উপন্যাস ও ছোটোগল্প (Marks 2, 3, 5) | একাদশ শ্রেণি 2nd Semester WBCHSE
উপন্যাস ও ছোটোগল্প (Marks 2)
১. প্রথম বাংলা গদ্য আখ্যানগ্রন্থ কোন্টি? এটি কোন্ গ্রন্থের ছায়া অবলম্বনে রচিত?
উত্তর: প্রথম বাংলা গদ্য আখ্যানগ্রন্থ হল হানা ক্যাথেরিন মুলেন্স রচিত ‘ফুলমণি’ ও করুণার বিবরণ’।
• গ্রন্থটি রচিত হয় ‘The Last Day of the Week’ নামে একটি ইংরেজি আখ্যানের ছায়া অবলম্বনে।
২. প্রথম বাংলা মৌলিক রচনার কৃতিত্ব কার? এটির নাম কী এবং কবে প্রকাশিত হয়?
উত্তর: প্রথম বাংলা মৌলিক রচনার কৃতিত্ব প্যারীচাঁদ মিত্র বা টেকচাঁদ ঠাকুরের।
• রচনাটির নাম ‘আলালের ঘরের দুলাল’ এবং এটি প্রকাশিত হয় ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে।
৩. প্যারীচাঁদের সার্থক উত্তরসূরি কে? তাঁর রচিত গ্রন্থটির নাম কী?
উত্তর: প্যারীচাঁদের সার্থক উত্তরসূরি হলেন কালীপ্রসন্ন সিংহ।
কালীপ্রসন্ন সিংহের রচিত গ্রন্থটির নাম ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’।
৪. ‘ঐতিহাসিক উপন্যাস’ এবং ‘দূরাকাঙ্কের বৃথাভ্রমণ’ উপন্যাস দুটি কাদের রচনা? গ্রন্থ দুটি কবে প্রকাশিত হয়?
উত্তর: ‘ঐতিহাসিক উপন্যাস’ রচনা করেন ভূদেব মুখোপাধ্যায় এবং কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য রচনা করেন ‘দূরাকাঙ্ক্ষের বৃথাভ্রমণ’।
• ‘ঐতিহাসিক উপন্যাস’ ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে এবং ‘দুরাকাঙ্ক্ষের বৃথাভ্রমণ’ ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়।
৫. যথাযথভাবে বাংলা উপন্যাসের সূচনা হয়েছিল কোন্ উপন্যাসের মধ্য দিয়ে? উপন্যাসটির প্রকাশকাল কবে?
উত্তর: বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দুর্গেশনন্দিনী’ উপন্যাসের মধ্য দিয়ে বাংলা উপন্যাসের সূচনা হয়েছিল।
উপন্যাসটির প্রকাশকাল ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দ।
৬. মানবজীবন এবং মানবপ্রকৃতির সঙ্গে মানবনিয়তির দ্বন্দ্ব নিয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা উপন্যাসের নাম লেখো। এই উপন্যাসের দুটি কেন্দ্রীয় চরিত্রের নাম কী?
উত্তর: মানবজীবন এবং মানবপ্রকৃতির সঙ্গে মানবনিয়তির দ্বন্দ্ব নিয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা উপন্যাস হল ‘কপালকুণ্ডলা’।
এই উপন্যাসের দুটি কেন্দ্রীয় চরিত্রের নাম কপালকুণ্ডলা এবং নবকুমার।
৭. সন্ন্যাসী বিদ্রোহের পটভূমিতে বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা উপন্যাসের নাম লেখো। এটির প্রকাশকাল উল্লেখ করো।
উত্তর: সন্ন্যাসী বিদ্রোহের পটভূমিতে বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা উপন্যাস হল ‘আনন্দমঠ’।
উপন্যাসটির প্রকাশকাল ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দ।
৮. রমেশচন্দ্র দত্ত এবং হরপ্রসাদ শাস্ত্রী রচিত দুটি করে উপন্যাসের নাম লেখো।
উত্তর: রমেশচন্দ্র দত্ত রচিত দুটি উপন্যাসের নাম-‘মহারাষ্ট্র জীবনপ্রভাত’ এবং ‘রাজপুত জীবনসন্ধ্যা’ এবং হরপ্রসাদ শাস্ত্রী রচিত দুটি উপন্যাসের নাম ‘বেনের মেয়ে’ এবং ‘কাঞ্চনমালা’।
৯. ‘পালামৌ’ কে রচনা করেন? গ্রন্থটি বাংলা সাহিত্যে বিখ্যাত কেন?
উত্তর: ‘পালমৌ’ গ্রন্থটি রচনা করেন সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়।
বাংলা সাহিত্যে এই গ্রন্থটি উল্লেখযোগ্য হয়ে ওঠার কারণ হল-এই রচনার মধ্য দিয়েই ভ্রমণকাহিনি বাংলা সাহিত্যের বিষয় হয়ে ওঠে।
১০. ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের লেখা দুটি গল্পের নাম উল্লেখ করো? বাংলা সাহিত্যে ত্রৈলোক্যনাথের বিশিষ্টতা কোথায়?
উত্তর: ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের লেখা দুটি উল্লেখযোগ্য গল্প হল ‘ভূত ও মানুষ’ এবং ‘ডমরু চরিত’।
• বাঙালির পুরানো বৈঠকি মেজাজ, বিচিত্র জীবন অভিজ্ঞতা, বুদ্ধিদীপ্ত কৌতুক ত্রৈলোক্যনাথের গল্পকে বিশিষ্ট করে তুলেছে।
১১. স্বর্ণকুমারী দেবী কোন্ পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন? সেখানে প্রকাশিত তাঁর দুটি বিখ্যাত গল্পের নাম লেখো।
উত্তর: স্বর্ণকুমারী দেবী ‘ভারতী’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন।
• এই পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর রচিত দুটি উল্লেখযোগ্য ছোটোগল্প ‘যমুনা’ এবং ‘গহনা’।
১২. রবীন্দ্রনাথের প্রথম উপন্যাসের নাম কী? কত খ্রিস্টাব্দে এটি প্রকাশিত হয়?
উত্তর: রবীন্দ্রনাথের প্রথম উপন্যাসের নাম ‘বৌ ঠাকুরাণীর হাট’।
‘বৌ ঠাকুরাণীর হাট’ প্রকাশিত হয় ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে।
১৩. রবীন্দ্রনাথের মনস্তত্ত্বমূলক উপন্যাস কী? এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্রের নাম কী?
উত্তর: রবীন্দ্রনাথের মনস্তত্ত্বমূলক উপন্যাস হল ‘চোখের বালি’ (১৯০৩ খ্রিস্টাব্দ)।
• এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্রের নাম বিনোদিনী।
১৪. ‘মহাকাব্যিক উপন্যাস’ বলা হয় রবীন্দ্রনাথের কোন্ উপন্যাসকে? এটির প্রকাশকাল উল্লেখ করো।
উত্তর: রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ উপন্যাসকে ‘মহাকাব্যিক উপন্যাস’ বলা হয়।
উপন্যাসটির প্রকাশকাল ১৯১০ খ্রিস্টাব্দ।
১৫. সমাজ ও দেশের নিরিখে ব্যক্তির আত্মানুসন্ধান ফুটে উঠেছে, রবীন্দ্রনাথের এরকম দুটি উপন্যাসের নাম লেখো। উপন্যাস দুটির প্রকাশকাল উল্লেখ করো।
উত্তর: সমাজ ও দেশের নিরিখে ব্যক্তির আত্মানুসন্ধান ফুটে উঠেছে, রবীন্দ্রনাথের এরকম দুটি উপন্যাস হল ‘ঘরে বাইরে’ এবং ‘চার অধ্যায়’।
ঘরে বাইরে’ এবং ‘চার অধ্যায়’ উপন্যাস দুটির প্রকাশকাল যথাক্রমে ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দ এবং ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দ।
১৬. রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’ কেন উল্লেখযোগ্য? এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্রগুলির নাম উল্লেখ করো।
উত্তর: ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ গদ্য এবং কবিতাকে মিলিয়ে দিয়ে মানবিক প্রেমসম্পর্ককে এক অতুলনীয় রূপ দিয়েছেন।
এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্রগুলি হল-অমিত ও লাবণ্য।
১৭. রবীন্দ্রনাথের লেখা প্রথম ছোটোগল্প কোন্টি? এটি কোথায় প্রকাশিত হয়েছিল?
উত্তর: রবীন্দ্রনাথের লেখা প্রথম ছোটোগল্প হল ‘ভিখারিণী’।
• এটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে ‘হিতবাদী’ পত্রিকায়।
১৮. রবীন্দ্রনাথের শেষ গল্পসংকলনের নাম কী? এর অন্তর্গত গল্পগুলোর নাম উল্লেখ করো।
উত্তর: রবীন্দ্রনাথের শেষ গল্পসংকলনের নাম হল ‘তিনসঙ্গী’ (১৯৪০ খ্রিস্টাব্দ)।
• এই গল্পসংকলনের অন্তর্গত গল্পগুলির নাম-রবিবার, শেষকথা এবং ল্যাবরেটরি।
১৯. প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের লেখা দুটি ভাবগম্ভীর গল্প এবং দুটি কৌতুক-উদ্রেককারী গল্পের নাম লেখো।
উত্তর: প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের লেখা দুটি ভাবগম্ভীর গল্প ‘দেবী’, ‘আদরিণী’।
• লেখকের লেখা দুটি কৌতুক-উদ্রেককারী গল্প হল ‘বলবান জামাতা’ এবং ‘রসময়ীর রসিকতা’।
২০. শরৎচন্দ্রের লেখা প্রথম উপন্যাসের নাম কী? শরৎচন্দ্রের সৃষ্ট নারীচরিত্রগুলির বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করো।
উত্তর: শরৎচন্দ্রের লেখা প্রথম উপন্যাসের নাম হল ‘বড়দিদি’।
সমাজে সমস্ত লাঞ্ছনা এবং অসাম্যের পরেও নারীর সর্বংসহা রূপকে শরৎচন্দ্র তাঁর উপন্যাসে তুলে ধরেছেন।
২১. শরৎচন্দ্রের লেখা দুটি ছোটোগল্পের নাম লেখো। তাঁর ছোটোগল্পগুলির মূল বৈশিষ্ট্য লেখো।
উত্তর: শরৎচন্দ্রের লেখা দুটি ছোটোগল্প হল ‘মহেশ’ এবং ‘অভাগীর স্বর্গ’।
শরৎচন্দ্র তাঁর ছোটোগল্পে গ্রামের অসহায় নিরন্ন, প্রান্তিক মানুষদের দুর্দশা ও লাঞ্ছনাকে গভীর মমতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন।
২২. বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালি’ কত খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়? এই উপন্যাসে অপু-দুর্গা চরিত্র দুটি কীসের প্রতীক?
উত্তর: বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালি’ প্রকাশিত হয় ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে।
• এই উপন্যাসে অপু-দুর্গা চরিত্র দুটি জীবনের প্রতি অনন্ত কৌতূহল এবং চিরন্তন শৈশবের প্রতীক।
২৩. বাংলাদেশের বাইরে কোনো অঞ্চলের ভূপ্রকৃতি নিয়ে লেখা বিভূতিভূষণের উপন্যাসের নাম লেখো। এই উপন্যাসের কথক চরিত্রের নাম কী?
উত্তর: বাংলাদেশের বাইরে ভাগলপুর অঞ্চলের ভূপ্রকৃতি নিয়ে লেখা বিভূতিভূষণের উপন্যাসের নাম ‘আরণ্যক’।
এই উপন্যাসের কথক চরিত্রের নাম সত্যচরণ।
২৪. তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঔপন্যাসিক সত্তার দুটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করো।
উত্তর: তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঔপন্যাসিক সত্তার দুটি বৈশিষ্ট্য হল- (ক) তিনি রাঢ়বঙ্গের জনজীবনের নিপুণ কথাকার। (খ) তারাশঙ্কর ক্ষয়িষ্ণু জমিদারতন্ত্রের কথাকে তাঁর উপন্যাসে তুলে ধরেছেন।
২৫. ‘ধাত্রীদেবতা’ এবং ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’ উপন্যাস দুটি কার লেখা? কত খ্রিস্টাব্দে এগুলি প্রকাশিত হয়?
উত্তর: ‘ধাত্রীদেবতা’ এবং ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’ উপন্যাস দুটি তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা।
‘ধাত্রীদেবতা’ এবং ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’ উপন্যাস দুটি প্রকাশিত হয় যথাক্রমে ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে এবং ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে।
২৬. মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখক জীবনের দুটি পর্বের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।
উত্তর: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখক জীবনের প্রথম পর্বে মানবমনের বিচিত্র জটিলতায় আলো ফেলেছেন লেখক। দ্বিতীয় পর্বে তাঁর লেখায় দেখা যায় মার্কসীয় চেতনার বিস্তার, যার প্রভাবে তাঁর উপন্যাসে উঠে আসে শ্রেণিশোষণ এবং শ্রেণিসচেতনতার ছবি।
২৭. মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুটি উপন্যাসের নাম লেখো। উপন্যাস দুটির প্রকাশকাল উল্লেখ করো।
উত্তর: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হল ‘পদ্মানদীর মাঝি’ এবং ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’।
উপন্যাস দুটির প্রকাশকাল ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দ।
২৮. বাংলা উপন্যাসে চেতনাপ্রবাহকে বিষয় করে তুলেছিলেন কে? তাঁর লেখা দুটি উপন্যাসের নাম লেখো।
উত্তর: বাংলা উপন্যাসে চেতনাপ্রবাহকে বিষয় করে তুলছিলেন ধূর্জটিপ্রসাদ মুখ্যোপাধ্যায়।
ধূর্জটিপ্রসাদের লেখা দুটি উপন্যাস হল ‘অন্তঃশীলা’ এবং ‘আবর্ত’।
২৯. ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’ উপন্যাসটি কার লেখা? এই উপন্যাসের বিশিষ্টতা কী?
উত্তর: ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’ উপন্যাসটি সতীনাথ ভাদুড়ির লেখা।
• এই উপন্যাসে ঢোঁড়াই চরিত্রের মধ্য দিয়ে লেখক ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে প্রান্তিক শ্রমজীবী মানুষের জীবনপ্রবাহকে ফুটিয়ে তুলেছেন।
৩০. পরশুরামের লেখা দুটি গল্প-সংকলনের নাম লেখো। গল্পকার হিসেবে তাঁর বিশিষ্টতা কী?
উত্তর: পরশুরামের লেখা দুটি গল্প-সংকলন হল ‘গড্ডলিকা’ এবং ‘কজ্জলী’।
যুক্তিবাদ এবং বুদ্ধিদীপ্ত কৌতুক গল্প রচনা পরশুরামের বিশিষ্টতা।
৩১. প্রেমেন্দ্র মিত্রের লেখা দুটি গল্পগ্রন্থের নাম কী? তাঁর রচনাবৈশিষ্ট্য উল্লেখ করো।
উত্তর: প্রেমেন্দ্র মিত্রের লেখা দুটি গল্পগ্রন্থ হল ‘পঞ্চশর’ এবং ‘বেনামী বন্দর’।
• প্রেমেন্দ্র মিত্রের বিশিষ্টতা তাঁর বিষয়বৈচিত্র্যে, চরিত্রনির্মাণে এবং সংকেতময়তায়।
৩২. ‘ডানা’ এবং ‘মহাপ্রস্থানের পথে’ উপন্যাস দুটির রচয়িতাদের নাম লেখো।
উত্তর: ‘ডানা’ উপন্যাসটি রচনা করেন বনফুল এবং ‘মহাপ্রস্থানের পথে’ উপন্যাসটির রচয়িতা প্রবোধকুমার সান্যাল।
৩৩. শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুটি ঐতিহাসিক উপন্যাসের নাম লেখো। এই ধরনের উপন্যাস রচনায় তিনি কোন্ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন?
উত্তর: শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুটি ঐতিহাসিক উপন্যাস হল ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’ এবং ‘গৌড়মল্লার’।
ঐতিহাসিক আবহ তৈরি এবং চরিত্র সৃষ্টির দক্ষতা ঔপন্যাসিক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রধান বিশেষত্ব।
৩৪. ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ কার লেখা উপন্যাস? এই উপন্যাসের বিশিষ্টতা কী?
উত্তর: ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসটির রচয়িতা অদ্বৈত মল্লবর্মণ।
• তিতাসের স্রোতের সঙ্গে সাদৃশ্য রেখে মালোপাড়ার জন্ম-বিহার- মৃত্যুর সঙ্গে অন্তর্লীন জীবিকার ছবিকে প্রায় কবিতার পর্যায়ে উন্নীত করেছিলেন লেখক এই উপন্যাসে।
৩৫. সমরেশ বসু এবং কমল কুমার মজুমদারের দুটি করে উপন্যাসের নাম লেখো।
উত্তর: সমরেশ বসুর লেখা দুটি উপন্যাস হল ‘শেকল ছেড়া হাতের খোঁজে’ এবং ‘মহাকালের রথের ঘোড়া’।
কমল কুমার মজুমদারের লেখা দুটি উপন্যাস হল ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ এবং ‘তাহাদের কথা’।
৩৬. বিদ্যাসাগরের সমসাময়িক শিশুশিক্ষার গ্রন্থ রচনার জন্য কে বিখ্যাত হয়ে আছেন? তাঁর রচিত একটি পাঠ্যপুস্তকের নাম লেখো।
উত্তর: বিদ্যাসাগরের সমকালে শিশুশিক্ষার গ্রন্থ রচনার জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন মদনমোহন তর্কালঙ্কার।
• তাঁর রচিত একটি পাঠ্যপুস্তকের নাম ‘শিশুশিক্ষা’।
৩৭. শিশুদের জন্য মনোরম সচিত্র বই প্রথম কে রচনা করেন? তাঁর রচিত দুটি গ্রন্থের নাম লেখো।
উত্তর: শিশুদের জন্য মনোরম সচিত্র বই প্রথম রচনা করেন যোগীন্দ্রনাথ সরকার।
• তাঁর রচিত দুটি গ্রন্থের নাম ‘হাসিখুশি’ এবং ‘হাসিরাশি’।
৩৮. টুনটুনির বই’ ছাড়া উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর লেখা শিশুদের জন্য দুটি গ্রন্থের নাম লেখো। রায়চৌধুরী পরিবারের দুজন মহিলা শিশুসাহিত্যিকের নাম লেখো।
উত্তর: ‘টুনটুনির বই’ ছাড়া উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর লেখা শিশুদের জন্য দুটি গ্রন্থ হল ‘পান্তা বুড়ি’ এবং ‘সাক্ষীশেয়াল’।
রায়চৌধুরী পরিবারের দুজন মহিলা শিশুসাহিত্যিক হলেন সুখলতা রাও এবং পুণ্যলতা চক্রবর্তী।
৩৯. রূপকথা, ব্রতকথা, পাঁচালির গল্প ইত্যাদি নিয়ে শিশুদের জন্য সাহিত্য রচনা করেছেন এমন দুজনের নাম লেখো। তাঁদের রচিত দুটি করে গ্রন্থের নাম লেখো।
উত্তর: রূপকথা, ব্রতকথা, পাঁচালির গল্প ইত্যাদি নিয়ে শিশুদের জন্য সাহিত্য রচনা করেছেন এমন দুজন হলেন দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার এবং অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
• দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার রচিতা দুটি গ্রন্থ হল ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ এবং ‘ঠাকুরদাদার ঝুলি’। আর অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত দুটি গ্রন্থ হল ‘ক্ষীরের পুতুল’ এবং ‘রাজকাহিনি’।
৪০. ছোটোদের জন্য পত্রিকা প্রথম কে প্রকাশ করেন? পত্রিকাটির নাম কী ছিল?
উত্তর: ছোটোদের জন্য পত্রিকা প্রথম প্রকাশ করেন কেশবচন্দ্র সেন।
পত্রিকাটির নাম ছিল ‘বালকবন্ধু’ (১৮৮২ খ্রিস্টাব্দ)।
উপন্যাস ও ছোটোগল্প (Marks 3)
১. বঙ্কিমচন্দ্রের ইতিহাস ও রোমান্স-আশ্রয়ী উপন্যাস সম্পর্কে আলোচনা করো।
উত্তর: বাংলা কথাসাহিত্যকে বঙ্কিমচন্দ্রই প্রথম সৌন্দর্য ও শিল্প-সার্থকতা দান করেছিলেন। দুর্গেশনন্দিনী, কপালকুণ্ডলা, মৃণালিনী, যুগলাঙ্গুরীয়, চন্দ্রশেখর ও রাজসিংহ তাঁর ইতিহাস ও রোমান্স- আশ্রয়ী উপন্যাসের পর্যায়ে পড়ে। মোগল ও পাঠানের দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটে রচিত দুর্গেশনন্দিনী একটি রোমান্স-জাতীয় রচনা। নবকুমার-মতিবিবি-কপালকুণ্ডলার ত্রিকোণ প্রেমকাহিনিকে কেন্দ্র করে রচিত কপালকুণ্ডলা একটি বিশুদ্ধ রোমান্স। শৈবলিনীর অতৃপ্ত কামনার বিশ্বঘাতী, বিধ্বংসী রূপ লক্ষ করা যায় চন্দ্রশেখর উপন্যাসে। এর সঙ্গে উপন্যাসটিতে যুক্ত হয়েছে মীরকাশিম ও দশনী বেগমের ঐতিহাসিক প্রসঙ্গ। রাজসিংহ হল বঙ্কিমচন্দ্রের একমাত্র বিশুদ্ধ ঐতিহাসিক উপন্যাস; যা তিনি নিজেও স্বীকার করেছেন।
২. বাংলা কথাসাহিত্যে তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের অবদান আলোচনা করো।
উত্তর: তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায় অসাধারণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন, ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত তাঁর স্বর্ণলতা উপন্যাসের মাধ্যমে। উনিশ শতকের গ্রামবাংলার পটভূমিতে একান্নবর্তী পরিবারের গার্হস্থ্য জীবনের পরিচয় এই উপন্যাসে তুলে ধরেছেন তারকনাথ। সামাজিক-পারিবারিক এই কাহিনির বর্ণনায় তারকনাথ যেভাবে বাস্তবতা ফুটিয়ে তুলেছেন, সেকালের বিচারে তা সত্যিই অভিনব। স্বর্ণলতা ছাড়া তারকনাথ আরও কয়েকটি উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থ লিখেছেন। সেগুলি হল-ললিত সৌদামিনী (১৮৮২ খ্রি.), হরিষে বিষাদ (১৮৮৭ খ্রি.), তিনটি গল্প (১৮৮৯ খ্রি.) এবং অদৃষ্ট (১৮৯১ খ্রি.)। তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের এই রচনাগুলি সমকালে প্রভূত জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।
৩. বাংলা কথাসাহিত্যে ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের অবদান সংক্ষেপে আলোচনা করো।
উত্তর: ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় উদ্ভট কল্পনাকে আশ্রয় করে বাংলা সাহিত্যে এক অদ্ভুত রসের আমদানি করেন। ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় সর্বসাকুল্যে পাঁচটি উপন্যাস রচনা করেছেন। সেগুলি হল-কঙ্কাবতী (১২৯৯ বঙ্গাব্দ), সেকালের কথা (১৩০১ বঙ্গাব্দ), ফোকলা দিগম্বর (১৩০৭ বঙ্গাব্দ), ময়না কোথায় (১৩১১ বঙ্গাব্দ) ও পাপের পরিণাম (১৩১৫ বঙ্গাব্দ)। তাঁর গল্প-সংকলন চারটি-ভূত ও মানুষ (১৮৯৭ খ্রি.), মুক্তামালা (১৯০১ খ্রি.), মজার গল্প (১৯০৪ খ্রি.) ও ডমরু চরিত (১৯২৩ খ্রি.)।
বাস্তব-অবাস্তব, সম্ভব-অসম্ভব সব একাকার করে দেওয়া কঙ্কাবতী উপন্যাসটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের একটি নতুন দিকের সূচনা হয়। ডমরুধর নামক এক চরিত্রের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সাতটি সরস গল্প সংকলিত হয়েছে লেখকের ডমরু চরিত (১৯২৩ খ্রি.) গ্রন্থে। ত্রৈলোক্যনাথের আশ্চর্য সৃষ্টি ডমরু চরিত বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ।
৪. রবীন্দ্রনাথের ইতিহাসনির্ভর উপন্যাসগুলির পরিচয় দাও। এবং সামাজিক
উত্তর: ইতিহাসনির্ভর উপন্যাস: রবীন্দ্রনাথের এই পর্যায়ের দুটি উপন্যাস হল বৌঠাকুরাণীর হাট (১৮৮৩ খ্রি.) ও রাজর্ষি (১৮৮৭ খ্রি.)। ত্রিপুরা রাজবংশের এক বিশেষ সমস্যা নিয়ে রচিত হয়েছে রাজর্ষি আর বাংলাদেশের ধূপঘাটের রাজা প্রতাপাদিত্যের কাহিনি নিয়ে রচিত হয়েছে বৌঠাকুরাণীর হাট উপন্যাসটি।
সামাজিক উপন্যাস: চোখের বালি (১৯০৩ খ্রি.), নৌকাডুবি (১৯০৬ খ্রি.), যোগাযোগ (১৯২৯ খ্রি.) হল রবীন্দ্রনাথের তিনটি সামাজিক উপন্যাস। চোখের বালি উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ মানুষের মনস্তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করেছেন। যোগাযোগ উপন্যাসে দুটি মানুষ তথা পরিবারের বিপরীত রুচি, শিক্ষা-দীক্ষা, ক্ষমতা ও অহংকারের স্বরূপ প্রকাশিত হয়েছে।
৫. রবীন্দ্রনাথের স্বদেশচেতনামূলক এবং রোমান্টিক উপন্যাসগুলি নিয়ে আলোচনা করো।
উত্তর: স্বদেশচেতনামূলক উপন্যাস: রবীন্দ্রনাথের স্বদেশচেতনামূলক উপন্যাসগুলি হল গোরা (১৯১০ খ্রি.), ঘরে বাইরে (১৯১৬ খ্রি.), চার অধ্যায় (১৯৩৪ খ্রি.)। মহাকাব্যধর্মী উপন্যাস গোরায় গোরার ভারতজিজ্ঞাসা আসলে রবীন্দ্রনাথের স্বদেশসন্ধান। ঘরে বাইরে উপন্যাসটি রচিত হয়েছে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে। চার অধ্যায় উপন্যাসে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মতাদর্শ খুঁজে পাওয়া যায়।
রোমান্টিক উপন্যাস: চতুরঙ্গ (১৯১৬ খ্রি.), শেষের কবিতা (১৯২৯ খ্রি.), দুই বোন (১৯৩৩ খ্রি.), মালঞ্চ (১৯৩৪ খ্রি.) হল রবীন্দ্রনাথের লেখা কয়েকটি রোমান্টিক উপন্যাস। চতুরঙ্গ উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ অনেক রূপক বা সংকেতের ব্যবহার করেছেন।
৬. সংক্ষেপে ছোটোগল্পকার রবীন্দ্রনাথের পরিচয় দাও।
উত্তর: রবীন্দ্রনাথের হাতেই বাংলা ছোটোগল্পের প্রকৃত শিল্পরূপটি গড়ে ওঠে। বিষয়বস্তু অনুসারে রবীন্দ্রনাথের ছোটোগল্পগুলিকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা যায়-
১. প্রেমমূলক গল্প: ‘একরাত্রি’, ‘মাল্যদান’, ‘দৃষ্টিদান’, ‘মহামায়া’, ‘সমাপ্তি’, ‘মধ্যবর্তিনী’, ‘নষ্টনীড়’।
২. সমাজ-সমস্যামূলক গল্প: তাঁর সমাজ-সমস্যামূলক গল্পগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘পোস্টমাস্টার’, ‘কাবুলিওয়ালা’, ‘মাস্টারমশাই’, ‘দান-প্রতিদান’ প্রভৃতি। এ ছাড়া, ‘হৈমন্তী, ‘স্ত্রীর পত্র’, ‘পয়লা নম্বর’, ‘নামঞ্জুর গল্প’, ‘বিচারক’, ‘যজ্ঞেশ্বরের যজ্ঞ’, ‘দেনাপাওনা’ প্রভৃতি গল্পে পণপ্রথা, নারীর প্রতি অবহেলা প্রভৃতি নানান সামাজিক ব্যাধি ও কুসংস্কার সমালোচিত হয়েছে।
৩. নিসর্গ ও মানব সম্পর্কিত গল্প: ‘অতিথি’, ‘বলাই’, ‘মেঘ ও রৌদ্র’, ‘আপদ’।
৪. অতিপ্রাকৃত গল্প: রবীন্দ্রনাথের উল্লেখযোগ্য অতিপ্রাকৃত গল্পগুলি হল ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘নিশীথে’, ‘মণিহারা’, ‘গুপ্তধন’, ‘জীবিত ও মৃত’, ‘কঙ্কাল’ প্রভৃতি।
৫. অন্যান্য ধরনের গল্প: এই ধরনের রচনাসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘রবিবার’, ‘শেষকথা’, ‘ল্যাবরেটরি’ প্রভৃতি গল্প।
৭. রবীন্দ্রনাথের ছোটোগল্পের শ্রেণিবিভাগ করো।
উত্তর: যথার্থ অর্থে বাংলা ছোটোগল্পের জনক হলেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ সারাজীবন ধরে যে ১৬৪টি ছোটোগল্প লিখেছেন, রচনার ক্রম অনুযায়ী সেগুলিকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়-
১. হিতবাদী-সাধনা পর্ব: এই পর্বের উল্লেখযোগ্য গল্পগুলি হল ‘দেনাপাওনা’, ‘পোস্টমাস্টার’, ‘অতিথি’, ‘ছুটি’, ‘কাবুলিওয়ালা’, ‘মেঘ ও রৌদ্র’, ‘নষ্টনীড়’, ‘একরাত্রি’ ইত্যাদি। এই পর্বের গল্পগুলিতে বাংলা দেশের প্রকৃতি ও সাধারণ মানুষের জীবনের পরিচয় ও সামাজিক ও ব্যক্তিগত নানা সমস্যা ফুটে উঠেছে।
২. ভারতী-সবুজপত্র পর্ব: এই পর্বের উল্লেখযোগ্য গল্পগুলি হল ‘দুরাশা’, ‘বলাই’, ‘শেষের রাত্রি’, ‘হালদার গোষ্ঠী’, ‘হৈমন্তী’, ‘স্ত্রীর পত্র’ এবং ‘পয়লা নম্বর’।
৩. অন্তিম পর্ব: ‘লিপিকা’, ‘সে’, ‘গল্পসল্প’ এবং ‘তিনসঙ্গী’-এই চারটি বিচিত্র গল্পগ্রন্থের বৈচিত্র্যময় গল্পগুলি এই পর্বের অন্তর্গত।
৮. শরৎচন্দ্রের উপন্যাসগুলির শ্রেণিবিভাগ করো।
উত্তর: বিষয়বস্তুর ওপর নির্ভর করে শরৎচন্দ্রের উপন্যাসগুলিকে নিম্নলিখিত কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়-
১. পারিবারিক উপন্যাস: শরৎচন্দ্রের এই পর্যায়ের উপন্যাসগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বিন্দুর ছেলে, মেজদিদি, নিষ্কৃতি, বৈকুন্ঠের উইল ইত্যাদি।
২. প্রেমমূলক উপন্যাস: বড়দিদি, দেবদাস, পরিণীতা, দত্তা, দেনাপাওনা প্রভৃতি উপন্যাস হল শরৎচন্দ্রের বিখ্যাত প্রেমমূলক উপন্যাস ৩. আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস: শরৎচন্দ্রের আত্মজীবনী- মূলক উপন্যাসের মধ্যে এক এবং অদ্বিতীয় হল শ্রীকান্ত।
৪. রাজনৈতিক উপন্যাস: পথের দাবী হল শরৎচন্দ্রের একটি বিখ্যাত রাজনৈতিক উপন্যাস।
৫. মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস: শরৎচন্দ্রের তিনটি শ্রেষ্ঠ মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস হল গৃহদাহ, চরিত্রহীন ও শেষ প্রশ্ন।
৬. সামাজিক উপন্যাস: পল্লীসমাজ শরৎচন্দ্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সামাজিক উপন্যাস।
৯. শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো।
উত্তর: বাংলা উপন্যাসে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের (১৮৭৬-১৯৩৮ খ্রি.) অবদান অনস্বীকার্য। তাঁর উপন্যাসের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি হল-
১. দেশপ্রেম এবং অবহেলিত জনগণের প্রতি অকৃত্রিম অনুরাগ।
২. বাঙালির দুঃখ-দারিদ্র্য ও মর্মবেদনাকে চোখের জলে, প্রেমের মাধুর্যে এবং জীবনদর্শনের গভীরতায় রূপায়ণ।
৩. নিষ্ঠুর হৃদয়হীনতাকে অভিযুক্ত করার পাশাপাশি সামাজিক মূঢ়তা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে এবং দেশপ্রেমের নামে ভণ্ডামির বিরুদ্ধে সোচ্চার।
৪. নারীমনের জটিলতা, তাদের সংস্কার ও প্রেমের দ্বন্দ্ব, যৌথ পরিবারের দৈনন্দিন জীবনচিত্র এবং সেখানে নারীদের স্থানকে তুলে ধরা।
৫. গল্প বলার সহজসরল অথচ চিত্তাকর্ষক রীতি।
১০. গল্পকার হিসেবে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পরিচয় দাও।
উত্তর: কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৬-১৯৩৮) কেবল একজন ঔপন্যাসিক নন, ছোটোগল্পকার হিসেবেও বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। গ্রামের অসহায় নিরন্ন প্রান্তিক মানুষের দুর্দশা এবং লাঞ্ছনা তাঁর গল্পের বিষয় হয়ে উঠেছে। শরৎচন্দ্রের প্রথম গল্প ‘মন্দির’ কুন্তলীন পুরস্কার পেয়েছিল।
গল্পগ্রন্থ: ‘মন্দির’ (১৯০৩), ‘বড়দিদি’ (১৯০৭), ‘বিন্দুর ছেলে’ (১৯১৪), ‘দর্পচূর্ণ’ (১৯১৫), ‘অনুপমার প্রেম’ (১৯০৭), ‘আলো ও ছায়া’ (১৯১৭), ‘কাশীনাথ’ (১৯১৭), ‘স্বামী’ (১৯১৮), ‘সতী’ (১৯৩৪), ‘অনুরাধা’ (১৯৩৪)।
ছোটোগল্প: ‘মহেশ’, ‘অভাগীর স্বর্গ’, ‘বিলাসী’, ‘বাল্যস্মৃতি’, ‘হরিচরণ’, ‘ছবি’, ‘মামলার ফল’, ‘হরিলক্ষ্মী’, ‘অনুরাধা’, ‘পরেশ’, ‘লালু’, ‘ছেলেধরা’, ‘বছর পঞ্চাশ পূর্বের একটা দিনের কাহিনি’, ‘দেওঘরের স্মৃতি’ ইত্যাদি।
ছোটোগল্পের সীমিত পরিসরকে শরৎচন্দ্র উপেক্ষা করেছেন, এমনকি গল্পের অতর্কিত পরিসমাপ্তি কিংবা অপ্রাপ্তির বোধ তাঁর গল্পে সবসময় আসেনি। একদিকে প্রেমের বিচিত্র জটিল রহস্য, অন্যদিকে পারিবারিক বিরোধ, সংঘর্ষের পটভূমি তাঁর গল্পের বিষয় হয়ে উঠেছে। ঘরোয়া জীবনের চিত্রণে শরৎচন্দ্রের গল্পগুলি তাঁর নিজস্ব রচনাদক্ষতার পরিচয় বহন করে।
১১. বাংলা ছোটোগল্পে পরশুরামের অবদান আলোচনা করো।
উত্তর: পরশুরাম (১৮৮০-১৯৬০ খ্রি.) ছদ্মনামে বাংলা কথাসাহিত্যে স্মরণীয় হয়ে আছেন রাজশেখর বসু। ৯৭টি গল্প এবং নয়টি গল্পগ্রন্থের রচয়িতা তিনি। এসব গল্পে চরিত্রের আচার ব্যবহার, সংলাপ প্রভৃতির মাধ্যমে অসাধারণ কৌতুকরস সৃষ্টি করেছেন পরশুরাম। গড্ডলিকা, কজ্জলী, হনুমানের স্বপ্ন ইত্যাদি গল্প, ধুস্তরী মায়া ইত্যাদি গল্প, নীলতারা ইত্যাদি গল্প প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযোগ্য গল্পসংকলন।
মানুষের জোচ্চুরি, ভন্ডামি প্রভৃতির বিরুদ্ধে পরশুরামের কৌতুককর আক্রমণ শানিত হয়েছে ‘বিরিঞ্চিবাবা’, ‘কচি সংসদ’, ‘মহাবিদ্যা’, ‘উলটপুরাণ’ প্রভৃতি গল্পে। ‘বিরিঞ্চিবাবা’ গল্পে সমাজের মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে বাসা বেঁধে থাকা ধর্মান্ধতাকে ব্যঙ্গ করা হয়েছে। ‘কচি সংসদ’-এ তৎকালীন নতুন ধারার কবিদের মেয়েলিপনাকে কটাক্ষ করা হয়েছে। বিশ্বযুদ্ধোত্তর বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের আচার- আচরণের অসংগতি নিয়ে বৈঠকি মেজাজে পরশুরাম রচনা করেছেন লম্বকর্ণ’, ‘দক্ষিণ রায়’, ‘স্বয়ংবরা’, ‘মহেশের মহাযাত্রা’ গল্প। ‘জাবালি’, ‘পাঞ্চালী’, ‘হনুমানের স্বপ্ন’, ‘তৃতীয় দ্যূতসভা’ প্রভৃতি পুরাণ-কাহিনিনির্ভর গল্পে আমরা পাই লেখকের সংস্কারমুক্ত, আধুনিক কৌতুকময়তা।
১২. বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো। অথবা, বাংলা উপন্যাসে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবদান সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
উত্তর : বিভূতিভূষণ যেসব উপন্যাস রচনা করেছেন সেগুলির মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল-পথের পাঁচালী, অপরাজিত (১ম ও ২য় খন্ড), দৃষ্টিপ্রদীপ, আরণ্যক, আদর্শ হিন্দু হোটেল, দেবযান, ইছামতী, অশনি সংকেত ইত্যাদি।
বিভূতিভূষণের প্রথম উপন্যাস পথের পাঁচালী (১৯২৯ খ্রি.) গ্রামবাংলার প্রকৃতি, ছোটো ছোটো সুখ-দুঃখ ভরা প্রাত্যহিক জীবন আর একটি স্বপ্নময় বালকের বিস্ময়কর কাহিনি। এর পরবর্তী অংশ অপরাজিত (১৯৩২ খ্রি.)-সহ পথের পাঁচালী-কে মহাকাব্যধর্মী উপন্যাস বলা যেতে পারে।
আরণ্যক (১৯৩৯ খ্রি.) উপন্যাসে লেখক বিহারের হাজারিবাগ অঞ্চলের লবটুলিয়া, নাড়া-বইহারের রুক্ষ প্রকৃতিকে সাহিত্যের বিষয় করে তুলেছেন। দেবযান-এর কল্পলোকে তিনি খুঁজে নিতে চেয়েছেন জীবনের আনন্দকে। বিশেষ সময়ের পটভূমিতে গ্রামীণ জীবনের ইতিহাস রচিত হয়েছে বিভূতিভূষণের ইছামতী (১৯৫০ খ্রি.) উপন্যাসে। চেনা পৃথিবীর প্রকৃতিজগৎ এবং মনুষ্য-হৃদয়কে অবলম্বন করেই তিনি পাঠককুলকে নিয়ে গেছেন রহস্যময় সৌন্দর্যের অমরাবতীতে।
১৩. বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটোগল্পগুলি বিষয়ে আলোচনা করো।
উত্তর: রবীন্দ্র-পরবর্তী বাংলা কথাসাহিত্যে, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০) এক অন্য ধরনের লেখকরূপে দেখা দেন। এই অন্য ধরনের কারণ হল, আসন্ন বিশ্বযুদ্ধের সমাজ-পরিবেশ তরুণ লেখকেরা যখন রবীন্দ্র-বিরোধিতায়, দেশ-মানুষ-ঈশ্বর সম্পর্কে নানাবিধ প্রশ্নে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছেন, বিশ্বাসহীনতায় ভুগছেন, সেই সময়ে বিভূতিভূষণ পল্লিগ্রাম, অরণ্য ও নিসর্গ প্রকৃতির মধ্যে বিস্ময় ও মুগ্ধতার নতুন বার্তা শোনালেন। বিভূতিভূষণের প্রথম গল্প ‘উপেক্ষিতা’ প্রকাশিত হয়েছিল ‘প্রবাসী’ পত্রিকায়। বিভূতিভূষণের প্রকাশিত গল্পের সংখ্যা ২২৪ এবং গল্পগ্রন্থের সংখ্যা ১৯।
গল্পগ্রন্থ: ‘মেঘমল্লার’ (১৯৩১), ‘মৌরীফুল’ (১৯৩২), ‘যাত্রাবদল’ (১৯৩৪), ‘কিন্নরদল’ (১৯৩৮), ‘বেনীগীর ফুলবাড়ি’ (১৯৪১), ‘নবাগত’ (১৯৪৪), ‘উপলখণ্ড’ (১৯৪৫), ‘বিধু মাস্টার’ (১৯৪৫), ‘ক্ষণভঙ্গুর’ (১৯৪৫), ‘অসাধারণ’ (১৯৪৬), ‘মুখোশ ও মুখশ্রী’ (১৯৪৭), ‘নীলগঞ্জের ফালমন সাহেব’ (১৯৪৮), ‘জ্যোতিরিঙ্গন’ (১৯৪৯), ‘কুশল পাহাড়ী’ (১৯৫০) প্রভৃতি। এ ছাড়া বিভূতিভূষণ শিশুসাহিত্য, ডায়ারি বা দিনলিপি, ভ্রমণকাহিনি, বিবিধ গ্রন্থ, বারোয়ারি উপন্যাস ইত্যাদি রচনা করেছেন। তাঁর গল্পগুলির মধ্যে ‘উপেক্ষিতা’, ‘মৌরিফুল’, ‘ডাইনি’ ইত্যাদি হল চরিত্রনির্ভর গল্প। ‘পুঁইমাচা’, ‘বাক্সবদল’, ‘খুকির কাণ্ড’ ইত্যাদি কাহিনিনির্ভর গল্প, ‘বউচণ্ডীর মাঠ’, ‘অভিশপ্ত’, ‘খুঁটিদেবতা’ ইত্যাদি গল্পে পাওয়া যায় অলৌকিক রস। ‘মেঘমল্লার’, ‘নাস্তিক’, ‘স্বপ্ন’ ইত্যাদির মধ্যে রয়েছে রোমান্টিকতা।
বিভূতিভূষণের ছোটোগল্পে পল্লির গার্হস্থ্য জীবনের ছবি প্রকাশিত হয়েছে, যা আমাদের অতি পরিচিত এবং মানবধর্মে যা বাস্তব শুধু প্রকৃতির সংলগ্নতায় নয় বিভূতিভূষণের চরিত্রগুলো অনেক বেশি প্রাকৃতিক। মানুষ এবং নিসর্গ সেখানে যেন এক বিন্দুতে মিলে গিয়েছে। প্রথাগত জীবনের আড়ালে এক আনন্দময় জীবনকে খোঁজার চেষ্টা করেছেন বিভূতিভূষণ।
১৪. তারাশঙ্করের তিনটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের নাম উল্লেখ করে বাংলা উপন্যাসের ক্ষেত্রে বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিশিষ্টতা নির্দেশ করো।
অথবা, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
উত্তর: তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের তিনটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হল- ধাত্রীদেবতা (১৯৩৯ খ্রি.), হাঁসুলি বাঁকের উপকথা (১৯৪৭ খ্রি.), আরোগ্য নিকেতন (১৯৫৩ খ্রি.)।
তারাশঙ্করের উপন্যাস এক অস্থির সময়ের প্রতিনিধিত্ব করে। জমিদারতন্ত্র ক্রমশ ভেঙে পড়ছে, পুরোনো মূল্যবোধের অবক্ষয় দেখা দিচ্ছে আর তার জায়গা নিচ্ছে নতুন আদর্শ, নতুন সমাজবিন্যাস। তারাশঙ্করের ধাত্রীদেবতা উপন্যাসে প্রকাশিত হয়েছে এই রূপান্তরের ছবি। দ্বিতীয়ত, তারাশঙ্করের উপন্যাসের বিশেষত্ব তার আঞ্চলিকতায়। রাঢ় অঞ্চলের ভূগোল এবং তার জীবনধারা শিকড়সমেত উঠে এসেছে তারাশঙ্করের রচনায়। হাঁসুলী বাঁকের উপকথা যার উদাহরণ। তারাশঙ্করের তৃতীয় পর্বের উপন্যাসগুলির মধ্যে শ্রেষ্ঠ রচনা আরোগ্য নিকেতন। জীবন ও মৃত্যুর একই সঙ্গে অবস্থান এবং মৃত্যুর হিমশীতল স্পর্শকে অনুভব করার অভিজ্ঞতা এই উপন্যাসে চিত্রিত হয়েছে।
১৫. “বাংলা উপন্যাসের বিচিত্র পটভূমিকা রচনায় ঔপন্যাসিক তারাশঙ্কর বিশিষ্ট হয়ে আছেন।” -‘বিচিত্র পটভূমিকা’-র উল্লেখ করে এ ধরনের উপন্যাসগুলির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।
উত্তর: পুরাতন গ্রামীণ জমিদারি ব্যবস্থা বিদায় নিচ্ছে, আর সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে আসছে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা। সমাজের এই মূলগত পরিবর্তন তারাশঙ্কর অপূর্ব দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর বেশিরভাগ উপন্যাসে।
এই ‘বিচিত্র পটভূমিকা’ রচিত হয়েছে তারাশঙ্করের যেসব উপন্যাসে, সেগুলি হল নীলকণ্ঠ (১৯৩৩ খ্রি.), ধাত্রীদেবতা (১৯৩৯ খ্রি.), কালিন্দী (১৯৪০ খ্রি.), গণদেবতা (১৯৪২ খ্রি.), পঞ্চগ্রাম (১৯৪৪ খ্রি.), মন্বন্তর (১৯৪৪ খ্রি.), হাঁসুলী বাঁকের উপকথা (১৯৪৭ খ্রি.) ইত্যাদি। এইসব উপন্যাস একইসঙ্গে বিংশ শতাব্দীর বাঙালির জীবনচিত্রও বটে।
মন্বন্তর উপন্যাসে দুর্ভিক্ষপীড়িত, অস্থিচর্মবিশিষ্ট জনসাধারণের কলকাতা অভিযান এবং শহরজীবনের নেতিবাচক অভিজ্ঞতা মূর্ত হয়ে উঠেছে। হাঁসুলী বাঁকের উপকথা উপন্যাসে সমাজে পতিত মানুষদের জীবনপ্রণালী, সমাজব্যবস্থা, রীতিনীতি, আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসার মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়েছে সমকালীন গ্রামসমাজের চিত্র। পঞ্চগ্রাম উপন্যাসে ক্ষয়িয়ু সামন্ততন্ত্রের অন্তঃসারশূন্যতা গ্রামীণ সমাজকে এক ভয়ংকর পরীক্ষার সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। অবস্থাপন্ন চাষি পরিবার কীভাবে দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত হয়ে ছন্নছাড়া ভবঘুরের জীবন বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে, সেই করুণ কাহিনি বর্ণনা করা হয়েছে নীলকণ্ঠ উপন্যাসে। তবে এই শ্রেণির শ্রেষ্ঠ উপন্যাস হল গণদেবতা, যেখানে বিংশ শতাব্দীর গ্রামজীবনের এক মহাকাব্য রচনা করেছেন লেখক তারাশঙ্কর।
এই ধরনের উপন্যাসগুলির কোনো-কোনোটিতে রাঢ় অঞ্চলের পতিত শ্রেণির মানুষের জীবন যেমন বর্ণিত হয়েছে, তেমনই আবার কোথাও গ্রামের সাধারণ মানুষের সামাজিক সংকটও ফুটে উঠেছে।
১৬. ছোটোগল্পকার তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচয় দাও।
উত্তর: রবীন্দ্র-পরবর্তী কালের একজন অসাধারণ কথাকার হলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৮-১৯৭১)। বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ- শরৎচন্দ্রের বিশেষ উত্তরাধিকার নিয়ে জন্মেছিলেন তিনি। বাস্তবিক, তিনি এক ব্যতিক্রমী ঔপন্যাসিক। বীরভূমের রাঢ় অঞ্চলের মাটির গন্ধ গায়ে মেখে সাহিত্যের আসরে নেমেছিলেন তিনি। বিচিত্র মানবগোষ্ঠী, কৌম সংস্কৃতি ও সভ্যতা, তাদের জীবনযাপন, আনন্দ- বেদনা, এ অঞ্চলের বিচিত্র রুক্ষ প্রকৃতি, ঐতিহ্য ও কৃষ্টি তাঁর রচনায় স্বমহিমায় উদ্ভাসিত। কথাকার তারাশঙ্কর কয়েকশো ছোটোগল্পেরও সার্থক স্রষ্টা। এই গল্পগুলি ৫৩টি গ্রন্থে সংকলিত হয়। সাহিত্যিকরূপে তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটে ছোটোগল্প রচনার সূত্রে। কল্লোল পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল তারাশঙ্করের প্রথম ছোটোগল্প ‘রসকলি’। তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থগুলির মধ্যে আছে-‘ছলনাময়ী’ (১৯৩৬), ‘জলসাঘর’ (১৩৪৪ বঙ্গাব্দ), ‘তিন শূন্য’ (১৯৪১), ‘প্রতিধ্বনি’ (১৯৪৩), ‘বেদেনী’ (১৩৪৭ বঙ্গাব্দ), ‘হারানো সুর’ (১৩৫২ বঙ্গাব্দ), ‘কামধেনু’ (১৩৫৫ বঙ্গাব্দ), ‘তারাশঙ্করের শ্রেষ্ঠগল্প’ (১৩৫৪ বঙ্গাব্দ), ‘স্ব-নির্বাচিত গল্প’ (১৩৬১ বঙ্গাব্দ), ‘বিষপাথর’ (১৩৬৪ বঙ্গাব্দ), ‘প্রেমের গল্প’ (১৩৬৫ বঙ্গাব্দ), ‘পৌষলক্ষ্মী’ (১৯৬০), ‘গল্প-পঞ্চাশ’ (১৩৭০ বঙ্গাব্দ), ‘দীপার প্রেম’ (১৩৭৩ বঙ্গাব্দ) ‘রহস্যময়ী’ (১৩৭৪ বঙ্গাব্দ), ‘এক পশলা বৃষ্টি’ (১৯৪৩), ‘গল্পসঞ্চয়ন’ (১৩৬১ বঙ্গাব্দ), ‘বিস্ফোরণ’ (১৩৬২ বঙ্গাব্দ), ‘তারাশঙ্করের প্রিয় গল্প’ (১৩৬০ বঙ্গাব্দ), ‘শ্রীপঞ্চমী’ (১৩৫৪ বঙ্গাব্দ), ‘রামধনু’ (১৩৫৪ বঙ্গাব্দ), ‘তমসা’ (১৩৭০ বঙ্গাব্দ), ‘একটি প্রেমের গল্প’ (১৩৭১ বঙ্গাব্দ) ইত্যাদি।
তারাশঙ্করের গল্পে রয়েছে জীবনবোধের ব্যাপ্তি, নাটকীয়তা এবং সমাজের নিম্নস্তরের মানুষের জীবনযাত্রার রূপায়ণ। তাঁর প্রথম দিককার গল্পে যেমন বৈয়ব ভাবনার প্রকাশ দেখা যায় ‘রসকলি’, ‘রাইকমল’, ‘হারানো সুর’ ইত্যাদি গল্পে, সেরকমই গ্রামীণ জীবনে জমিদারদের অহংকার নিয়ে রচিত ‘জলসাঘর’, ‘রায়বাড়ি’ ইত্যাদি গল্প। বীরভূমের গ্রামীণ সমাজে ব্রাহ্মণ ও অন্ত্যজ উভয় শ্রেণির ছবি উঠে আসে তারাশঙ্করের লেখায়। তারাশঙ্করের গল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্যই হল তার বিষয়বৈচিত্র্য। একদিকে নিটোল কাহিনি এবং কাহিনিতে অনিবার্য গতি, দ্বিতীয়ত ঘটনার মধ্যে চমক ও নাটকীয়তা, তৃতীয়ত চরিত্রের জটিল মনস্তত্ত্ব এইসব নিয়ে তারাশঙ্করের গল্পগুলি বাংলা সাহিত্যের অসামান্য সম্পদ হয়ে উঠেছে।
১৭. বাংলা কথাসাহিত্যে বনফুলের অবদান আলোচনা করো।
উত্তর: ছোটোগল্প এবং উপন্যাস রচনা উভয়ক্ষেত্রেই বনফুল ছিলেন সমান স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল। তাঁর আসল নাম বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়। বনফুলের ছোটোগল্পগুলি বাহুল্যহীন এবং ব্যঞ্জনাধর্মী। সিরিয়াস বিষয় নিয়ে তিনি যেমন লিখেছেন, তেমনই জীবনের অতি তুচ্ছ বিষয়কে অবলম্বন করেও বহু শিল্পসার্থক ছোটোগল্প রচনা করেছেন। বনফুলের ছোটোগল্প সংকলনগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল-বাহুল্য (১৯৪৩ খ্রি.), বিন্দু বিসর্গ (১৯৪৪ খ্রি.), অনুগামিনী (১৯৪৭ খ্রি.), ঊর্মিমালা (১৯৫৫ খ্রি.) এবং সপ্তমী (১৯৬০ খ্রি.)।
বনফুলের উপন্যাসের সংখ্যা প্রায় পঞ্চাশ। তৃণখণ্ড (১৯৩৫ খ্রি.), মৃগয়া (১৯৪০ খ্রি.), সে ও আমি (১৯৪৩ খ্রি.), জঙ্গম (৩ খণ্ড, ১৯৪৩-১৯৪৫ খ্রি.), ডানা (৩ খণ্ড, ১৯৪৮-১৯৫৫ খ্রি.), স্থাবর (১৯৫১ খ্রি.), ভুবনসোম (১৯৫৬ খ্রি.), সীমারেখা (১৯৬০ খ্রি.), হাটে-বাজারে (১৯৬১ খ্রি.) প্রভৃতি তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস। মৃগয়া উপন্যাসের সঙ্গে কাব্য এবং নাটকের শৈলীকে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। জঙ্গম উপন্যাসে বিবৃত হয়েছে আধুনিক জীবনের বিচিত্র জটিল কাহিনি। মানুষের আদিম মনস্তত্ত্বের সন্ধান পাওয়া যায় স্থাবর উপন্যাসে। ডানা উপন্যাসে লেখকের পক্ষীবিদ্যা বিষয়ক গভীর জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায়।
১৮. বনফুলের ছোটোগল্পের বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে আলোচনা করো।
উত্তর: সহজ, সরল ও বাহুল্য বর্জিত ভাষায় লেখা প্রায় ছ-শোর মতো ছোটোগল্পের রচয়িতা বনফুল। তাঁর আটটি ছোটোগল্প সংকলনের নাম হল ঊর্মিমালা, অনুগামিনী, সপ্তমী, দূরবীণ, মণিহারা, এক ঝাঁক খঞ্জন, বহুবর্ণ ও বনফুলের নতুন গল্প। তাঁর ছোটোগল্পগুলির যেসব বৈশিষ্ট্য খুব সহজেই পাঠকের নজরে পড়ে, সেগুলি হল-
১. তীক্ষ্ণ বিচারবোধ, সংযম ও বিশ্লেষণী ক্ষমতায় জীবনকে ঘুরিয়ে- ফিরিয়ে তাঁর ছোটোগল্পে দেখিয়েছেন, তা নিয়ে কৌতুক করেছেন, ব্যঙ্গের চাবুকে খুলে দিয়েছেন ভণ্ডামির মুখোশ।
২. বনফুলের গল্পে ঘটনার চমৎকারিত্ব থাকলেও চরিত্রসৃষ্টিতেও লেখক ছিলেন মনোযোগী।
৩. গল্পের পরিবেশ-পরিস্থিতি সৃজনেও দক্ষতা দেখিয়েছেন বনফুল।
৪. গল্পের একেবারে শেষে পাঠককে আকস্মিক অভিঘাতে চমকে দেওয়া বনফুলের ছোটোগল্পের একটি অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য।
১৯. বাংলা কথাসাহিত্যে প্রেমেন্দ্র মিত্রের অবদান আলোচনা করো।
উত্তর: আধুনিক কথাসাহিত্যের ক্ষেত্রে প্রেমেন্দ্র মিত্রের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বেনামী বন্দর (১৯৩০ খ্রি.), পুতুল ও প্রতিমা (১৯৩২ খ্রি.), মৃত্তিকা (১৯৩২ খ্রি.), মহানগর (১৯৪৩ খ্রি.) প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযোগ্য গল্প সংকলন। বিষয় হিসেবে কঠোর বাস্তবকে তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর ছোটোগল্পে। ‘হয়তো’, ‘স্টোভ’, ‘শৃঙ্খল’ ইত্যাদি গল্পে রয়েছে মধ্যবিত্তের মূল্যবোধের ভাঙনের ছবি, ‘শুধু কেরানী’ গল্পে বিবৃত হয়েছে নিম্নবিত্ত জীবনের ব্যর্থতার কাহিনি, ‘পুন্নাম’ গল্পে বেঁচে থাকার জন্য বিবেকহীন হয়ে ওঠার কাহিনি স্থান পেয়েছে। প্রথম উপন্যাস পাঁক (১৯২৬ খ্রি.)-এর মধ্য দিয়েই প্রেমেন্দ্র মিত্র আধুনিক কথাসাহিত্যের জগতে পরিচিত হয়ে ওঠেন। বস্তিজীবনের করুণ অসহায়তা এবং ক্লেদাক্ত গোপনীয়তা এই উপন্যাসের মূল বিষয়। তাঁর মিছিল, কুয়াশা, ভাবীকাল, যোগাযোগ প্রভৃতি উপন্যাসে নাগরিক জীবনের ক্ষোভ ও মনোবেদনা ফুটে উঠেছে।
২০. প্রেমেন্দ্র মিত্র রচিত দুটি ছোটোগল্পের নাম উল্লেখ করে ছোটোগল্প রচনায় তাঁর বিশিষ্টতা সম্পর্কে আলোচনা করো।
উত্তর: প্রেমেন্দ্র মিত্রের দুটি উল্লেখযোগ্য ছোটোগল্প হল ‘শুধু কেরানী’ এবং ‘পুন্নাম’।
কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র ছিলেন কল্লোল গোষ্ঠীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছোটোগল্পকার। তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য ছোটোগল্প-গ্রন্থগুলি হল বেনামী বন্দর (১৯৩০ খ্রি.), পুতুল ও প্রতিমা (১৯৩১ খ্রি.), মৃত্তিকা (১৯৩৫ খ্রি.), পঞ্চশর (১৯৩৪ খ্রি.), সপ্তপদী (১৯৫৩ খ্রি.), নানা রঙে বোনা (১৯৬০ খ্রি.), ধূলিধূসর (১৯৩৮ খ্রি.) এবং মহানগর (১৯৪৩ খ্রি.)।
কল্লোল-গোষ্ঠীর অন্যান্য লেখকদের মতো তাঁর গল্পেও অবশ্য আমরা পেয়ে যাই কঠিন বাস্তবতা এবং বুদ্ধির প্রখরতা। তাঁর ‘হয়তো’ ‘স্টোভ’, ‘শৃঙ্খল’, ‘মহানগর’ ইত্যাদি গল্পে রয়েছে মধ্যবিত্তের মূল্যবোধের ভাঙনের ছবি। ‘শুধু কেরানী’ গল্পে পাই মধ্যবিত্তসুলভ মানসিকতার করুণ ছবি। ‘পুন্নাম’ গল্পে রূপায়িত হয়েছে বিবেকহীনতা ও প্রতারণার বিষাদময় রূপ, ‘বিকৃত ক্ষুধার ফাঁদে’ গল্পে পাই অসহায় বীভৎসতার চিত্র। ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’ গল্পে পাওয়া যায় মধ্যবিত্ত মানসিকতার এক গল্পকথককে, যিনি এক অদ্ভুত কাপুরুষতা ও স্বার্থপরতার বশবর্তী হয়ে অতি সহজেই ভুলে যেতে পারেন একটি অসহায় মেয়েকে দেওয়া তাঁর প্রতিশ্রুতির কথা। ‘শৃঙ্খল’ গল্পে রয়েছে মৃত দাম্পত্যজীবনের বাধ্যতামূলক ভারবহনের করুণ চিত্র। আশ্চর্য-সহজ এক অনাড়ম্বর ভাষায় প্রেমেন্দ্র মিত্র তাঁর গল্পে কঠোর বাস্তবকেই প্রধান অবলম্বন করলেও তাঁর রচনায় আমরা একটি আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সাক্ষাৎ পেয়ে যাই।
২১. বাংলা উপন্যাস-সাহিত্যের ইতিহাসে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্থান নির্দেশ করো।
অথবা, বাংলা উপন্যাস রচনায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বৈশিষ্ট্যগুলির উল্লেখ করো।
উত্তর: ঔপন্যাসিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখক জীবনের প্রথম পর্ব ফ্রয়েড প্রভাবিত আর দ্বিতীয় পর্ব মার্কস প্রভাবিত। তাঁর কাব্যগুণান্বিত দিবারাত্রির কাব্য (১৯৩৫ খ্রি.) উপন্যাসকে বলা হয়ে থাকে ‘জটিল-কুটিল মননের আশ্চর্য শিল্পরূপ’। হেরম্ব-সুপ্রিয়া- আনন্দের ত্রিমুখী টানাপোড়েনে মানসিক দ্বন্দ্ব এই উপন্যাসে বিস্তার লাভ করেছে। পুতুলনাচের ইতিকথা (১৯৩৬ খ্রি.) উপন্যাসটিতে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় গাওদিয়া নামে একটি গ্রামের জীবনযাত্রা- প্রণালী এবং তৎকালীন পল্লিসমাজের একটি বিশেষ রূপ প্রকাশ করেছেন। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাসে পদ্মাতীরবর্তী জেলে পাড়ার মাঝিদের দুঃসাহসিক জীবনসংগ্রামের বর্ণনা আর পূর্ববঙ্গীয় কথ্যভাষার সুষ্ঠু প্রয়োগ এই উপন্যাসটিকে বিশিষ্ট করে তুলেছে।
দ্বিতীয় পর্বে প্রকাশিত শহরতলী (১৯৪০-৪১ খ্রি.) উপন্যাসে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তুলে ধরেছেন পুঁজিপতি আর মেহনতি মানুষের দ্বন্দ্বের চিত্র। সোনার চেয়ে দামী, চিহ্ন, ইতিকথার পরের কথা ইত্যাদি উপন্যাসে সেই মার্কসীয় জীবনদর্শনেরই প্রকাশ ঘটেছে।
২২. গল্পকার হিসেবে মানিক বন্দ্যেপাধ্যায়ের অবদান আলোচনা করো।
উত্তর: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যজগতে প্রথম আবির্ভাব ছোটোগল্পকার হিসেবে। ‘অতসী মামী’ তাঁর প্রথম ছোটোগল্প। ‘কল্লোলের কুলবর্ধন’ মানিকের জীবনের অভিজ্ঞতা, সমাজবোধ, সমকাল সম্পর্কে সচেতনতা, মানুষ সম্পর্কে আশ্চর্য কৌতূহল তাঁকে ছোটোগল্পকার হিসেবে স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে। বাংলা ছোটোগল্পের বিষয় পরিধি বৃদ্ধিতে তাঁর ভূমিকা বিস্ময়কর। উপন্যাসের মতোই ছোটোগল্পে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এক স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব। ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায় তাঁর প্রথম গল্প ‘অতসী মামী ও অন্যান্য গল্প’ প্রকাশিত হয় ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পের সংখ্যা প্রায় ২০০ এবং গল্পগ্রন্থের সংখ্যা ১৬।
গল্পগ্রন্থ: ‘অতসী মামী ও অন্যান্য গল্প’ (১৯৩৫), ‘প্রাগৈতিহাসিক’ (১৯৩৭), ‘মিহি ও মোটা কাহিনী’ (১৯৩৮), ‘সরীসৃপ’ (১৯৩৯), ‘বৌ’ (১৯৪০), ‘সমুদ্রের স্বাদ’ (১৯৪৩), ‘ভেজাল’ (১৯৪৪), ‘হলুদপোড়া’ (১৯৪৫), ‘আজ কাল পরশুর গল্প’ (১৯৪৬), ‘পরিস্থিতি (১৯৪৬), ‘খতিয়ান’ (১৯৪৭), ‘মাটির মাশুল’ (১৯৪৮), ‘ছোটবড়’ (১৯৪৮), ‘ছোট বকুলপুরের যাত্রী’ (১৯৪৯), ‘লাজুকলতা’ (১৯৫৪) প্রভৃতি।
স্বপ্নভঙ্গ, হতাশা এবং নিঃসঙ্গতাবোধ তাঁর গল্পে বারে বারে এসেছে। ভদ্র মধ্যবিত্ত জীবনের আপাত ভদ্রতার আড়ালে যে হিংস্র স্বরূপ আছে তাকে উদ্ঘাটন করেছেন গল্পকার। আবার রাজনৈতিক- সামাজিক অস্থিরতা, আকাল-দাঙ্গা-রেশন-লঙ্গরখানা-ব্ল্যাক মার্কেট অধ্যুষিত পরিবেশে মানুষের যে জীবন সংগ্রাম তাকেও মানিক রূপ দিয়েছেন তাঁর ছোটোগল্পে।
২৩. সূচনাকালে বাংলা শিশুসাহিত্য সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত নিবন্ধ রচনা করো।
উত্তর: অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত বাংলায় শিশুসাহিত্য প্রায় কিছুই রচিত হয়নি। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠার পর এদেশে শিশুপাঠ্য লেখার প্রথম প্রয়াস লক্ষ করা যায়। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন মদনমোহন তর্কালঙ্কারের শিশুশিক্ষা গ্রন্থের কথা। শিশুদের অক্ষর পরিচয়ের জন্য বিদ্যাসাগর লিখলেন বর্ণপরিচয়। তাদের নৈতিক চরিত্র দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজনে এরপর তিনি স্কুল-পাঠ্য হিসেবে রচনা করলেন আখ্যানমঞ্জরী, বোধোদয়, কথামালা প্রভৃতি। অক্ষয় দত্তের চারুপাঠও এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য। শিশুদের অক্ষর পরিচয়কে আরও আনন্দময় করে তুলতে যোগীন্দ্রনাথ সরকার তাঁর বইকে করে তুললেন সচিত্র। তাঁর রচিত কয়েকটি বিখ্যাত গ্রন্থ হল- হাসিখুশি, হাসিরাশি, ছবি ও গল্প, হাসিখেলা। লক্ষণীয়, প্রথম পর্যায়ে শিশুদের বইগুলি কিন্তু মোটেও মৌলিক ছিল না, তা ছিল নানা লোককথা বা সংস্কৃত, ইংরেজি বা হিন্দি গ্রন্থের অনুবাদ।
উপন্যাস ও ছোটোগল্প (Marks 5)
১. বঙ্কিমচন্দ্রের সামাজিক ও পারিবারিক সমস্যামূলক উপন্যাস এবং তত্ত্বমূলক ও দেশাত্মবোধক উপন্যাসগুলি আলোচনা করো।
উত্তর: সামাজিক ও পারিবারিক সমস্যামূলক উপন্যাস: বঙ্কিমচন্দ্রের সামাজিক ও পারিবারিক সমস্যামূলক উপন্যাসগুলি হল বিষবৃক্ষ, কৃষ্ণকান্তের উইল, ইন্দিরা, রজনী এবং রাধারাণী। সমাজ ও পরিবারের নানান সমস্যা, সমাজের সঙ্গে ব্যক্তির দ্বন্দ্ব, নরনারীর সম্পর্কের জটিলতা এইসব উপন্যাসে চমৎকারভাবে ধরা পড়েছে।
তত্ত্বমূলক ও দেশাত্মবোধক উপন্যাস: বঙ্কিমচন্দ্রের তত্ত্বমূলক ও দেশাত্মবোধক উপন্যাসগুলি হল আনন্দমঠ, দেবী চৌধুরাণী ও সীতারাম। আনন্দমঠ উপন্যাসে ব্যবহৃত ‘বন্দেমাতরম্’ সংগীতটি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে অন্যতম প্রেরণা হয়ে উঠেছিল। দেবী চৌধুরাণী-তে গীতার নিষ্কাম কর্ম ও অনুশীলন তত্ত্বের আদর্শ অনুসৃত হয়েছে।
২. উপেন্দ্রকিশোর থেকে আধুনিক পর্যন্ত শিশুসাহিত্যের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।
উত্তর: বাংলা শিশুসাহিত্যকে সাবালক করার প্রথম কান্ডারি হলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। টুনটুনির কথা, পানতাবুড়ি, সাক্ষীশেয়াল প্রভৃতি কালজয়ী শিশুসাহিত্যের রচয়িতা তিনি। তাঁর রচনার প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, নানা উপকথা-রূপকথা বা লোককথাকে তিনি বাঙালি শিশুমনের উপযোগী ভাব-ভাষা দিয়ে লিখতে পেরেছিলেন। তাঁর পরবর্তী অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিশুসাহিত্য রচয়িতা হলেন তাঁর পুত্র সুকুমার রায়। সুকুমার রায়ের আবোল তাবোল-এর নাম শোনেনি, এমন বাঙালি শিশু নেহাতই বিরল। ননসেন্স ভার্সের এমন দৃষ্টান্ত বিশ্বসাহিত্যেও তুলনাহীন। রায়চৌধুরী পরিবারের অন্যান্য শিশুসাহিত্য রচয়িতাদের মধ্যে আলাদাভাবে উল্লেখ করতে হয় সুখলতা রাও, পুণ্যলতা চক্রবর্তী, লীলা মজুমদার ও সত্যজিৎ রায়ের কথা। লীলা মজুমদারের পদি পিসির বর্মি বাক্স বা সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা এবং প্রোফেসর শঙ্কুর ডায়রি হল কালজয়ী সৃষ্টি। এ ছাড়া বিখ্যাত শিশুসাহিত্যের মধ্যে উল্লেখ করতে হয় দক্ষিণারঞ্জন মিত্রমজুমদারের ঠাকুরমার ঝুলি, ঠাকুরদাদার ঝুলির কথা। রবীন্দ্রনাথের শিশু, শিশু ভোলানাথ বা খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থগুলিও যথেষ্ট পরিমাণে শিশুমনের উপযোগী করে লেখা। রবীন্দ্রনাথের সে গল্পগ্রন্থের কথাও প্রসঙ্গত উল্লেখ্য। অবনীন্দ্রনাথের ক্ষীরের পুতুল, বুড়ো আংলা, নালক, রাজকাহিনী প্রভৃতি বইগুলি বিখ্যাত শিশুসাহিত্য। চিত্রশিল্পী গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভোঁদড় বাহাদুর বাংলা শিশুসাহিত্যের একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘লালু’র মতো গল্পগুলি বাংলা শিশুসাহিত্যের বিশেষ সম্পদ। বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকের সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের দ্রুত বদলের সঙ্গে সঙ্গে শিশুসাহিত্য বা কিশোরসাহিত্যের চরিত্রও কিছুটা বদলে গেল। পরবর্তী সময়ের শ্রেষ্ঠ শিশুসাহিত্যিকরা হলেন শিবরাম চক্রবর্তী, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, খগেন্দ্রনাথ মিত্র, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় (ডিটেকটিভ গল্প), সুনির্মল বসু, আশাপূর্ণা দেবী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।
৩. ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে আলোচনা করো।
উত্তর: বিষয়বস্তুর ওপর নির্ভর করে শরৎচন্দ্রের উপন্যাসগুলিকে নিম্নলিখিত কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়-
১ . পারিবারিক উপন্যাস: শরৎচন্দ্রের এই পর্যায়ের উপন্যাসগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বিন্দুর ছেলে, মেজদিদি, নিষ্কৃতি, বৈকুণ্ঠের উইল ইত্যাদি।
২. প্রেমমূলক উপন্যাস: বড়দিদি, দেবদাস, পরিণীতা, দত্তা, দেনাপাওনা প্রভৃতি উপন্যাস হল শরৎচন্দ্রের বিখ্যাত প্রেমমূলক উপন্যাস।
৩. আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস: শরৎচন্দ্রের আত্মজীবনী- মূলক উপন্যাসের মধ্যে এক এবং অদ্বিতীয় হল শ্রীকান্ত।
৪. রাজনৈতিক উপন্যাস: পথের দাবী হল শরৎচন্দ্রের একটি বিখ্যাত রাজনৈতিক উপন্যাস।
৫. মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস: শরৎচন্দ্রের তিনটি শ্রেষ্ঠ মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস হল গৃহদাহ, চরিত্রহীন ও শেষ প্রশ্ন।
৬. সামাজিক উপন্যাস: পল্লীসমাজ শরৎচন্দ্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সামাজিক উপন্যাস। শরৎ-উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য: বাংলা উপন্যাসে শরৎচন্দ্র
চট্টোপাধ্যায়ের অবদান অনস্বীকার্য। তাঁর উপন্যাসের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি হল-দেশপ্রেম এবং অবহেলিত জনগণের প্রতি অকৃত্রিম অনুরাগ এবং বাঙালির দুঃখ-দারিদ্র্য ও মর্মবেদনাকে চোখের জলে, প্রেমের মাধুর্যে এবং জীবনদর্শনের গভীরতায় রূপায়ণ।
আরও পড়ুন – বই কেনা প্রবন্ধের প্রশ্ন উত্তর