের প্রকারভেদ
ভারতীয় দর্শনে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কর্মের প্রকারভেদ লক্ষ করা যায়। সেগুলি নিম্নরূপ-
ফলাকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে কর্মের প্রকার
কর্মনিয়ম যদি অপ্রতিরোধ্য বা অলঙ্ঘনীয় হয় তাহলে মুক্তি বা মোক্ষলাভ কীভাবে সম্ভব? স্বভাবতই ভারতীয় নীতিশাস্ত্রবিদদের এই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। কর্মবাদ যারা মানেন তারা ভারতীয় দর্শনে স্বীকৃত চারটি পুরুষার্থের মধ্যে মোক্ষকেই পরম বা শ্রেষ্ঠ পুরুষার্থ বলে স্বীকার করেছেন। এখন যদি কর্মমাত্রই ফলপ্রসবিনী হয় আর তার অবশ্যম্ভাবী পরিণতিরূপে জন্মান্তর ভোগ করতে হয় তাহলে অসৎ কর্মচারী অর্থাৎ অসাধু ব্যক্তিকে যেমন তার অসৎ কর্মের ফলভোগের জন্য আবারও জন্ম নিতে হবে, তেমনি সৎ কর্মচারী অর্থাৎ সাধু ব্যক্তিকেও তার ভালো কাজের ফলভোগের জন্য আবারও জন্ম নিতে হবে। আর তা যদি হয় তাহলে মোক্ষলাভ কীভাবে সম্ভব হবে? কর্মনিয়ম কি তাহলে মোক্ষলাভের পথে প্রতিবন্ধক? সংগত কারণেই তাই এই প্রশ্ন ওঠে যে মোক্ষের ধারণার সঙ্গে কর্মবাদের কি কোনো অসংগতি আছে?
উপরোক্ত এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তরে ভারতীয় দার্শনিক সম্প্রদায় কর্মের দুটি বিভাগের উল্লেখ করেন- একটি হল ফলাকাঙ্ক্ষা-সহ সকাম কর্ম এবং অপরটি হল ফলাকাঙ্ক্ষাবর্জিত নিষ্কাম কর্ম।
সকাম কর্ম: যে কর্মে ফললাভের আকাঙ্ক্ষা থাকে বা ফলভোগের বাসনা থাকে তাকে বলা হয় সকাম কর্ম। ফলের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কোনো কাজ করলে বিষয়ের প্রতি অনুরাগ বা আসক্তি জন্মায়। ফলত সকাম কর্মের কর্তাকে পুর্নজন্ম গ্রহণ করতে হয়। কাজেই বন্ধনদশা থেকে মুক্তিলাভ তার আর হয় না।
নিষ্কাম কর্ম: যে কর্মে কোনো ফললাভের আকাঙ্ক্ষা থাকে না বা ফলভোগের কামনা থাকে না তাকে নিষ্কাম কর্ম বলে। কোনো কামনা বাসনা না থাকায় নিষ্কাম কর্ম কর্মফল সঞ্চয়ও করে না আবার সঞ্চিত কর্মফলকে বিনষ্টও করে। কাজেই নিষ্কাম কর্মের কর্তাকে তার কৃত নিষ্কাম কর্মের ফলভোগের জন্য পুনরায় জন্মগ্রহণ করতে হয় না।
ফলভোগের ভিত্তিতে কর্মের প্রকার
অনেক ভারতীয় দার্শনিক কর্মের ফলভোগকে কেন্দ্র করে কর্মকে আবার দুই ভাগে বিভক্ত করেছেন। যথা- আরব্ধ বা প্রারব্ধ কর্ম ও অনারব্ধ কর্ম।
আরব্ধ বা প্রারব্ধ কর্ম: পূর্ব জীবন ও বর্তমান জীবনের যেসব কৃতকর্মের ফলভোগ শুরু হয়েছে তাদের বলা হয় আরব্ধ কর্ম বা প্রারব্ধ কর্ম।
দঅনারব্ব কর্ম: পূর্ব জীবন ও বর্তমান জীবনে কৃত যেসব কর্মের ফলভোগ এখনও শুরু হয়নি তাকে অনারব্ধ কর্ম বলে।
আবার অনারব্ধ কর্ম দুইটি ভাগে বিভক্ত। যথা- প্রাক্তন বা সঞ্চিত কর্ম ও ক্রিয়মান বা সঞ্চয়মান কর্ম।
- প্রাক্তন বা সঞ্চিত কর্ম: যে কর্ম অতীতে সম্পাদন করা হয়েছে কিন্তু এখনও ফলপ্রদান করেনি সেই কর্মকে প্রাক্তন বা সঞ্চিত কর্ম বলে। অর্থাৎ ভবিষ্যতে ফললাভের আশা নিয়ে অতীতে যে কর্ম সম্পাদন করা হয় তাই হল প্রাক্তন কর্ম বা সঞ্চিত কর্ম।
- ক্রিয়মান বা সঞ্চয়মান কর্ম: যে কর্ম বর্তমান জীবনে করা হচ্ছে কিন্তু তার ফলভোগ শুরু হয়নি, ভবিষ্যতে যার ফললাভ হবে তাকে বলে ক্রিয়মান বা সঞ্চয়মান কর্ম।
বৈদিক মতে কর্মের প্রকার
বৈদিক মতে কর্মকে চার ভাগে ভাগ করা হয়। যথা- নিত্য কর্ম, নৈমিত্তিক কর্ম, কাম্য কর্ম ও নিষিদ্ধ কর্ম।
নিত্য কর্ম: যে কর্ম অবশ্য কর্তব্য, যে কর্ম যাবজ্জীবন কর্তব্য, যে কর্ম না করলে পাপ হয়, তাই নিত্য কর্ম। যেমন- আহার গ্রহণ, সন্ধ্যাহ্নিক, উপাসনা প্রভৃতি কর্ম।
নৈমিত্তিক কর্ম: যে কর্ম বিশেষ ঘটনার নিমিত্ত করা হয়, তাই নৈমিত্তিক কর্ম। যেমন- সূর্যগ্রহণে গঙ্গাস্নান।
কাম্য কর্ম: যে কর্ম স্বর্গ বা অন্য সুখের কামনাপূর্বক সম্পাদিত হয়, তাই কাম্য কর্ম। যেমন- কৃতকারীরী যাগ, দশপূর্ণমাস যাগ প্রভৃতি কর্ম কাম্য কর্ম।
নিষিদ্ধ কর্ম: অন্য কোনো অনিষ্টের হেতু বলে শাস্ত্রে যেসব কর্ম করতে নিষেধ আছে, তাই নিষিদ্ধ কর্ম। যেমন- ব্রহ্মহত্যা, বৃথা হিংসা করা নিষিদ্ধ কর্ম। নিষিদ্ধ কর্ম করলে পাপ হয়। তাই এই কর্ম করা থেকে বিরত থাকা উচিত।
আরও পড়ুন – যুক্তিবিজ্ঞানের প্রকৃতি – অবরোহ এবং আরোহ