প্রাচীন কাল থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত কবিতার বিবর্তনের ধারাটি সংক্ষেপে আলোচনা করো
বিবর্তনের ধারা: প্রায় হাজার বছরের প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের যাত্রা শুরু হয়েছিল ছন্দের ভাষা দিয়েই। বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন ‘চর্যাপদ‘ বৌদ্ধধর্মের তত্ত্বকথা অবলম্বনে রচিত হলেও এতে প্রাচীন বাংলার সমাজজীবনের নানা ছবি চিত্রিত হয়েছে। ফলে, এই পদগুলি সাহিত্যগুণে অনন্য হয়ে উঠেছে। চর্যাপদ ছাড়া প্রাচীন যুগের (৬৫০ সাল থেকে ১২০০ সাল পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগ) আর কোনো নিদর্শন এখনও পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি।
চর্যাপদের পর বাংলা সাহিত্যের অন্যতম উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম হল বড়ু চণ্ডীদাস বিরচিত ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য’, যা আনুমানিক ত্রয়োদশ শতাব্দী নাগাদ রচিত হয়েছে বলে সমালোচকেরা মনে করেন। বাংলা সাহিত্যে মধ্যযুগের সূচনা এই কাব্য দিয়েই। মধ্যযুগের (১২০১ সাল থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ) বাংলা সাহিত্য মুখ্যত চারটি শাখায় বিকাশ লাভ করে, যথা-বৈয়ব পদাবলি, মঙ্গলকাব্য, রোমান্সমূলক প্রণয়কাব্য এবং অনুবাদ কাব্য। অর্থাৎ এ যুগেও প্রাধান্য কাব্যের। মধ্যযুগের এইসব সাহিত্যশাখা হিন্দুধর্মের বিষয় ও বিধানকে অবলম্বন করে রচিত হলেও রোমান্সমূলক প্রণয়কাব্য হল ব্যতিক্রমী। কারণ ইসলাম ধর্মের প্রসার ও প্রচারকল্পে, সুফি ধর্মমতের প্রত্যক্ষ প্রেরণায় মুসলমান কবিদের মাধ্যমে এই কাব্যশাখার সৃষ্টি হয়েছিল। সৈয়দ সুলতান, সৈয়দ আলাওল, মুহম্মদ কবীর, দৌলত কাজী, দৌলত উজির বাহরাম খান প্রমুখ কবির কাব্যে মধ্যযুগীয় বঙ্গদেশের বহুমাত্রিক সামাজিক পরিচয় পাওয়া যায়।
এরপর আধুনিক বাংলা কাব্য-কবিতার প্রারম্ভিক পর্যায়ে অর্থাৎ অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্তিম পর্যায় পর্যন্ত সময়পর্বে কলকাতা শহরের অকস্মাৎ ধনী হয়ে ওঠা অনভিজাত ও স্থূল রুচির মানুষদের পৃষ্ঠপোষকতায় খেউড় ও কবিগান, টপ্পা গান, ঢপ-কীর্তন, সারিগান ও জারিগান, আখড়াই গান প্রভৃতি বহুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। দাশরথি রায়-এর ‘নূতন পাঁচালী’, বাংলার পথচারী সাধক সম্প্রদায়ের অধ্যাত্মসংগীত তথা ‘কর্তাভজার গান’-ও এই সময়ের কাব্যচর্চার এক নতুন আঙ্গিক হিসেবে লোকপ্রিয় হয়ে ওঠে। সমসময়ে ‘যুগসন্ধিক্ষণের কবি’ ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (১৮১২-১৮৫৯) এবং এর পরেই আধুনিক বাংলা কাব্যের প্রথম কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩) স্বমহিমায় আবির্ভূত হন। শুরু হয় বাংলা কাব্যসাহিত্যর এক স্বতন্ত্র পথ চলা। বাংলা গদ্যের সূত্রপাত হয়েছে উনবিংশ শতাব্দীতে, সুতরাং তার পূর্বকাল পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের সারথিরূপে কাব্য-কবিতাই ছিল এক এবং অদ্বিতীয়, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এর যথেষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ রয়েছে।
আরও পড়ুন – বই কেনা প্রবন্ধের প্রশ্ন উত্তর