ভূমিকা
‘সংসারে যারা শুধু দিলে, পেলে না কিছুই যারা বঞ্চিত, যারা দুর্বল, উৎপীড়িত- মানুষ যাদের চোখের জলের কোনো হিসাব নিলে না, নিরুপায় দুঃখময় জীবনে যারা কোনোদিন ভেবেই পেল না সমস্ত থেকেও কেন তাদের কিছুতেই অধিকার নেই-এদের বেদনাই দিলে আমার মুখ খুলে, এরাই পাঠালো আমাকে মানুষের কাছে মানুষের নালিশ জানাতে’-শরৎচন্দ্র।
শরৎচন্দ্র বাংলার একান্ত দরদী কথাশিল্পী, বাঙালির বেদনার-মনের কথার বাস্তব রূপের প্রকৃত রূপকার-শিল্পী। তাঁর লেখনীতে ধরা পড়েছে ব্যথিত মানুষের বাণীহারা বেদনার অন্তজ্বালা, সহজ-সাবলীল ভাষায়। তাঁর লেখায় ব্যক্ত হয়েছে বাংলার নিরুদ্ধ অশ্রুমুখের সকল উৎসের গোপন কাহিনি। যখন বাংলার সাহিত্য আকাশে বঙ্কিম- প্রতিভার স্রোত স্তিমিত, রবীন্দ্রনাথ পূর্ণ দীপ্তিতে ভাস্বর, তখনই শরৎচন্দ্র পূর্ণচন্দ্রের স্নিগ্ধ জ্যোতিতে আবির্ভাব হলেন বাংলা সাহিত্য জগতে। সাহিত্যের দরবারে তিনি শোনালেন সমাজের চির-বঞ্চিত, চির-অবহেলিত, চির-পতিতদের জীবন-কাহিনী, মর্মস্পর্শী ভাষায় রচনা করলেন তাদের বেদনাময় অশ্রু-নির্বেদ।
শরৎচন্দ্র বাংলার প্রকৃত চিত্রশিল্পী
বাংলার সনাতন রক্ষণশীল সমাজের নারীর স্থান ছিল সংকীর্ণ গণ্ডীতে সীমায়িত। কৌলিন্য প্রথা সমাজে সৃষ্টি করেছিল বিষময় ক্ষত। সমাজে কৃত্রিম জাতিভেদ প্রথাকে হাতিয়ার করে নিম্নশ্রেণীর মানুষের ওপর ব্রাহ্মণ-সমাজের নিদারুণ হৃদয়হীন লাঞ্ছনা ও দুঃসহ মানবতার অপমান সমাজের বুকে অঙ্কিত করেছিল কলঙ্কময় এক অধ্যায় মানবতার ইতিহাসে। সেদিনের প্রতিকারহীন শক্তির অপরাধে বিচারের বাণী কেঁদেছিল নিভৃতে গোপনে। শরৎচন্দ্র বাংলার এই ব্যথাদীর্ণ মানুষের অন্তরের কথা তীক্ষ্ণ ভাষায় লেখনির মাধ্যমে প্রকাশ করে ন্যায় বিচারের আশায় আর্জি পেশ করলেন জনতার-মানবতার বিচারশালায়।
নারী চরিত্র চিত্রণে শরৎচন্দ্রের দক্ষতা
নারী চরিত্র চিত্রণে শরৎচন্দ্রের লেখা মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছে। আমাদের সমাজে নারীরা নানাভাবে অবহেলিত। শরৎসাহিত্য তাই নারীযন্ত্রনায় কাতর, সামাজিক ব্যথা-বেদনায় অশ্রুসিক্ত। শরৎচন্দ্রের কৃতিত্ব এখানেই। তাঁর চন্দ্রমুখী, সাবিত্রী, কিরণময়ী, রাজসাক্ষী, অন্নদাদিদি একদিন বাঙালী মনীষার সামনে রেখেছিল এক চরম জিজ্ঞাসা যা বাঙালীর চেতনায় তুলেছিল তুমুল আলোড়ন। সেদিক থেকে শরৎচন্দ্র অবশ্যই আদর্শবাদী।
শরৎ-সাহিত্যের চরম জিজ্ঞাসা
তাঁর দেবদাস, অরক্ষণীয়া, বামুনের মেয়ে, বিপ্রদাস, চন্দ্রনাথ, গৃহদাহ, চরিত্রহীন, দেনাপাওনা, দত্তা, শ্রীকান্ত, শেষ প্রশ্ন, পথের দাবী ইত্যাদি উপন্যাস ও নিস্কৃতি, রামের সুমতি, বিন্দুর ছেলে, ইত্যাদি উপন্যাসোপম বড় গল্প বাংলা সাহিত্যকে করেছে সমৃদ্ধ। যে সমাজ ব্যক্তি-মানুষকে দিল না সুখ, দিল না শান্তি, দিল না সুস্থ সাবলীল জীবনের অধিকার, সেই সমাজের কি প্রয়োজন? নারীর সতীত্ব দেহে না প্রেমে? নারী সমাজের প্রতি কেন এত কঠোর সামাজিক অনুশাসন অথচ পুরুষ-সমাজের প্রতি কেন এত শৈথিল্য? পক্ষাঘাতগ্রস্থ সমাজের সামনে তিনি তাঁর ব্যথাদীর্ণ অনন্য উপন্যাসগুলির মধ্যস্থতায় রাখলেন রুধিরাক্ত কাতর জিজ্ঞাসা।
শরৎচন্দ্র বস্তুবাদী নন, আদর্শবাদী
সমাজ-জীবনের রূঢ় বাস্তবতাকে তিনি স্বীকার করেছেন সত্য, কিন্তু তাই বলে তাঁকে ‘রিয়ালিস্ট’ বা বস্তুবাদী বলা কখনই উচিত হবে না। তিনি বলেছেন, ‘যারা শুধু নিলে বিনিময়ে পেলে না কিছুই….’ তাঁরাই পাঠালো আমাকে মানুষের কাছে মানুষের নালিশ জানাতে।’ তাঁর সাহিত্যে তিনি রূঢ় বাস্তবকে রূপ দিয়ে অসুন্দরের মধ্যে সুন্দরকে খুঁজেছেন, পঙ্কিলতার ঊর্ধ্বে ফুটিয়েছেন মানবতার শতদল-পঙ্কজ। সেদিক দিয়ে শরৎচন্দ্র অবশ্যই আদর্শবাদী।
শরৎচন্দ্রের ছোটগল্প
শরৎসাহিত্যে আমরা দেখি আমাদের সমাজের বহু কলঙ্কিত মুখ, শুনি আমাদেরই লাঞ্ছিত, নির্যাতিত আত্মার ক্রন্দন। কিন্তু শুভ্র-নিষ্কলঙ্ক মানবাত্মার জয়গান করেছেন। তাঁর ‘মহেশ’, ‘অভাগীর স্বর্গ’, ‘একাদশীর বৈরাগী’- ছোটোগল্পগুলি শুধু বাংলা সাহিত্যেই নয়, বিশ্ব-সাহিত্যেও বিশিষ্ট মর্যাদা দাবী করে। শরৎচন্দ্র নিপীড়িত বাংলার নিরুদ্ধ বেদনার অশ্রুমুখের অবগুণ্ঠন করেছেন উন্মুক্ত। তাই শরৎচন্দ্র সাহিত্য জনমানসের সমাজ শিল্পী, তিনি গন-সাহিত্যের সার্থক রূপকার।
উপসংহার
শরৎ সাহিত্য প্রায় সকল ভারতীয় ভাষাতেই অনূদিত হয়ে ভারতীয় পাঠকের হৃদয় গভীরভাবে স্পর্শ করেছে। বাঙালী জাতি শরৎচন্দ্রের কাছে গভীরভাবে ঋণী। কেবল বাঙালী জাতিই নয় সমগ্র ভারতবর্ষই; এমন কি, স্বাধীন বাংলাদেশও শরৎচন্দ্রের কাছে অপরিশোধ্য ঋণে আবদ্ধ। শরৎচন্দ্রের জন্মের পরে তাধিক বছর কেটে গেছে। তবুও প্রশ্ন করেন অনেকে, সেই দরদী-মরমী প্রিয় কথাশিল্পীকে আমরা যথার্থ মর্যাদা দিতে পেরেছি কি সমাজের দরিদ্র, শোষিত ও নির্যাতিত মানুষ গফুর জোলা ও অভাগীদের সামাজিক অধিকার ফিরিয়ে দিতে? সমাজের অবহেলিত, অত্যাচারিত মানুষের পূর্ণ সামাজিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়াই হবে শরৎচন্দ্রের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের শ্রেষ্ঠ উপায়।
আরও পড়ুন – মহাত্মা গান্ধী প্রবন্ধ রচনা