উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় স্বাধীনতা ও সাম্যের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করো
উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় স্বাধীনতা ও সাম্যের প্রকৃতি
স্বাধীনতা ও সাম্যের আদর্শ, সভ্য সমাজ গঠনের অন্যতম অপরিহার্য উপাদান। কিন্তু সব সমাজব্যবস্থায় স্বাধীনতা ও সাম্যের ধারণার প্রকৃতি একই রকম হয় না। বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যবস্থায় স্বাধীনতা ও সাম্যের প্রকৃতির তারতম্য ঘটে। মার্কসীয় তত্ত্ব অনুযায়ী, স্বাধীনতা ও সাম্যের প্রকৃতি সমাজব্যবস্থার আর্থিক কাঠামোর দ্বারা নির্ধারিত হয়। উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ও হিতবাদের প্রভাব সুস্পষ্ট। এজন্য উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় স্বাধীনতা ও সাম্যের প্রকৃতি স্বতন্ত্র।
স্বাধীনতার প্রকৃতি
উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও চিন্তার স্বাধীনতাকে দুটি মূলনীতিরূপে গ্রহণ করা হয়। স্বাধীনতার ওপর সবরকম সরকারি বিধিনিষেধ ও নিয়ন্ত্রণ নিষিদ্ধ থাকে। উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণহীনতা স্বাধীনতার ধারণার একটি প্রধান উপাদানরূপে স্বীকৃত। মনে করা হয় যে, রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের অনুপস্থিতির মধ্যেই স্বাধীনতার প্রকৃত অস্তিত্ব নিহিত। সরকারি নিয়ন্ত্রণক্ষমতা যত কম, স্বাধীনতার পরিমাণ তত বেশি হয়। শুধুমাত্র রাজনৈতিক এবং কিছু সামাজিক স্বাধীনতা উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় স্বীকৃতি লাভ করে। অর্থনৈতিক স্বাধীনতাকে এখানে পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়। এজন্য উদারনৈতিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় স্বাধীনতার ধারণাকে নেতিবাচক বলে অভিহিত করা হয়। সাধারণত যেসব বিষয়ে স্বাধীনতা এখানে স্বীকৃতি পায় সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা, নির্বাচন করা ও নির্বাচিত হওয়ার স্বাধীনতা, যে-কোনো পেশা বা বৃত্তি অবলম্বনের স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, সরকারের সমালোচনা করার স্বাধীনতা প্রভৃতি। উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় স্বাধীনতার ধারণা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী দর্শনের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এই তত্ত্ব অনুসারে ব্যক্তিকে নিজের ইচ্ছা ও উদ্যোগ অনুসারে অবাধে চলতে দেওয়া হল স্বাধীনতা।
সমালোচনা: উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার রাজনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতাগুলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এগুলি হল অবাস্তব স্বাধীনতা। কারণ অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ছাড়া রাজনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতা বাস্তবায়িত হওয়ার কোনো সুযোগ থাকে না। মার্কসবাদীদের মতে, উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যে রাজনৈতিক স্বাধীনতা জনগণকে দেওয়া হয়, তা শেষ পর্যন্ত মিথ্যায় পরিণত হয়। এই সমাজে স্বাধীনতা আসলে মুষ্টিমেয় মানুষের স্বাধীনতামাত্র। লেনিনের মতে, বুর্জোয়া গণতন্ত্রে যে ব্যক্তিসাম্যের কথা বলা হয় তা আসলে সম্পত্তি- মালিকদের আইনসংগত সাম্য। এখানে প্রলেতারিয়েত শ্রেণি ও শোষিত শ্রেণির কাছে সাম্য পৌঁছোয় না (Under the guise of equality of the individuals in general, bourgeois democracy proclaims the formal or the legal equality of the property-owner and the proletarian, the exploiter, and the exploird, thereby grossly deceiving the oppressed classes) 4।
সাম্যের প্রকৃতি
উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সাম্যের প্রকৃতি বিশ্লেষণে দেখা যায়, স্বাধীনতার মতো এক্ষেত্রেও সামাজিক ও রাজনৈতিক সাম্যের আদর্শ প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করা হয়। তা ছাড়া আইনের চোখে সবাই সমান এবং আইন কর্তৃক সমভাবে সংরক্ষিত হওয়ার কথাও বলা হয়। এইভাবে আইনের অনুশাসন ও আইনের দৃষ্টিতে সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়া হয়। সমস্ত নাগরিকের ব্যক্তিত্ববিকাশের জন্য রাষ্ট্র সমান সুযোগ দেওয়ার কথা বলে থাকে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও প্রতিপত্তির ভিত্তিতে রাষ্ট্র নাগরিকের মধ্যে কোনো ভেদবিচার করে না। ধর্মীয় ক্ষেত্রেও সাম্য প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। সর্বোপরি, সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার এবং নাগরিকের নির্বাচিত হওয়ার অধিকার স্বীকার করে রাজনৈতিক সাম্যের ধারণাকে বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হয়।
সমালোচনা: উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শুধুমাত্র সামাজিক ও রাজনৈতিক সাম্যকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এখানে সাম্যের অন্য কোনো গুরুত্ব স্বীকৃতি পায় না। সমালোচকদের মতে, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সাম্য প্রতিষ্ঠিত না হলে রাজনৈতিক ও সামাজিক সাম্য মূল্যহীন হয়ে পড়ে। উদারনৈতিক ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক সাম্যের স্বীকৃতি না থাকায় রাজনৈতিক ও সামাজিক সাম্যের সুযোগ থেকে সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হয়।
মন্তব্য: উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় স্বাধীনতা ও সাম্যের প্রকৃতিকে পুরোপুরি মূল্যহীন বলে বর্ণনা করা সমীচীন হবে না। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও সাম্য প্রতিষ্ঠা-সংক্রান্ত ব্যাপারে কিছু মৌলিক ব্যবস্থাও এখানে দেখা যায়।
আরও পড়ুন – রাজনৈতিক তত্ত্বের মূল ধারণাসমূহ ২ নম্বরের প্রশ্ন ও উত্তর