কর্মণ্যেবাধিকারন্তে মা ফলেষু কদাচন এই শ্লোকটির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো? কীরূপ কর্মকে নিষ্কাম কর্ম বলা যায় না
শ্লোকটির তাৎপর্য
ভগবদ্গীতায় ‘সাংখ্যযোগ’ (২য়) অধ্যায়ে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে নিষ্কাম কর্মের ধারণা সম্বন্ধে উপদেশ দেন। নিষ্কাম কর্মের সাধন কীভাবে সম্ভব তা বোঝাতে গিয়ে শ্রীকৃষ্ণ এই শ্লোকটির উল্লেখ করেন।
"কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেযু কদাচন। মা কর্মফলহেতুর্ভূমা তে সঙ্গোহত্বকর্মণি।।” (২/৪৭)
শ্লোকটির অর্থ
এই শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছেন কেবল কর্মেই তোমার অধিকার। সেই কর্মের ফলে (কর্মফল) তোমার কোনো অধিকার নেই। তাই কর্মফলের হেতু হোয়ো না, আবার অকর্মেও যেন তোমার আসক্তি না থাকে। অর্থাৎ ফললাভের আকাঙ্ক্ষায় তুমি কর্ম কোরো না। আবার কর্ম না করার প্রবৃত্তিও ঠিক নয়।
শ্লোকটির ব্যাখ্যা
অর্জুন যখন যুদ্ধক্ষেত্রে নৈতিক দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হলেন এবং স্বজনবধের আশঙ্কায় অস্ত্রত্যাগ করলেন, তখন শ্রীকৃষ্ণ এই শ্লোকের অবতারণা করেন। শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে বলেন, কর্মে তোমার অধিকার আছে তাই কর্ম করা তোমার আয়ত্তাধীন। কিন্তু কর্মফলের উপর তোমার কোনো অধিকার নেই কারণ ফললাভ তোমার আয়ত্তের মধ্যে নয়। সেকারণে ফলের আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করে কর্ম করতে হবে। আকাঙ্ক্ষাযুক্ত কর্ম বা সকাম কর্ম সম্পাদন করলে আমরা কর্মফলের দ্বারা আবদ্ধ হব। সুতরাং নিষ্কাম কর্মই সম্পাদন করা উচিত। নিষ্কাম কর্ম সম্পাদন করলে কর্মের ফলে কোনো আসক্তি থাকে না। ফলস্বরূপ কর্মের ফলভোগ করার প্রশ্নই আসে না।
জ্ঞানমার্গী ও কর্মমার্গী
শ্রীকৃষ্ণের নীতিসম্মত ধর্মতত্ত্বের মূলে আছে প্রাচীন ভারতের সেই সময়ের দুটি বিরুদ্ধ মনোভাব- জ্ঞানমার্গী সাংখ্য তত্ত্ব এবং কর্মমার্গী মীমাংসক তত্ত্ব। বেদের জ্ঞানমার্গকে যারা অনুসরণ করেন তারা কর্মমার্গকে বন্ধনের কারণ বলে মনে করেন। তারা আত্মজ্ঞানলাভকে মোক্ষলাভের একমাত্র পথ বলে মনে করেন। শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে এই মত অনুসরণ করে কর্মত্যাগ করার উপদেশ দেননি। অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণ জ্ঞানমার্গ ও কর্মমার্গ উভয়কেই অনুসরণের কথা বলেন।
শ্লোকটির মূলকথা
শ্রীকৃষ্ণের মতে আত্মজ্ঞানলাভ যেমন প্রয়োজন কর্মসম্পাদনও তেমনই প্রয়োজন। কর্মমার্গী মীমাংসকেরা ইহলোকে পশু, পুত্র এবং পরলোকে স্বর্গসুখ প্রদান করতে পারে এমন কাম্যকর্মকে একমাত্র কর্তব্যকর্ম বা ধর্মরূপে উল্লেখ করেছেন। তাদের মতে বেদের কর্মকাণ্ডই সার্থক। কর্মবাদীদের এই ধর্মমত খুব শীঘ্রই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ধর্মের আসল লক্ষ্য থেকে সরে গিয়ে আড়ম্বরের সঙ্গে যাগযজ্ঞের অনুষ্ঠান হতে থাকে। ধর্মের নামে শুরু হয় প্রাণীহত্যা। ফলে ধর্মের গ্লানি এবং অর্ধমের অভ্যুত্থান হয়। তখন ধর্ম সংস্থাপনের জন্য শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব হয়।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে কর্মমার্গ অনুসরণ করে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হতে বলেন। আর সেই কর্ম হল নিষ্কাম কর্ম। নিষ্কাম কর্ম বিষয়ক এই শ্লোকের মূল তাৎপর্য হল- (ক) কর্ম করো, (খ) ফলের কামনা ত্যাগ করে কর্ম করো, (গ) ফলের কামনায় কর্মে প্রবৃত্ত হবে না। (ঘ) ফলের কামনায় কর্মে নিবৃত্ত হবে না। (ঙ) লাভ-অলাভ, জয়-পরাজয়কে তুল্যজ্ঞান করে যোগস্থ হয়ে কর্ম করো।
কীরূপ কর্ম নিষ্কাম কর্ম নয়
উদাহরণের সাহায্যে কীরূপ কর্মকে নিষ্কাম বলা যায় না তা বোঝানো যায়- পরোপকার নামক অনুষ্ঠেয় কর্মকে অনেক ক্ষেত্রে নিষ্কাম কর্ম বলা যায় না। কারণ অনেকে পরের উপকার এই অভিপ্রায়ে করে থাকে যে আমি যার উপকার করলাম সে আমার প্রতি উপকার করবে। এটি সকাম কর্ম। এটি বিধি বহির্ভূত।
অনেকে এই অভিপ্রায়ে পরোপকার করে যে এতে আমার পুণ্য সঞ্চয় হবে এবং তার ফলে স্বর্গাদি লাভ হবে। এটিও সকাম কর্ম। এটি বিধি বহির্ভূত।
অনেকে এইরূপ অভিপ্রায়ে পরোপকার করে থাকে যে ঈশ্বর তার প্রতি প্রসন্ন হয়ে তার মঙ্গল করবেন। কিন্তু এটিও নিষ্কাম কর্ম নয়। এটি সকাম এবং এই বিধির বহির্ভূত।
আরও পড়ুন – যুক্তিবিজ্ঞানের প্রকৃতি – অবরোহ এবং আরোহ